শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

জ্ঞান-বুদ্ধির সীমানা এবং জাদু-টোনা-বাণ!

গোলাম মাওলা রনি

জ্ঞান-বুদ্ধির সীমানা এবং জাদু-টোনা-বাণ!

আজকের নিবন্ধটি পুরাকালের একটি কাহিনী দিয়ে শুরু করা যাক। সে বহুকাল আগের কথা একবার মহান আল্লাহ তাঁর জমিনের একটি অংশের জনপদ, লোকজন, বৃক্ষলতা, হর্ম্যরাজি ইত্যাদি ধ্বংস করে সেটিকে বিরান ভূমিতে পরিণত করতে চাইলেন। এ কাজের জন্য যথারীতি প্রধান ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-কে দায়িত্ব প্রদান করা হলো। জিবরাইল কৌতূহলবশত আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওই জনপদের বান্দা-বান্দিদের অপরাধ কী? আল্লাহ বললেন, তারা জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি-শুদ্ধি ও তর্ক-বিতর্কে অতিমাত্রায় পারদর্শী হয়ে নিজেদের সীমা অতিক্রম করছে। তারা জ্ঞানের বড়াই করে বেড়ায় অর্জিত জ্ঞান দিয়ে শান্তির পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টি করে। তারা জাদু, টোনা, বাণ, ভবিষ্যৎ গণনা ইত্যাদি কর্ম দ্বারা আল্লাহর কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করে, প্রকৃতির আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর অপচেষ্টা করে এবং জমিনে বিভেদ-বিসম্বাদ, হানাহানি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এসব কুকর্মের দ্বারা তারা আল্লাহর হকে অংশীদার হওয়ার মতো ভয়াবহ কবিরা গুনাহ করে এবং সাধারণ বান্দাদের গাফেল বানিয়ে ফেলে।

জিবরাইল (আ.) আল্লাহর হুকুমে আসমান থেকে জমিনে নেমে এলেন এবং ধ্বংসকর্ম শুরুর আগে ওই জনপদের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি আন্দাজ করার অনুমতি চেয়ে নিলেন। জিবরাইল একজন সাধারণ মুসাফিরের সুরতে হাঁটতে লাগলেন। তিনি পথে এক বালকের সাক্ষাৎ পেলেন। বালক পথের কিনারে বসে বালু নিয়ে একাকী আপন মনে খেলে যাচ্ছিল। জিবরাইল বালকটির সামনে গিয়ে বললেন, আচ্ছা! তুমি কি ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারো? বালক মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। জিবরাইল বেশ আশ্চর্য হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে তো তুমি নিশ্চয়ই গায়েবের খোঁজখবর করতে পারো। বালক এবারও হ্যাঁ সূচক জবাব দিল। জিবরাইল তখন বালকের কাছে ফেরেশতা জিবরাইল কে এবং তিনি বর্তমানে কোথায় আছেন তা জানতে চাওয়া মাত্র বালক কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করল। তারপর চোখ খুলে বলল, আমি সপ্ত আসমান, জমিন, আল্লাহর আরশ ইত্যাদি সর্বত্র খুঁজলাম কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইলকে পেলাম না। কাজেই আমার ধারণা তুমিই জিবরাইল। এ ঘটনা চাক্ষুষ দেখার পর জিবরাইল কালবিলম্ব না করে আল্লাহর আদেশ মোতাবেক সংশ্লি­ষ্ট জমিন ধ্বংস করে দিলেন।

মহাভারত, রামায়ণ, বাইবেল প্রভৃতি গ্রন্থে মানুষের ভবিষ্যৎ গণনা করার বহু অলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। পৃথিবীর নামকরা পর্যটক, ঐতিহাসিক, কবি-সাহিত্যিক এবং মুনি-ঋষি-সুফি-সাধকবৃন্দ... মানুষের জ্ঞান-গরিমার অসীম পরিধি বর্ণনার পাশাপাশি সেই পরিধির সীমা-পরিসীমা বর্ণনা করে তা অতিক্রম না করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। মানুষ যদি প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন না করে তবে তার মানবজম্ম  পূর্ণতা যেমন পায় না তেমন সার্থকতার স্বাদও আস্বাদন করতে পারে না। অন্যদিকে মানুষ যখন জ্ঞান অর্জন করতে গিয়ে নিজের শক্তি, সামর্থ্য এবং সীমা অতিক্রম করে তা কেবল তার নিজের জন্য নয় পুরো দেশ, জাতি, সমাজ, সংসার ও পরিবারের জন্য ধ্বংস ডেকে আনে। আমাদের সমাজে জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে কতগুলো জনপ্রিয় প্রবাদ রয়েছে। যেমন অতি চালাকের গলায় দড়ি, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী কথায় কথায় ডিকশনারি, ভাঙা কলস বাজে বেশি, আদার ব্যাপারীর জাহাজের খবর ইত্যাদি। এসব প্রবাদ-প্রবচনের মূল মর্মকথা হলো মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি তথা কথা-কর্ম-কাজ, শ্রবণশক্তি, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির সীমা অতিক্রম। অর্থাৎ মানুষ যখন নিজের জন্য প্রযোজ্য নয় অথবা মানানসই নয় এমন কিছু করে, বলে বা চিন্তা করে তখনই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের প্রবাদ রচিত হয়।

আমাদের আজকের আলোচনায় আমরা মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি, শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করে শিরোনাম প্রসঙ্গে চলে যাব। মানুষ তার নিজস্ব জ্ঞান-বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করলে জমিনে ও আসমানে কী কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং মানুষ কেন ওসব কর্ম করে তা নিয়ে আমার মতামত দেওয়ার আগে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করতে চাই। প্রথম ঘটনাটি আমাদের বাংলাদেশের। রাজা লক্ষণ সেনের আমলে ঘটনাটি ঘটেছিল। রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী ছিল বিক্রমপুরে। তিনি অত্যন্ত সদাসয়, দয়ালু, প্রজাহিতৈষী রাজা ছিলেন। তার জ্ঞান-গরিমা ও বীরত্ব সমসাময়িক ভারতবর্ষে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। তিনি বৃদ্ধ বয়সে বেশির ভাগ সময় তার দ্বিতীয় রাজধানী নদীয়ায় বসবাস করতেন যার নাম তিনি দিয়েছিলেন লক্ষণাবতী। স্থানটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিল এবং হিন্দুদের কাছে সেটি ছিল মহাতীর্থকেন্দ্র। রাজা লক্ষণ সেন হয়তো পুণ্যলাভের আশায় রাজধানী ছেড়ে সেখানে থাকতেন। আমি যে সময়টির কথা বলছি তখন পুরো ভারতবর্ষের স্থানীয় হিন্দু রাজাদের দরবারগুলো তুর্কি আক্রমণের ভয়ে তটস্থ থাকত। দিল্লিতে তখন কুতুব উদ্দিন আইবেকের শাসন চলছিল। দক্ষিণ ভারত ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন অংশে তুর্কি সেনাপতিরা একের পর এক দেশীয় রাজ্য দখল করে নিচ্ছিলেন। বখতিয়ার খলজি নামক তুর্কি সেনাপতি বিহার জয় করে ফেলেছিলেন। পরিস্থিতি যখন এমন তখন হঠাৎ লক্ষণ সেনের রাজদরবারে রাজ্যের গণমান্য ব্রাহ্মণরা সব এসে উপস্থিত হলেন একটি জরুরি বিষয় রাজাকে অবহিত করার জন্য।

আমরা হয়তো কমবেশি সবাই জানি যে, ব্রাহ্মণরাই হলো হিন্দুদের মধ্যে সবচেয়ে কুলীন শ্রেণি। মধ্যযুগের রাজনীতি মূলত ব্রাহ্মণরাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের ফতোয়ার বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস সাধারণত কোনো রাজা দেখাতেন না, কারণ জনগণ সেগুলোকে দৈববাণী মনে করত। রাজা লক্ষণের রাজত্বেও ব্রাহ্মণরা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তারা রাজাকে বললেন যে, তাদের প্রাচীন গ্রন্থে লিখিত আছে, একজন তুর্কি সেনাপতি নদীয়া আক্রমণ করে ধ্বংসলীলা চালাবেন। অতীতে লিখিত সেই ভবিষ্যদ্বাণী মোতাবেক বিপদ তাদের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছে গেছে। কারণ একজন তুর্কি সেনাপতি মহালঙ্কাকা- এবং ধ্বংসলীলা ঘটিয়ে বিহার দখল করেছেন। ফলে নারীদের ইজ্জত, মানুষের সম্পদ ও সামর্থ্যবানদের জীবন রক্ষার জন্য তাদের উচিত নদীয়াকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে অচিরেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া অথবা সুরক্ষিত রাজধানী বিক্রমপুরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়া। আমি আগেই বলেছি যে, রাজা লক্ষণ সেন অতিশয় জ্ঞানী ও বীরপুরুষ ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের কথায় বিচলিত না হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন যে, আপনাদের বইতে আক্রমণকারীর কোনো দৈহিক বর্ণনা রয়েছে কিনা। ব্রাহ্মণরা জানালেন যে, তিনি হবেন কৃষ্ণবর্ণের খর্বাকৃতি লোক। তার চেহারা হবে কুৎসিত এবং হাত দুটো হবে আজানুলম্বিত অর্থাৎ দুই খানা হাত লম্বায় তার হাঁটুর নিচ পর্যন্ত নেমে আসবে।

রাজা লক্ষণ সেন ব্রাহ্মণ প-িতদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের গোপনে বিহারে পাঠালেন। তারা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজিকে স্বচক্ষে দেখার পর ভগ্ন হৃদয়ে এবং কম্পিত শরীরে নদীয়া ফিরে এলেন এবং রাজাকে প্রকৃত ঘটনা জানালেন। তারা একই সঙ্গে ব্রাহ্মণদেরও তা জানিয়ে দিলেন এবং নিজেরা ফিসফাঁস করে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে একের পর এক জানাতে লাগলেন। ফলে ব্রাহ্মণ প-িত, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বেশির ভাগ দুর্বলচিত্তের লোক নদীয়া থেকে পালিয়ে গেলেন। রাজা লক্ষণ সেনের বয়স তখন আশি বছর চলছিল। তার পরও তিনি সাহসহারা হলেন না। তিনি শত্র“র ভয়ে নদীয়া ত্যাগ না করে বরং সাধ্যমতো প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুললেন। সে সময় নদীয়ায় প্রবেশের প্রধান ও একমাত্র সড়কটি তেলিয়াগড় হয়ে নদীয়া সীমান্তে প্রবেশ করেছিল। লক্ষণ সেনের পূর্বপুরুষরা তেলিয়াগড়ে একটি শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। রাজা সেই দুর্গে পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশ ঘটালেন। দ্বিতীয় পথ ছিল নদীপথে আক্রমণ যা তুর্কিদের জন্য ছিল অসম্ভব কারণ তাদের কোনো নৌবাহিনী ছিল না এবং তাদের স্থলবাহিনীর অনেকে ভালোমতো সাঁতার জানত না। তৃতীয় পথটি ছিল অত্যন্ত দুর্গম। ঝাড়খ-ের গহিন অরণ্য পাড়ি দিয়ে নদীয়া পৌঁছা বলতে গেলে অসম্ভব ছিল।

সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাজা নদীয়াতেই অবস্থান করতে থাকলেন বটে কিন্তু তার সৈন্যবাহিনী এবং রাজ অমাত্যবর্গ ব্রাহ্মণ প-িতদের তথ্য শোনার পর থেকে ভয়ে যেভাবে কাঁপন শুরু করেছিলেন তা উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। ওদিকে বখতিয়ার খলজি তেলিয়াগড়ের পথে না গিয়ে দুর্গম জঙ্গলের পথ ধরে নদীয়ার দিকে এগোতে থাকলেন। তিনি তার পুরো অশ্বারোহী বাহিনীকে ষোল-সতের জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে ভাগ করে সবাইকে ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশ ধারণ করালেন যাতে জঙ্গলের কিনারে বা মধ্যখানে লক্ষণ সেনের সেনাবাহিনীর তল্লাশির মধ্যে না পড়ে। এভাবে তিনি সবার অজান্তে এবং সবাইকে অবাক করে দিয়ে নদীয়ার রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে নিজের ছোট দলটি নিয়ে ঘোড়া বিক্রেতারূপে উপস্থিত হলেন। তারপর হঠাৎ বেশ পরিবর্তন করলেন এবং অগ্নিমূর্তি ধারণ করে প্রাসাদরক্ষীদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সেখানে ভয়ের এক বিভীষিকা তৈরি করে দিলেন। এ ঘটনার খবর যখন রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে পৌঁছল তখন রাজা লক্ষণ সেন মধ্যাহ্নভোজনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তার ক্ষুধার্ত পেট, আশি বছরের দুর্বল শরীর এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি এই তিনে মিলে মস্তিষ্কের চিন্তাশক্তি এলোমেলো করে দিল। তিনি ভাবতেই পারেননি কিংবা তার গোয়েন্দারা কোনো পূর্বসংকেত দিতে পারেননি যে শত্র“রা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আসতে পারে। ফলে রাজা স্বভাবতই ধরে নিলেন যে, বখতিয়ার তেলিয়াগড় হয়ে এসেছে এবং সেখানকার দুর্গের পতন হয়েছে। সুতরাং তিনি প্রতিরোধ করার কথা না ভেবে প্রাসাদের গুপ্তদ্বার দিয়ে সপরিবারে পালিয়ে মূল রাজধানী বিক্রমপুরে চলে এলেন।

উপরোক্ত কাহিনী দুটোর আলোকে আমরা দুটো বিষয় পর্যালোচনা করার চেষ্টা করব। প্রথমত, মানুষ কী করে ভবিষ্যতের খবর জানতে পারে। দ্বিতীয়ত, বিধাতা কেন এ ধরনের কাজকে গর্হিত মনে করেন। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জটিল ও কঠিন কিন্তু একই সঙ্গে মজাদারও বটে। পাঠকবৃন্দ যাতে আজকের বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে পারেন এজন্য মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা নিয়ে সংক্ষেপে কিছু আলোকপাত করতে চাই। বুদ্ধি হলো মানুষের একটি সহজাত গুণাবলি। প্রকৃতির সব প্রাণীরই কিছু না কিছু বুদ্ধি রয়েছে যা তারা জম্ম  গতভাবে পায় এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী বুদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের উদ্দীপনা জোগায়। জ্ঞান সাধারণত অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ ও অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত হয় যা বুদ্ধিকে শানিত এবং অধিকতর কার্যকরভাবে প্রয়োগে সহায়তা করে। জ্ঞান যেমন সবার সমান হয় না তেমন বুদ্ধি সবার সমান হয় না। মস্তিষ্কের আকার-আয়তন, পিতা-মাতার বুদ্ধিশুদ্ধি, বংশের ধারা গর্ভকালে মায়ের খানাখাদ্য, মনমানসিকতা এবং জšে§র পর ১০ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের মধ্যে খাবার-দাবার, পরিচর্যা, ব্যায়াম ইত্যাদির ওপর বুদ্ধি নির্ভর করে।

এবার প্রজ্ঞা নিয়ে কিছু বলা যাক। এটি হলো জ্ঞান-বুদ্ধি, চরিত্র-মাধুর্য, মনমানসিকতা, নীতিবোধ এবং সততা ও সত্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে গঠিত একটি অতি উচ্চস্তরের মানবিক গুণ যার দ্বারা মানুষ সত্য এবং মিথ্যা, সঠিক এবং অন্যায় ইত্যাদির পার্থক্য নিরূপণ করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং সঠিক পথে চলার সামর্থ্য লাভ করে। প্রজ্ঞাকে আরবিতে হিকমা বলা হয়। ইসলামমতে আল্লাহই তাঁর প্রিয় বান্দাদের হিকমা দান করেন। জ্ঞান-বুদ্ধি ও হিকমার বাইরে যা রয়েছে তাকে আপনি বিজ্ঞান বা বিশেষ জ্ঞান আখ্যা দিতে পারেন। মানুষ তার প্রয়োজন, সাধ, স্বপ্ন ও অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য বিজ্ঞানের চর্চা করে। বিজ্ঞানের ভালো দিক যেমন রয়েছে তেমন মন্দ দিকও রয়েছে। অনাদিকাল থেকে একশ্রেণির মানুষ মন্দ বিজ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই জাদু-টোনা-বাণ, বশীকরণ, অশ্বমেধযজ্ঞ ও নিয়তি সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি অনেক গায়েবি বা গুপ্ত বিষয় সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করে। মধ্যযুগের মুসলিম প-িতরা এসব গায়েবি জ্ঞানসমৃদ্ধ জাদুকর ও জ্যোতিষীদের জ্ঞানের উৎস হিসেবে শয়তানকে দায়ী করেছেন। শয়তান তাদের বিশেষ ক্ষমতাবলে আসমানের অনেক গোপন তথ্য জানতে পারে যা তারা দুনিয়ায় তাদের ভক্ত, শিষ্য ও বন্ধুদের জানিয়ে দেয় জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করার জন্য।

বর্তমানের জ্ঞান-বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও প্রযুক্তির যুগে অনেকেই হয়তো মধ্যযুগের মুসলিম প-িতদের ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত হবেন না। তাই তাদের জন্য বর্তমান বিজ্ঞানের আলোকে মহাবিশ্বের মালিক, তাঁর কর্মকা- এবং বিশ্বব্রহ্মা- পরিচালনার ব্যাপারে ধারণা দেওয়া যেতে পারে। ধরুন আল্লাহ তামাম বিশ্বকে একটি কম্পিউটার নেটওয়ার্কের মতো করে সফটওয়্যার দ্বারা চালাচ্ছেন। এখানের সবকিছু চলছে ওয়্যারলেস প্রযুক্তিতে। সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্ক তদারকির জন্য রয়েছেন ফেরেশতারূপী অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কাম ইঞ্জিনিয়ার। এ নেটওয়ার্ক সৃষ্টিকুল হলো ব্যবহারকারী বা ইউজার যারা সৃষ্টিকর্তার শেখানো ম্যানুয়ালমতো কাজ করলে, কথা বললে এবং আচরণ করলে প্রকৃতিতে বিপত্তি দেখা দেবে না এবং প্রতিটি জিনিস ঠিকঠাকমতো চলবে। কেউ যদি ভুল করে, তবে তার জন্য পুরো নেটওয়ার্ক ব্যবহার-অনুপযোগী হয়ে যায়। কেউ যদি সাধারণ সফটওয়্যার ভেদ করে স্রষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় তবে তাকে আলাদা ফরম্যাটে মেসেজ পাঠাতে হবে। কেউ যদি নেটওয়ার্ক থেকে ব্যতিক্রমী সেবা নিতে চায় তবে তাকে আলাদা ও অতিরিক্ত ফি দিয়ে স্পেশাল কোড নম্বর নিয়ে নেটওয়ার্কে ঢোকার অনুমতি অর্জন করতে হবে। আধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির উল্লিখিত বিধিবিধান আমরা যেমন জানি তেমন বেআইনিভাবে প্রযুক্তির মধ্যে ঢুকে অবৈধ স্বার্থ হাসিলকারী হ্যাকারদের দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তপনা সম্পর্কে আমরা জানি। সারা মাস ব্যাংকে কাজ করে কেউ হয়তো ১ লাখ টাকা আয় করে এবং সারা জীবন ধরে ৫-৬ কোটি টাকা আয় করার স্বপ্ন নিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করে। কিন্তু হ্যাকাররা এক মুহূর্তের মধ্যে ৫০০ কোটি টাকা চুরি করার লোভ নিয়ে সারা জীবন ধরে গবেষণা আর হ্যাকিংয়ের জ্ঞান অর্জন করে। ঠিক একইভাবে অনাদিকাল থেকে কিছু মানুষ ঐশীজ্ঞান, ঐশী কর্মপদ্ধতি ও প্রবৃত্তির আইন নিয়ে গবেষণা করতে করতে কেউ কেউ আল্লাহর অলিরূপে ইসমে আজমের জ্ঞান হাসিল করেন, আবার কেউ কেউ সেই ইসমে আজমকে হাসিল করেন হ্যাকারদের মতো ব্যক্তিস্বার্থে মন্দ কাজ করার জন্য।

আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হলে আমাদের রাষ্ট্র যেমন হ্যাকারদের পাকড়াও করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে তেমন প্রকৃতির কোনো বিধান লঙ্ঘিত হলে মহাবিশ্বের মালিক সেটিকে গুরুতর অপরাধ গণ্য করে তার প্রতিবিধান করার জন্য প্রচলিত সফটওয়্যারের বাইরে গিয়ে আলাদা ব্যবস্থা নেন। প্রকৃতিতে প্রতিটি কাজের জন্য নির্ধারিত ফলাফল রয়েছে। প্রতিটি আঘাতের সমান প্রতিঘাত রয়েছে। প্রতিটি আকুতির উত্তর রয়েছে। প্রতিটি সমস্যা ও রোগবালাইয়ের সমাধান রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির ফেসবুক, ব্যাংকিং সফটওয়্যার, ম্যার্কেটিং ও অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যারের যেমন নির্দিষ্ট ইনপুট এবং সে অনুযায়ী আউটপুট রয়েছে অর্থাৎ নির্ধারিত পাসওয়ার্ড, ভয়েস কমান্ড ও টাচ কমান্ড রয়েছে তদ্রুপ প্রবৃত্তিতেও মানুষের কর্ম, কথাবার্তা-আচরণ এবং স্পর্শের সুনির্দিষ্ট ফলাফল নিহিত রয়েছে। কেউ যদি এগুলোর ব্যতিক্রম ঘটায় অথবা জোরজবরদস্তি করে অথবা অতিমাত্রার কৌশল বা ফাঁকিবাজি আরম্ভ করে তবে দুনিয়ার সফটওয়্যারের মতো প্রকৃতির সফটওয়্যার হ্যাং হয়ে যায়; ক্র্যাশ করে অথবা হ্যাকড হয়ে যায়। এ অবস্থায় দুনিয়ার সফটওয়্যারের মালিক ও ব্যবহারকারীর যে অবস্থা হয় প্রকৃতির মালিক ও প্রকৃতির ব্যবহারকারীদেরও ঠিক একই দশা হয়।

পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সুফল ভোগ করতে হলে আমাদের অবশ্যই নির্ভুলভাবে নির্মাতার নির্দেশনামা মেনে সেগুলো ব্যবহার করতে হবে। তদ্রুপ প্রকৃতির সুফল পেতে হলে প্রকৃতির আইন মানার কোনো বিকল্প নেই। দুনিয়ার প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যত বেশি মূল্যবান এবং বিরাটাকার হয় সেগুলোর ব্যবহারকারীকে তত বেশি সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও আভিজাত্য অর্জন করতে হয়। একইভাবে প্রকৃতির বড় বড় দান যেমন রাজপদ, রাজসিংহাসন, মানমর্যাদা, সুনাম-সুখ্যাতি, জনপ্রিয়তা, সৎ ও অভিজাত বংশজাত হওয়ার সৌভাগ্য লাভ ইত্যাদি নিয়ামত যখন প্রকৃতির কোনো সফটওয়্যারের মাধ্যমে বান্দার কাছে ধরা দেয় তখন তা প্রকৃতির নিয়ম মেনেই ব্যবহার করতে হয়। কেউ যদি ওগুলো হ্যাক করার চেষ্টায় জ্ঞান-বুদ্ধির সীমা অতিক্রম করে তবে দুনিয়ায় সে সরাসরি আল্লাহকে নিজের প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলে।

            লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর