শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শিশু-কিশোরদের মানস গঠনে সাহিত্য

শায়লা রহমান তিথি

শিশু-কিশোরদের মানস গঠনে সাহিত্য

আজকে যারা শিশু-কিশোর আগামী দিনে তারাই হবে জাতির কর্ণধার। তাই তাদের সত্যিকার ভালো মেধাবী মানুষে পরিণত করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন তাদের মানস গঠন। তাদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের সম্ভাবনা। শিশুর মানস গঠনে প্রয়োজন যথার্থ নৈতিক শিক্ষা প্রদান। এ নৈতিক ও নাগরিক শিক্ষার জন্য সাহিত্য হতে পারে এক অনন্য মাধ্যম। তবে তা অবশ্যই শিশু-কিশোরদের উপযোগী হওয়া চাই। যে সাহিত্য শিশু-কিশোরদের মধ্যে সুপ্ত অজস্র্র গুণের স্ফুরণ ঘটাবে।

সাহিত্যের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের জীবনবোধ জাগিয়ে তোলাটা অপরিহার্য। এ পরিস্থিতিতে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসপি) দেশের সব জেলা, উপজেলা ও মহানগরীর কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে এক সম্মেলনের আয়োজন আশায় আশান্বিত করে। আমরা সম্মেলনের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি। আমরা চাই ফি বছর চলুক এমন আয়োজন।

একটি কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, শিশু-কিশোরদের উপযোগী সাহিত্য কিন্তু একটু ভিন্ন ধরনের ভিন্ন মেজাজের। সেগুলো বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের মনোযোগী হতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। কারণ শিশুদের জন্য বা কিশোরদের জন্য যে সাহিত্য রচনা করা হয় তা সবারই পাঠ উপযোগী, কিন্তু সব সাহিত্য শিশু-কিশোরদের পাঠ উপযোগী না-ও হতে পারে।

শিশু-কিশোর সাহিত্য কীভাবে শিশুর মানস গঠনে সহায়ক হতে পারে, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। এ ক্ষেত্রে রূপক হিসেবে একটি উদাহরণ আমরা দিতে পারি। যেমন ‘আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদার হতে ভাইরে, কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে।... বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র, নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবা-রাত্র।’ এই যে পুরো কবিতায় ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের মাধ্যমে যে শিক্ষামূলক বক্তব্য পরিস্ফুটিত হয়েছে তা অবশ্যই শিশু-কিশোরদের মনে রেখাপাত করতে সক্ষম। শিশু-কিশোরদের অনুভূতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে অনেক অমর ছড়া, কবিতা। যেমন যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা-দিদি’, কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘কাজের লোক’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ প্রভৃতি ছড়া ও পদ্যের বিষয়বস্তু ও ছন্দের কারুকার্য শুধু শিশু-কিশোর নয়, বয়স্কদের জন্যও প্রেরণাদায়ক হতে পারে।

সাহিত্যের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের প্রেরণা তৈরির সঙ্গে সঙ্গে দেশাত্মবোধের চেতনা সঞ্চারিত করার জন্য আমাদের বাংলা সাহিত্যের দুই শীর্ষ কবির অবদান প্রবাদতুল্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর আমদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এ দুজনের শিশুতোষ লেখাগুলো সত্যি চিরকালীন এতে কোনো সন্দেহ নেই।

জসীমউদ্দীন পল্লীকবি বলে খ্যাত হলেও শিশুমনকে পল্লীবাসীর চোখ দিয়ে বিচার করেননি। পরিপূর্ণ মানব মনের পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর শিশুতোষ ছড়া-কবিতায়। ‘সবার সুখে’, ‘রাখাল ছেলে’,  ‘নিমন্ত্রণ’,  ‘এত হাসি কোথায় পেলে’ প্রভৃতি ছড়া ও পদ্যে শিশুমনের আবেগ অনুভূতিকে ব্যক্তিবিশেষের আবেগ অনুভূতির সীমা ছাড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিক আবেগ ও অনুভূতিতে রূপান্তরিত করেছেন।

আমাদের ছোটবেলায় আমরা ডা. লুৎফর রহমানের অনেক বই পড়েছি। যেমন উন্নত জীবন, ধর্ম জীবন, মানব জীবন এ ধরনের বইগুলোর যে হিতোপদেশ তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি তা আমাদের জীবন চলার পথে পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। তখন একটি জেনারেশন গড়ে উঠেছে যারা ভদ্রতা, নম্নতা, শিষ্টাচার ও আত্মমর্যাদায় বলীয়ান ছিল। আজকের প্রজন্মের দিকে আমরা যখন তাকাই খুব সহজেই আমরা সেই প্রজন্ম আর আজকের এই ডিজিটাল প্রজন্মের মধ্যে একটা গুণগত পার্থক্য দেখতে পাই। এটা দেখতে যে খুব বেশি অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন হতে হয় তাও কিন্তু নয়। সমাজের যে কারও পক্ষেই এটা বোঝা সম্ভব।

মদনমোহন তর্কালঙ্কার একজন নীতিবাদী সাহিত্যিক। ফলে তার শিশুতোষ রচনায়ও তার নীতিবাদী প্রভাব পড়েছে যা পড়ে আমাদের শিশু-কিশোররা হতে পারে আদর্শ মানুষ। তার বিখ্যাত পদ্য ‘আমার পণ’। তাঁর বিখ্যাত সেই লেখা ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি। আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে, আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।’ এই যে লেখাটি, এটি একজন শিশু বা কিশোরের মধ্যে যে শিক্ষামূলক প্রেরণা সঞ্চার করবে তাতে কি কোনো সন্দেহ আছে? নেই। আবার গোলাম মোস্তফার ‘এই করিনু পণ মোরা এই করিনু পণ, ফুলের মতো গড়ব মোরা মোদের এই জীবন। হাসব মোরা সহজ সুখে গন্ধ রবে লুকিয়ে বুকে, মোদের কাছে এলে সবার জুড়িয়ে যাবে মন।’ এই যে একটি আদর্শ শিশুর সকাল থেকে সারা দিন ভালো হয়ে পথ চলার সংকল্পে কিংবা তার জীবনকে ফুলের মতো সৌরভময় করে গড়ে তোলার অনুপ্রেরণা একমাত্র সাহিত্যই দিতে পারে। আজকের প্রজন্মকে সাহিত্যমুখী করার জন্য আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে একসঙ্গে।

লেখক : সম্পাদক, ঝুমঝুমি

সর্বশেষ খবর