রবিবার, ১১ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
স্মরণ

মেজর এম এ গণি ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

আবুল কাশেম হৃদয়

মেজর এম এ গণি ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট

বাঙালির সামরিক ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। ১৯১৫ সালে ‘দি বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর’ এবং পরে একটি ব্যাটালিয়ন বা বাঙালি পল্টন গঠনের মধ্য দিয়ে সে ঐতিহ্যের বীজ বপিত হয়। সময়টা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাঙালি মুসলমানদের পাইওনিয়ার রেজিমেন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে বাঙালি সামরিক জাতি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। যে দুটি পাইওনিয়ার রেজিমেন্ট সে সময় গঠন করা হয়, তার একটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন কুমিল্ল­ার মেজর এম এ গণি (১৯১৫-১৯৫৭)। যিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক হিসেবে সুখ্যাত। তিনি ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোর সেন্টারে ১৪০৭ পাইওনিয়ার কোম্পানি গঠনের সময় সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেজর এম এ গণি পদাতিক বাহিনীর যোগ্য বাঙালি সৈনিকদের তার কোম্পানিতে নির্বাচন করেন। বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধে অংশ নেওয়া মেজর গণির দূরদর্শী নেতৃত্বে দেশ বিভাগের পর পাইওনিয়ার কোম্পানি থেকে বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। সারা দেশ ঘুরে তিনি সৈন্য বিভাগের যোগ্য যুবকদের সংগ্রহ করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নের সংখ্যা দাঁড়ায় ৮-এ। মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মহান আত্মত্যাগ ও অসাধারণ অবদানের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে বাংলাদেশের গৌরব বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী ও বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যুক্ত কমান্ড যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। দেশব্যাপী মরণপণ যুদ্ধের পর বাংলাদেশ লাভ করে মহান স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৫টি ইউনিট বিদ্রোহ ঘোষণা করে। পুরো বাংলাদেশকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য বিদ্রোহী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইস্ট বেঙ্গলের ৮টি ব্যাটালিয়নকে ১১টিতে উন্নীত করে ‘এস’, ‘কে’ ও ‘জেড’ ফোর্সের অধীন করা হয়। কুমিল্ল­া সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিক-কর্মকর্তারা বিদ্রোহ করলে তাদের নিরস্ত্র করার নামে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী চালায় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ। এ হত্যাযজ্ঞ ছিল ইতিহাসে বিরল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বড় সামরিক গণহত্যার ঘটনা। কী নির্মম, কী বর্বর আর পাষ- ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তপিপাসু সেনা কর্মকর্তারা তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমান যুদ্ধ তদন্ত কমিশনের কাছে দেওয়া পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্নেল মনসুরুল হকের সাক্ষ্যে। তিনি বলেন, ‘কুমিল্ল­া নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা ২৩ এফএফ ও ২২ বেলুচের সমন্বয়ে গঠিত ৫৩ ব্রিগেড গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক ২৫ মার্চের পর থেকে আটকে রাখা এবং ২৯ মার্চ বাঙালি সেনাসদস্যরা বিদ্রোহ ঘোষণার পর আটক ১৭ জন বাঙালি অফিসারসহ ৯১৫ জনকে অঙ্গুলি হেলনে জবাই ও গুলি করে হত্যা করে।’ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে সব অপরাধ করেছে বা নৃশংসতা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয় তার মধ্যে কুমিল্ল­া সেনানিবাসের বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নিরস্ত্র করার সময় সংঘটিত হত্যাকা-কে গুরুতর অভিযোগ বা বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখানো হয় হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে। কমিশনের সামনে প্রমাণ হিসেবে এই মর্মে সুনির্দিষ্ট করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে যে, ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের কমান্ডার লে. কর্নেল ইয়াকুব মালিক কুমিল্ল­া সেনানিবাসে ১৭ জন অফিসার এবং অন্যান্য র‌্যাঙ্কের ৯১৫ জনকে হত্যার জন্য দায়ী। সেনানিবাসের ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৪০ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স এবং এসএমজির বাঙালি সদস্যদের নিরস্ত্র করার নামে এই হত্যাকা- চালানো হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবদান অসামান্য। সেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জনক হিসেবে খ্যাত মেজর আবদুল গণি। এম এ গণি নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর               পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক মেসার্ভির অনুমতি নিয়ে মেজর আবদুল গণি পূর্ব বাংলার যুবকদের নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ করে বার্মা স্টার ও ওয়ার মেডেল পাওয়া মেজর আবদুল গণির সবকিছু থাকলেও কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভি জে ই প্যাটারসন এবং মেজর গণি (তৎকালে ক্যাপ্টেন) ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং অফিসারের দায়িত্বে ছিলেন। মূলত মেজর এম এ গণি পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জেলা থেকে বাঙালি যুবকদের বাছাই করে আনা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি নজর দেন পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর (পিএনজি) দিকে। তিনি বিভিন্ন জেলার সালার-ই-জিলা ও তার সদস্যদের মধ্য থেকে বাঙালি যুবক বাছাই করেন। এর মধ্যে তার বাড়ি যেহেতু কুমিল্ল­ায় সেই জন্য তিনি কুমিল্ল­া থেকে যুবকদের রিক্রুট করতে চান। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৫০ সালের ২০ অক্টোবর দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আবদুল গণি কুমিল্ল­ায় এলে প্রায় পাঁচ হাজার যুবক সমবেত হয়। সেখান থেকে অন্তত ১৬০ জনকে মনোনীত করা হয়। ৪ অক্টোবর ক্যাপ্টেন আবদুল গণি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান সেখান থেকে পাকিস্তান ন্যাশনাল গার্ডে লোক নেওয়ার জন্য। সেখানে নিয়মিত এবং উপযুক্ত পরীক্ষার পর ৩৩ জনকে বাছাই করেন পিএনজিতে ভর্তি করতে। পরে তিনি যান কসবায়। তখন পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ছিলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব খান। তিনি কুমিল্ল­া সার্কিট হাউসে এসে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের ১২ জন সদস্যের সাক্ষাৎকার নিয়ে ৪ জনকে নির্বাচন করেছিলেন। তাদের ঢাকায়  ৬ষ্ঠ ব্যাচে প্রশিক্ষণের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এর নির্দিষ্ট কোনো সময় জানা যায়নি। 

১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮টি ব্যাটালিয়ন গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখা চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ‘বেবী টাইগার্স’-এর একটি কোম্পানি নিউক্লিয়াস হিসেবে নবম ইস্ট বেঙ্গল গঠন করে। এই বেবী টাইগার্সের কর্মকর্তা মেজর আইন উদ্দিন নেতৃত্বে নবম ইস্ট বেঙ্গল কুমিল্ল­া শহরকে পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে মুক্ত করে কুমিল্ল­া সেনানিবাস দখলে নেয়। চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের শহীদ সেনা সদস্যদের এবং বীর যোদ্ধাদের স্মরণে কুমিল্ল­া সেনা নিবাসে ‘বেবী টাইগার্স সরণি’ রয়েছে।

লেখক : সম্পাদক, দৈনিক কুমিল্ল­ার কাগজ।

[email protected]

সর্বশেষ খবর