শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গণতন্ত্রের স্নিগ্ধ সমীরণ বহিছে ধীরে

নূরে আলম সিদ্দিকী

গণতন্ত্রের স্নিগ্ধ সমীরণ বহিছে ধীরে

পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার প্রতি সীমাহীন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। অবশেষে সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে হবে কিনা এ প্রশ্নে বাংলার দিগন্তবিস্তৃত আকাশে যে ঘনঘোর অমানিশার অন্ধকার জমে উঠেছিল, প্রান্তিক জনতা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় ও আতঙ্কে প্রকম্পিত হচ্ছিল, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তা অনেকটাই দূরীভূত হয়েছে। গুমোট ভ্যাপসা গরমের পর এক পশলা বৃষ্টি ধুলার ধরণিকে যেমন শান্ত-প্রশান্ত সুশীতল আবেশে একটা স্নিগ্ধতা ছড়ায়, অনেকটা সে রকম অনুভূতি এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবহমান বলেই অনুভূত হচ্ছে। আমরা আশা করব, কোনো রকমের অশুভ শক্তি কাক্সিক্ষত এ নির্বাচনটিকে বানচাল করতে পারবে না। এর আগে ২০১৪ সালের একপক্ষীয় ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মতো অনাকাক্সিক্ষত, অনভিপ্রেত ঘটনার পুনরাবৃত্তিও জাতি অবলোকন করতে চায় না। পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করে এ দেশের অজেয় জনতা রক্তের চড়া দামে কেনা স্বাধীনতাকে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ইনশা আল্লাহ সুসংহত করবে, দেশের সংহতিকে সুদৃঢ় করবে। সেইসঙ্গে ষড়যন্ত্রের সব বিষদাঁতকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে তারা সক্ষম হতে যাচ্ছে। দেশের প্রান্তিক জনতার দীপ্ত হৃদয় উদ্বেলিত ও উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বজ্রনির্ঘোষে বার বার ঘোষণা করছে রাজনীতির কুটিল ষড়যন্ত্রকে জনতা সফল হতে দেখতে চায় না। ইথারে কান পাতলেই সুস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কোটি কণ্ঠের নির্ঘোষিত সেই আওয়াজ। ঐক্যবদ্ধ জনতা অজেয়। কুটিল ষড়যন্ত্রের মূর্তপ্রতীক হিংস্র দানবের কোনো ষড়যন্ত্রকেই তারা অতীতেও সফল হতে দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না, ইনশা আল্লাহ।

এ দেশের প্রবহমান রাজনীতিতে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিএনপি প্রভাবিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ড. কামাল হোসেন প্রত্যয়দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার সমন্বয়ে পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন এবং সম্ভাব্য নির্বাচনটি হওয়ার জন্য সূক্ষ্ম কারিগরের ভূমিকা তিনি রাখতে পেরেছেন, তা অশান্ত সমুদ্রে দক্ষ নাবিকের মতো শক্ত হাতে তরণির হাল ধরে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে নেওয়ার মতোই প্রণিধানযোগ্য।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের যে সাতটি দাবি ছিল, তা সর্বজনবিদিত ও উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। তার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি, সংসদ ভেঙে দেওয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার প্রতীতি ও প্রত্যয় তারা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বার বার ব্যক্ত করেছিলেন। তাদের বক্তৃতা-বিবৃতি সবকিছুর মধ্যেই এ দুটি দাবি মূলত অন্তর্নিহিত ছিল। অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে তারা দাবি দুটি থেকে অনেকটাই সরে এসেছেন এবং সম্ভাব্য গ্রহণযোগ্য শর্তগুলো মানলেই তারা নির্বাচনে যাওয়ার যে মনোভাব ব্যক্ত করেছেন, তা নির্বাচন অনুষ্ঠানে শুধু সহায়তা প্রদর্শনই করেনি, বরং বিরোধীদলীয় জোটের দক্ষতা ও দূরদর্শিতার দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। রাজনীতিতে একটা চিরাচরিত প্রবাদ আছে দুই পা এগোনোর জন্য এক পা পিছিয়ে এলে রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় এবং গণমানুষের সমর্থন অর্জনও তাতে অনেক সহজ হয়।

জেদ বা একগুঁয়েমি, অনড় ও আপসহীন মানসিকতা অনেক সময় শুধু পথচলাকে দুরূহ দুষ্কর ও অসম্ভবই করে তোলে না, জনসমর্থনেও ভাটার সৃষ্টি করে। রাজনীতিতে বার্গেইন শব্দটি শুধু ভীষণভাবে প্রচলিতই নয়, লক্ষ্য অর্জনে কার্যকরও বটে। যে বা যারা এ বার্গেইন বা দরকষাকষিটা ধৈর্য ও দক্ষতার সঙ্গে করতে পারেন, শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা রণাঙ্গনে নির্ধারিত হয়নি। এই রাজনৈতিক দরকষাকষির দক্ষতার মধ্য দিয়েই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি প্রচন্ড দূরদর্শী নেতা ছিলেন। অন্যদিকে ভারতীয় কংগ্রেসে শুধু গান্ধীজিই নন, মতিলাল নেহরু, পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, মাওলানা আজাদ, জয়প্রকাশ নারায়ণ, সরদার বল্লভভাই প্যাটেলসহ প্রথিতযশা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতারা প্রচন্ড ধৈর্যের সঙ্গে অবস্থার প্রেক্ষাপটে যথার্থ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখতেন এবং ধৈর্য ধরে সেইমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। ফলে তাঁদের রাজনৈতিক পথপরিক্রমণ যেমন কক্ষচ্যুত হয়নি, স্বাধীনতা অর্জনেও তেমনি অলঙ্ঘনীয় বাধার সৃষ্টি হয়নি। ইতিহাস থেকে আমাকে উল্লেখ করতেই হয়, চৌরাচিরায় আন্দোলনরত উত্তেজিত জনতা পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশ নিধন করলে গান্ধীজি এই সহিংস এবং আন্দোলনের নামে চরম উচ্ছৃঙ্খল প্রতিহিংসাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা ও প্রতিবাদই শুধু করেননি, সমগ্র ভারতে চলমান ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলনকে তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা গান্ধীজির এই সিদ্ধান্তের অন্তর্নিহিত অহিংসার তাৎপর্য প্রথমে অনুধাবন করতে না পেরে প্রচ- বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাদের বিবেচনায় গান্ধীজির মতিভ্রমের কারণেই এ সিদ্ধান্তটি তিনি দিয়েছেন এবং এ কারণে চলমান আন্দোলনে ভাটার টান পড়বে। স্বাধীনতা আন্দোলনে উগ্রপন্থিরা কেউ কেউ গান্ধীজিকে ব্রিটিশের দালাল ও আপসকামী ভ- নেতা হিসেবে গালমন্দ করেছেন। গান্ধীজি কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের শুধু আন্দোলনের অভয়বাণীই শোনাননি, বরং প্রত্যয়দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, আমি ভারতের স্বাধীনতা চাই কিন্তু ভারতকে রক্ত¯œাত করে নয়। অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনের মননশীলতাকে তিনি সমর্থন দিতে গিয়ে কোনো অবস্থাতেই সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেননি। আজ যারা বাংলাদেশে বিরোধী দলের আন্দোলন করেন, তারা অবশ্যই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যে, রক্তক্ষরণ, জ্বালাও-পোড়াও, পেট্রলবোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে আন্দোলনকে বেগবান করা যায় না, বরং তা জনগণকে আন্দোলন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করে। সেদিক থেকে বিবেচনায় নিলে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ওই বিএনপির কর্মীবৃন্দ প্রতিহিংসার পথ পরিহার করে সংযতভাবে আন্দোলনের যে দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করে চলেছেন, তা শুধু তাদের আন্দোলনের সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততাই কেবল বৃদ্ধি করছে না, বরং বিজয়ের সম্ভাবনার দ্বারগুলো একটার পর একটা উম্মু ক্ত করছে। যার ফলে ইতিমধ্যে সরকারের সঙ্গে বিরোধী জোটের দুটি সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমঝোতা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসুলভ কিছু রসিকতা করলেও আলোচনায় তিনিও ইতিবাচক অবদান রেখেছেন। নির্বাচন কমিশনও মুখ্য বিরোধী দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনেকটাই আশাবাদী হয়ে উঠেছে। বিরোধী দলের নির্বাচনের তফসিল পেছানোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনটি এক সপ্তাহ পিছিয়েছে এবং সরকারি দল তাদের অবস্থান পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে যে, নির্বাচনের তারিখ পেছানোর ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। এটিও একটি ইতিবাচক অগ্রগতি। ‘যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ এই মানসিকতায় সরকারি দল বুঁদ হয়ে থাকলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া আদৌ সম্ভব হবে না। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণের যে সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছে, তা নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য তো বটেই, জাতির জন্যও স্বস্তিকর। নির্বাচনটি সবার অংশীদারিত্বে করার দাবিটি শুধু বিরোধী দলেরই নয়, জাতিসংঘ ও বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রগুলো প্রায় সবাই দৃঢ়ভাবে ইতিবাচক অভিমত ব্যক্ত করেছে এবং নির্বাচনী মাঠ মসৃণ ও সবার জন্য একই ধরনের সুযোগ-সুবিধার দ্বার উম্মু ক্ত রাখার জন্যও জাতিসংঘসহ বিশ্ব জনমত সুদৃঢ় অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে। ফলে বিগত নির্বাচনের মতো ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার সুযোগ এবার একেবারেই নিঃশেষিত। শেখ হাসিনা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে হযরত শাহজালালের পবিত্র মাটি থেকে ভোট চাওয়া শুরু করেছেন। এটি নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি করার একটি সুস্পষ্ট চেষ্টা। আমি আগেই বলেছি, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি সংগঠিত থাকায় তাদের পক্ষে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভবই হবে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক, নির্বাচনটি যে হবে এবং তাতে দেশের মুখ্য দলগুলো যে অংশগ্রহণ করবে তা এখন সুস্পষ্ট।

স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে যাওয়ার পরও সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সংশয় থাকা একান্তই অনভিপ্রেত এবং জাতির জন্য লজ্জাজনক। এটি আওয়ামী লীগ ও বিরোধীদলীয় জোটের উপলব্ধি করা উচিত। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে নিরপেক্ষ, অকুতোভয় ও প্রকৃত অর্থেই নির্বাচন কমিশনকে সর্বতোভাবে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে পারলেই নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বাস্তবতা সৃষ্টি হবে। কাগজে-কলমে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু বাস্তবে তা কতখানি প্রযোজ্য, বিরোধী দল ও দেশবাসীর কাছে তা অস্পষ্ট বলেই যত মতানৈক্য ও জটিলতার সৃষ্টি।

শেখ হাসিনা প্রায়শই ঘোষণা দিচ্ছেন, জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় থাকব, ভোট না দিলে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেব। তিনি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশ কারও এজমালি সম্পত্তি নয়, দেশটি আমাদের সবার। জনগণের ভোট বা সমর্থন না থাকলে জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় না, তিনিও তা চান না। যে কোনো জাতীয় নির্বাচনকে নিশ্চিতভাবে নিরপেক্ষ করার দায়িত্ব প্রশাসনেরই। কিন্তু আমাদের দেশে সামরিক বাহিনী কখনো কখনো অদৃশ্য শক্তি হয়ে প্রশাসনের ওপর শুধু প্রভাব বিস্তারই করে না, অমনক সময় তাকে ভঙ্গুর করে ফেলে।

ড. কামাল হোসেন বিএনপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটি অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো। এটি যে কীভাবে সম্ভব হলো, ভাবলে আশ্চর্যান্বিত ও বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাই। তবে আজ এটিই স্পষ্ট যে, রাজনীতিতে সবই সম্ভব। একদিকে শেখ হাসিনা বার বার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করছেন, ভোট না পেলে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবেন না। অন্যদিকে বিএনপির জাহাজের অস্থায়ী ও ধার করা নাবিক ড. কামাল হোসেন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তিনি নিজে এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। এখানে একটি প্রশ্ন প্রতিভাত হয়েই ওঠে, জোটের নির্বাচনে গণফোরামের প্রার্থীদের প্রতীক উদীয়মান সূর্য বিএনপির ভোট কতটুকু টানতে পারবে? এখানেও ড. কামাল হোসেনের সমস্যাটি বোধগম্য যে, বিএনপি কোনো অবস্থাতেই তাদের ভোটের প্রতীক ধানের শীষ ছাড়বে না। ছাড়াটাও তাদের জন্য সবদিক থেকে ক্ষতিকর। অন্যদিকে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করা ড. কামাল হোসেন ও গণফোরামের পক্ষে হবে লজ্জাজনক। তাই আজ প্রশ্ন উঠেছে, একই জোটের ভিন্ন প্রতীক জনগণকে যথাযথভাবে আকৃষ্ট করতে পারবে তো? মজার কথা হলো, অতীতে নৌকা নিয়ে নির্বাচিত অনেক প্রার্থী এই জোটের সঙ্গে আজ একীভূত। প্রতীক নিয়ে তাদের সমস্যা তো আরও প্রকট। তাই অনেক বিশ্লেøষক মনে করেন, এই জটিলতা নিরসনকল্পে জোট একটি আলাদা ও নিজস্ব প্রতীক নির্বাচন কমিশনের কাছে চাইতে পারত। নতুন কোনো নির্বাচনী প্রতীক তাদের জন্য বরাদ্দ হলে জনগণ তাদের প্রতি ভোট প্রদানে অনেক সহজ ও স্বচ্ছন্দ বোধ করত। জনান্তিকে জানানো উচিত, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত আভিজাত্যের দাম্ভিকতায় ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর জোট যুক্তফ্রন্ট ও তার দল বিকল্পধারা ড. কামাল হোসেনের সঙ্গ ত্যাগ করে অনেকটা সন্তর্পণে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির প্রচেষ্টার যে সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে, তা অনভিপ্রেত তো বটেই, পুত্রের লালসা মেটাতে গিয়ে রাজনীতিতে ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত ডা. চৌধুরীর ভাবমূর্তি তা অনেকখানি বিনষ্ট করবে।

বিকল্পধারায় মাহী বি. চৌধুরীর ইচ্ছাটাই শেষ কথা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তারা ঘাঁটছড়া বাঁধতে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। ড. কামাল হোসেনের সঙ্গ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কিছু আসনে ভাগ বসানোর যে কোনো চেষ্টা জনগণের কাছে নেতিবাচক ও নিন্দিত ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হবে। এটি ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের ঐতিহ্য ও অর্জনের অবমাননা। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নেতারা মুসলিম লীগের অনুগ্রহ ও অনুকম্পায় বা চেয়েচিন্তে তাদের অবস্থান নির্ধারণ করেননি। বরং জনগণের অভূতপূর্ব সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। যুক্তফ্রন্ট নামটির কারণে মানুষ অভিভূত হয়ে এগিয়ে আসবে বা তাদের সমর্থন দেবে এ চিন্তাটি বাস্তবতাবিবর্জিত ও অমূলক। কে কত বড় নেতা, কার কত বার্গেইনিং দক্ষতা সেটি প্রদর্শনের সময় এটি নয়। বরং এখন সময়ের দাবি, জাতির সুদৃঢ় ঐক্য সৃষ্টিতে কে কতখানি দক্ষ ও কার কতখানি ত্যাগের মনোভাব সেটি জাতির সামনে তুলে ধরা। যারা রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে চান, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে জাতিকে অবমুক্ত করতে যারা ইচ্ছুক, ছোটখাটো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও ভুল বোঝাবুঝি ভুলে তারা কায়মনোবাক্যে ইস্পাতদৃঢ় একটি ঐক্য তৈরি করতে পারলে এবারের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন নিশ্চিত না হলেও শেখ হাসিনাকে একটা জোর নাড়া দিতে পারবেন। যেটি শেখ হাসিনার দাম্ভিকতায় অনেকখানি রাশ টানতে পারবে। আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটিই হলো সময়ের দাবি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার এরই মধ্যে একটি ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেছেন। তিনি বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনেও যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব, তা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ তিনি গ্রহণ করেছেন। এ ক্ষেত্রে মানসিকতাটা মহৎ কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত দুরূহ। যেখানে প্রশাসনের ডিসি-এসপিরা নিজেদের আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে উদ্গ্রীব, এমনকি প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে তার অতীত জীবনে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ করার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে আওয়ামী লীগের নিঃস্বার্থ নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন, সেখানে নির্বাচন কমিশনারের এ ধরনের দুঃসাহসিক আকাক্সক্ষা কল্পনাবিলাসী, অবান্তর ও অবাস্তব বলেই জনগণ মনে করে। তবু নির্বাচনে যেতেই হবে, নির্বাচনই সরকার পরিবর্তনের একমাত্র পথ। ষড়যন্ত্রকারীরাই অন্ধকার অলিগলি খোঁজে, রাজনীতিকরা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়। তবে আমি মনে করি, আসন্ন নির্বাচন সরকারদলীয় জোট ও বিরোধীদলীয় একমাত্র জোটের লড়াই হওয়া উচিত। এ লড়াই বিরোধী পক্ষকে বিজয়ী করবে এ কথা বলা না গেলেও গণতন্ত্রের পাদপীঠকে সুদৃঢ় ও মজবুত করবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অবস্থান ও কর্মকান্ডে অতীতে প্রতিভাত হয়েছে, তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি পরিপূর্ণ আন্তরিক নন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতা থাকাকালে সংসদে তাঁর উপস্থিতি এতই কম ছিল যে, বিষয়টির প্রতি তাঁর অনাগ্রহ ও গুরুত্বহীনতা জনগণকে যথেষ্ট সন্দিহান করেছে। আজকে সময়ের দাবি, খালেদা জিয়াকে অবশ্যই সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শ মনেপ্রাণে ধারণ করতে হবে। বিএনপি যদি নীতিগতভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস প্রতিস্থাপন করতে পারে, জ্বালাও-পোড়াও নয়, গণতান্ত্রিক সভা ও মিছিলে ভিসুভিয়াসের মতো জ্বলে উঠতে শেখে তবেই এ দেশে গণতন্ত্র তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। নইলে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতোই হয়তো কালের স্রোতধারায় ক্ষমতার পট পরিবর্তন হবে কিন্তু দেশ যে তিমিরে আছে, সেই তিমিরেই রয়ে যাবে এবং প্রতিহিংসা ও সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির আবর্তে আমাদের আরও অনেকদিন কাটাতে হবে। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রই রাজনীতিতে সহনশীলতার শিক্ষা দেয়, যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠতে সাহায্য করে এবং একনায়কতন্ত্রের পথ অবরুদ্ধ করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের চেতনার গভীরেই কেবল প্রতিভাত হয় -

I will defer you up to the last, but i will protect your right to defer me unto my death.

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা

সর্বশেষ খবর