বুধবার, ১৪ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

চাই আদর্শ শিক্ষক

বাহালুল মজনুন চুন্নু

চাই আদর্শ শিক্ষক

জাতি গঠন ও উন্নয়নের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম শিক্ষা। শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গন এ উপাদানগুলোকে ঘিরে আবর্তিত হয় শিক্ষা। এর কোনো একটি উপাদানে যদি সামান্যতম ঘাটতিও থাকে তবে শিক্ষায় তার প্রভাব পড়ে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়ার মূল নিয়ামক হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা, নিষ্ঠা ও প্রচেষ্টার ওপরই নির্ভর করে শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত উৎকর্ষতা। শিক্ষকতা নিছক কোনো চাকরি নয়, এ মহান এক পেশা, এক মহান ব্রত যার ওপর নির্ভর করে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। শিক্ষক শিক্ষার আলো চারদিকে ছড়িয়ে দেন তার মহতী চেতনা ও প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে, তৈরি করেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার মসৃণ পথ। এজন্য একজন শিক্ষককে আদর্শবান, কর্তব্যনিষ্ঠ, মূল্যবোধ ও মানবিক বোধসম্পন্ন, নিরলস পরিশ্রমী, নির্ভীক, সুশৃঙ্খল, জ্ঞানী, আধুনিক ও গতিশীল মনের অধিকারী হতে হয়। এ গুণগুলো যে শিক্ষকের মধ্যে আছে, কেবল তিনিই পারেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁর এসব গুণ সঞ্চারিত করতে। আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস। একজন আদর্শ শিক্ষক নিজের অর্জিত জ্ঞানভান্ডারকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি করে আন্তরিকতা ও একাগ্রতার মাধ্যমে কেবল শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, অনুশীলন প্রস্তুত, মূল্যায়ন ও সহপাঠক্রমই পরিচালনা করেন না, তিনি শিক্ষার্থীদের মাঝে বপন করে চলেন মূল্যবোধ, নৈতিকতা, মানবিকতা, দেশপ্রেমসহ আদর্শ মানুষে পরিণত হওয়ার সব গুণ। শিক্ষকতায় নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য সর্বদা থাকেন সজাগ, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাখেন সুসম্পর্ক এবং শিক্ষার্থীদের কাছে অবতীর্ণ হন রোল মডেল তথা পথপ্রদর্শক হিসেবে। কিন্তু আজ এ ক্ষেত্রে কিছু ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, যার ফলে আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে জ্ঞান-মেধাশূন্য, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধহীন এক অসুস্থ প্রজম্মে র দিকে আমাদের ধাবিত হওয়ার।

বিদ্যালয়ে ভর্তির হার বাড়ছে, পাসের হার বাড়ছে, জিপিএ ফাইভের হার বাড়ছে কিন্তু শিক্ষার্থীদের যে হারে জ্ঞান ও সামাজিক দক্ষতা অর্জন করার কথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা তা থেকে যোজন-যোজন দূরে অবস্থান করছে। শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম একটি কারণ আদর্শ ও মানসম্মত শিক্ষকের ঘাটতি। এ ঘাটতির কারণ বহুবিধ। তবে সর্বাগ্রে বলা যায় কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা একে কেবল নিছক চাকরি ও অর্থ উপার্জনের উপায় হিসেবে দেখছেন, ব্রত হিসেবে নয়। ফলে নিজেদের প্রকৃত দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে এরা কেবল অর্থের পেছনেই ছুটতে থাকেন। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার একটা বিষয়। একটা বাস্তব উদাহরণ দিই। আমার পরিচিত ক্লাস সিক্সে পড়া অধরা ভালো ছাত্রী। প্রাথমিকের সব শ্রেণিতেই প্রথম হয়ে আসছে সে। ক্লাস সিক্সে নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর দেখা গেল অঙ্ক, ইংরেজিতে ফেল। অধরা ভীষণ কান্নাকাটি জুড়ে দিল। তার পরীক্ষা খুবই ভালো হয়েছে। আশির ওপর নম্বর থাকবেই এ বিশ্বাস থেকে সে অঙ্ক ও ইংরেজির শিক্ষকের কাছে গিয়ে খাতা দেখতে চাইল। শিক্ষকরা তাকে খাতা দেখালেন না, বরং বললেন তুমি আমাদের কাছে প্রাইভেট পড়বা আগামী মাস থেকে তাহলে এর পরের বার এ+ পাবা। এ কথাগুলো সেই ছোট্ট মেয়েটির মুখ থেকে শুনে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। শিক্ষকদের প্রতি এই বাচ্চা মেয়েটি যে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠছে তা আমাদের জন্য খুবই লজ্জার। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই এ ধরনের সংবাদ ছাপা হয়। আবার শিক্ষকদের দুর্নীতি, অতিমাত্রায় রাজনৈতিকীকরণ, রেষারেষি, প্রশ্ন ফাঁস, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির মতো সংবাদও আমাদের পিলে চমকে দেয়। এ ছাড়া আরও অনেক রকম অসংগতি আমরা অনেক শিক্ষকের মাঝে দেখতে পাই। ফলে কমে যায় শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনো কখনো যখন দেখি কোনো কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রথম হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে পেছনের দিকের শিক্ষার্থীকে বেছে নেন নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে, তখন জাতির বিবেক বলে বিবেচিত শিক্ষকদের এহেন কর্মে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়েই সংশয় জেগে ওঠে মনে। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে আমাদের শিক্ষকসমাজকে। তবে আশার কথা, এ সংখ্যা খুব বেশি নয়। এখনো অনেক আদর্শ শিক্ষক আছেন যারা ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিক্ষার আলো। সেই আলোয় ভর করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য চাহিদ অনুযায়ী দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের বিকল্প নেই। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষকদের মানোন্নয়ন সবার আগে জরুরি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের বড় অংশই অপ্রশিক্ষিত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় ২৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ শিক্ষক প্রশিক্ষণ ছাড়াই পাঠদান করছেন। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়ও একই অবস্থা। এমনিতেই শিক্ষক সংকট, তার ওপর যদি শিক্ষকরা প্রশিক্ষিত না হন, তবে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। আবার যেসব শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন, তার বেশির ভাগকেই সেই প্রশিক্ষণলব্ধ জ্ঞান শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ না করে প্রথাগত পদ্ধতিতেই শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়। ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’র মতো শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদান-বহির্ভূত নানাবিধ কাজ করানো হয় কিংবা অনেকে স্বেচ্ছায় নিজেদের নানাবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন। ফলে পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে শ্রেণিকক্ষে যেতে পারেন খুব কমসংখ্যক শিক্ষকই। এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রশাসক ও শিক্ষক উভয়েরই সচেতন থাকা উচিত।

লেখক : সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর