শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াবার জয়যাত্রা

ড. আতিউর রহমান

বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়াবার জয়যাত্রা

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। কঠিন মুক্তিযুদ্ধ শেষে শত্রুদের পরাজিত করে এই মাসের ষোল তারিখে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় নিশান উড়িয়েছি।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রটি মুক্তিযুদ্ধের ফসল। একটি লোকায়িত জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আত্মপরিচয়ের সংগ্রামে লিপ্ত ছিল। সুখে-দুঃখে এক হয়ে বেঁচে থাকার তীব্র আকাক্সক্ষাই বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র গঠনে তাঁদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। শত শত বছর ধরে এ দেশের কৃষক সন্তানরা এই আশা বুকে নিয়ে নানা বিদ্রোহ ও সংগ্রাম করেছেন। আর সেই অনুপ্রেরণার সূত্র ধরেই ঐতিহাসিক সংগ্রামের পরম্পরায় আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের সেই হিরণ¥য় সময়ে দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার এক অতুলনীয় সুযোগ মেলে এ অঞ্চলের দুঃখী মানুষের। সেই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেই তাঁরা অর্জন করেন স্বাধীন বাংলাদেশ। মূলত বয়সে ও মনে তরুণরাই অসামান্য আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করে এই বিজয়। আর সে কারণেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বাংলাদেশের একক ও অবিভাজ্য মানুষের সর্বোচ্চ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। সে সময় তাঁদের একমাত্র পরিচয় ছিল তাঁরা বাংলাদেশের জনগণ। মুসলিম ও অমুসলিম বলে তাদের তখনো বিভক্ত করা হয়নি। ছিল না নৃতাত্ত্বিক বিচারেও জনগোষ্ঠীর বিভাজন। কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের সেই অবিভাজ্য পরিচয়ে ব্যত্যয় ঘটে। ১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রধর্মের নাম করে বাংলাদেশের মানুষকে বিভক্ত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশটির ভিত্তিই নড়বড়ে করে দেওয়া হয়। অবশ্য, বাংলাদেশের হৃদয়কে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয় আরও আগে। ’৭৫-এ জাতির পিতাসহ বাংলাদেশের স্থপতিদের হত্যা করার পরই শুরু হয় জাতির মৌল আকাক্সক্ষাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে তাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার এক নির্মম প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ারই অংশ হিসেবে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ বদলে যোগ করা হয় ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের’ কথাগুলো। ‘স্বাধীনতা’ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। কিন্তু তাই বলে তা ‘মুক্তি’র প্রতিশব্দ হতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ জীবন বাজি রেখে যে রাষ্ট্রের পত্তন করেছেন তার মূলে ছিল অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির চেতনা। সেই চেতনার মূলে ছিল তার ‘বাংলা ভাষা’র প্রতি ভালোবাসা, ছিল ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি’। তাঁরা স্বপ্ন দেখেছেন জনগণের কর্তৃত্বের সরকারের। তাঁরা আইনের চোখে সবাই সমান এমন মানবাধিকারের চেতনায় উদ্দীপ্ত ছিলেন স্বাধীনতার ঊষালগ্নে। কারও দয়ায় নয়, অধিকারের জোরেই তারা সারা দেশে সুষম উন্নয়নের প্রত্যাশা করেছিলেন। সুখের বিষয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান তাদের সেই স্বপ্নের আদল বেশ স্পষ্ট করেই ধরতে পেরেছিল।

সংবিধানের ওই মৌলচেতনায় এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্তসহ সব মানুষেরই সুষম উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার হক রয়েছে। সংবিধানের দ্বিতীয় পর্বে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে সাম্যভিত্তিক অর্থনীতি ও সমাজ গড়ার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার যুক্ত করা হয়েছে। শ্রেণিতে শ্রেণিতে, পুরুষে  নারীতে ও গ্রামে-শহরে বৈষম্য কমানোর প্রতিশ্রুতি স্থান পায় সংবিধানে। বিশেষ করে স্থান পায় নারী অধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণের আকাক্সক্ষা। এই সাংবিধানিক অঙ্গীকারের আলোকেই বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে দেশের ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো, রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, শিক্ষা কমিশন, কৃষি উন্নয়নের জন্য নানা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আধুনিক কৃষি উপকরণ সংগ্রহসহ ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। এসবের সুফল আমরা পেতেও শুরু করেছিলাম। তিনি সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য একটি সাম্যভিত্তিক কল্যাণধর্মী উন্নয়নের শক্তিশালী পাটাতন তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। একাত্তরে গণমানুষের মনে স্বপ্নের যে বিস্ফোরণ ঘটেছিল তাকে পুঁজি করেই তিনি এমন এক ‘সোনার বাংলা’ গড়ার কাজে নেমে পড়েছিলেন যেখানে ‘শিশুরা খেলবে, মায়েরা হাসবে’। কেননা তিনি কাউকে পেছনে ফেলে যেতে চাননি। রবীন্দ্রনাথের ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ কবিতাটি তিনি ভালো করেই পড়েছিলেন। ওই কবিতায় লেখা আছে :

‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।’

হঠাৎ করেই পঁচাত্তরের আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীদের আঘাতে তিনি শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন না হলে অন্তর্ভুক্তিমূলক এই উন্নয়নের এক সুদৃঢ় ভিত্তি সম্পন্ন করতে সক্ষম হতেন এবং এ দেশের দুঃখী মানুষের দুঃখ মোচনে এতটা সময় লাগত না। এরপর আমাদের প্রিয় স্বদেশ চলতে থাকে অন্ধকারের দিকে। অনেক সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৯৬ সালে তাঁর সুকন্যার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আমরা ফিরে পাই। শুরু হয় সমাজের নিচের দিকের মানুষগুলোর ভাগ্যোন্নয়নের জন্য কৃষি উন্নয়ন, সামাজিক সুরক্ষা, শ্রমিককল্যাণ, উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদানের মতো জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন কৌশলের রূপায়ণ। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রচলন হয় এই সময়ে। আটানব্বইয়ের ভয়াবহ বন্যা সত্ত্বেও তাঁর শাসনামলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুস্থিতি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল। ২০০১ সালে ঘটে ফের ছন্দপতন। দীর্ঘ সাত বছর অপেক্ষার পর স্বদেশ আবার ফিরে আসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে। গত এক দশক ধরে কল্যাণমুখী উন্নয়ন কৌশলের সফল রূপায়ণের ফলে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তি-মূলক সমাজ ও অর্থনীতির এক অভাবনীয় পুনর্জাগরণ ঘটেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ সবুজ টেকসই বাংলাদেশ তৈরির মহাযজ্ঞ। ব-দ্বীপ ২১০০ পরিকল্পনা এই উন্নয়ন অভিযাত্রার শেষ সংযোজন। ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন বুকে নিয়ে স্বদেশ হাঁটছে জাতির পিতার আরাধ্য সমৃদ্ধ বাংলাদেশ অর্জনের স্থির লক্ষ্য অর্জনের দিকে। নয়া এই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অভিযাত্রার পেছনে তিনটি কৌশল কাজ করছে : এক. উচ্চ প্রবৃদ্ধি অথচ তা অন্তর্ভুক্তিমূলক; দুই. আত্মনির্ভরশীল অথচ অংশীদারিত্বমূলক এবং তিন. ঐতিহ্যে বিশ্বাসী অথচ প্রযুক্তি গ্রহণে উৎসাহী। এই ধারার উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নিজের নাম যুক্ত করার প্রাথমিক ছাড়পত্র জাতিসংঘ থেকে পেয়ে গেছে। দারিদ্র্য নিরসন ও মানব উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি এক কথায় বিস্ময়কর। পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কৌশল নির্ধারণ এবং সর্বশেষ ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার সুদূরপ্রসারী স্বপ্নের বীজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুনেছেন জাতির মানসতটে। ইতিমধ্যে আমাদের অর্জন বিশ্ববাসীর নজরে পড়তে শুরু করেছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, ‘বুমিং বাংলাদেশ’, এইচএসবিসি গ্লোবাল রিপোর্ট বলেছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশ পৃথিবীর ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। আইএমএফের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসূচকে’ গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৪তম। ‘উবারে’র প্রদীপ পরমেশ্বরণ মনে করেন, ২০২০ সাল নাগাদ ভারতের মাথাপিছু আয়ের চেয়েও বেশি হবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় (২ হাজার ডলার)। বর্তমানে ভারতের চেয়ে তিন গুণ হারে বাড়ছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়। গত তিন বছরে তা বেড়েছে ৪৩%। গত আট বছর ধরে লাগাতার আমাদের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৬ শতাংশের বেশি হারে। গত বছর তা ছিল ৭.৮%। পৃথিবীর ১০টি সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশের একটি বাংলাদেশ। এশিয়ার তিনটির একটি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলছে দক্ষিণ এশিয়ায় জেন্ডার সাম্যসূচকে পয়লা নম্বরের দেশ বাংলাদেশ। এই সূচকে বিশ্বে তার অবস্থান ৪৭তম। ইউনিসেফ বলছে গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ শিশুমৃত্যুর হার কমিয়েছে ৭৩%। ২০০৫ সালে জম্মে র সময় বাংলাদেশে হাজারে ৬৮টি শিশুর মৃত্যু ঘটত। ২০১৬ সালে সেই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫-এ। মাতৃমৃত্যুর হারও কমেছে আশাতীতভাবে। ২০০৫ সালে এটি ছিল লাখে ৩৪৮। ২০১৬-তে তা হয়েছে ১৭০। ভারতসহ উন্নয়নশীল বিশ্বে এ হার ওই বছর ছিল ২৩২। জম্ম হার ব্যাপক হারে কমায় এখন দম্পতি প্রতি সন্তানের সংখ্যা ২.১। বাহাত্তরে এ সংখ্যা ছিল প্রায় ৬। আমাদের দারিদ্র্যের হার কমে ২২ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। বাহাত্তরে তা ছিল ৮০ শতাংশেরও বেশি। প্রকৃত আয় প্রতি বছরই বাড়ছে। কেননা আমাদের মূল্যস্ফীতি গত ১০ বছরে ১২% থেকে কমে ৫.৪ শতাংশে নেমে এসেছে। খাদ্যে আমরা এখন উদ্বৃত্ত। চাল ছাড়াও মাছ, সবজিতেও আমরা স্বয়ং সম্পূর্ণ। তাই এখন আমাদের গড় আয়ু ৭৩ বছর। ভারত ও উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে তা চার বছর বেশি। এই অর্জনে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থ-সামাজিক নীতি-কৌশল এবং ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংক এই সময়ে প্রথাগত আর্থিক সেবার বাইরে থাকা বিশেষ করে সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে অবস্থানকারী প্রান্তিক মানুষকে মূলধারার আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাপকভিত্তিক আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ফলে একদিকে সর্বস্তরের জনগণের মূলধারার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের জীবন ও জীবিকার মানোন্নয়ন করা গেছে, অন্য দিকে এর ফলে আর্থিক সেবা খাতের বিকাশের মাধ্যমে পুরো সামষ্টিক অর্থনীতিই আরও বেগবান হয়েছে। এজন্য জনগণের দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দিতে হয়েছে। আর এ ক্ষেত্রে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ মুখ্য ভূমিকা রেখেছে। এক কোটি কৃষকের ১০ টাকার ব্যাংক হিসাব রয়েছে। সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে পড়া মানুষের অনেকেরই এমন ব্যাংক হিসাব রয়েছে। গ্রামে ব্যাংকের শাখা দ্রুত বেড়েছে।

কেবল গত ৫ বছরেই প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য ব্যাংক শাখার পরিমাণ বেড়েছে ৭ শতাংশ। এই সময়ে প্রতি এক লাখ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের জন্য এটিএম মেশিনের সংখ্যা বেড়েছে ৬৮ শতাংশ। প্রযুক্তিভিত্তিক বিকল্প আর্থিক সেবা চ্যানেলের বিকাশ হয়েছে এর চেয়েও কয়েকগুণ বেশি হারে। প্রতি এক লাখ নাগরিকের জন্য মোবাইল মানি আউটলেটের সংখ্যা ১৮৭ থেকে বেড়ে ৬৬৭টি হয়েছে গত পাঁচ বছরে (অর্থাৎ ২৫৭ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে)। মোবাইল মানি অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও একই হারে বেড়েছে (গত পাঁচ বছরে তিন গুণ বেড়েছে)। ৬ কোটি মানুষ এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা পান। এক কোটি মা ‘মায়ের হাসি’ প্রকল্পে এই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত ভাতা পান। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেওয়া শুরু হয়েছে। এর ব্যাপ্তি দ্রুতই বাড়ছে। ভাবতে অবাক লাগে এ দেশের ভিক্ষুক, গৃহকর্মী, রিকশাওয়ালা, গার্মেন্টস কর্মী ও অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষ নিয়মিত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধা পাচ্ছেন। স্বপ্নেও এরা ভাবেননি তারা এভাবে ব্যাংকিং সেবা পাবেন। মোট কথা ডিজিটাল আর্থিক সেবার ক্ষেত্রে এক নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে।

এজেন্ট ব্যাংকিংও এই ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিপ্লবের একটি অন্যতম প্রধান অংশ। বর্তমানে ১৭টি ব্যাংকের ৫ হাজার ৩০০-এর বেশি এজেন্ট আউটলেটের মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ অ্যাকাউন্ট পরিচালিত হচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কম খরচে বিকল্প ডিজিটাল আর্থিক সেবা পৌঁছে যাচ্ছে গ্রাহকের দোরগোড়ায়। সেবা পাচ্ছেন আগে প্রথাগত ব্যাংকিং সেবার কথা ভাবেননি এমন মানুষেরা। নিয়মিত ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা প্রদান, স্কুল ব্যাংকিং, বিল পরিশোধে এজেন্ট ব্যাংকিং বিশেষ ভূমিকা রাখছে। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে রেমিট্যান্সের টাকা সহজে, নিরাপদে এবং বৈধভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রেও এজেন্ট আউটলেটগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এসএমই ঋণ প্রদানের মাধ্যমে আগে ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা এলাকায় অকৃষি খাতের বিকাশে এজেন্ট ব্যাংকিং মুখ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।

সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা গেছে, ৫২ শতাংশ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক মনে করেন এজেন্ট আউটলেটের কারণে তারা এখন যেখানে থাকেন তার খুব কাছাকাছি ব্যাংকিং সেবা পাওয়া যাচ্ছে এবং প্রথাগত ব্যাংক শাখায় ব্যাংকিং করতে তাদের মধ্যে যে ভীতি কাজ করত তা এজেন্ট আউটলেটের ক্ষেত্রে নেই। এ ছাড়াও যাতায়াত খরচও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমে এসেছে।

এজেন্ট ব্যাংকিং প্রকৃত অর্থেই আগামী দিনের ব্যাংকিং। আমরা এখনো এর পুরো সুফল পেতে শুরু করিনি। বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যারা সঞ্চয় করছেন তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ এজেন্ট ব্যাংকিং সুবিধা না থাকলে প্রথাগত পদ্ধতিতে সঞ্চয় করতেন না। অর্থাৎ এই ২০ শতাংশকে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক থেকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। ফলে আগামীতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আরও বিপুল পরিমাণ মানুষকে আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবায় নিয়ে আসবে এজেন্ট ব্যাংকিং, আর এর ফলে ব্যক্তি গ্রাহকদের পাশাপাশি লাভবান হবে পুরো অর্থনীতি। বুথ ব্যাংকিং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আরেকটি উদ্যোগ। গার্মেন্টস কর্মীদের  এতে করে খুব সুবিধা হবে।

এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বিকাশে এবং দীর্ঘমেয়াদে এর টিকে থাকার ক্ষেত্রে ব্যাংকের পাশাপাশি এজেন্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা অর্জন এ ক্ষেত্রে প্রধানতম পূর্ব শর্ত। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলে যারা বসবাস করেন তাদের মধ্যে প্রথাগত ব্যাংকিং সেবা নিয়ে অনেক ধরনের ভীতি ও আস্থার অভাব কাজ করে থাকে। এ জন্য এজেন্টদের সমাজেরই একজন হয়ে কাজ করতে হবে, মানুষের কাছাকাছি যেতে হবে। তবেই জনগণ (বিশেষত প্রান্তিক মানুষ) তাদের ওপর আস্থা রাখবেন এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের গ্রাহক হবেন। মোট কথা আর্থিক লাভালাভকে একমাত্র বিবেচ্য না করে সেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমার ধারণা এখানকার ব্যাংকারদের এ ধারার মনের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।

আরও মনে রাখতে হবে, এজেন্ট ব্যাংকিং আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিভিত্তিক একটি সল্যুশন হলেও প্রযুক্তিই এখানে প্রধান নয়। মূলে থাকতে হবে মানবিক বিচারের জায়গা থেকে মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার মানসিকতা। যারা মূলধারার আর্থিক সেবার বাইরে ছিলেন, তাদের সেই সেবার আওতায় নিয়ে আসাটাই লক্ষ্য, প্রযুক্তি এখানে সেই লক্ষ্যে পৌঁছার উপায় মাত্র। কাজেই এজেন্টদের সবার আগে মানবিক হতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে- সামাজিক পিরামিডের পাটাতনে অবস্থানকারী প্রান্তজনের কাছে একটি সেবা পৌঁছে দেওয়াটাই তাদের মূল কাজ। উল্লেখ্য, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং এখন প্রায় ১০ লাখ তরুণ উদ্যোক্তা এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তিনজন করে কর্মসংস্থান করলেও এরাই ৩০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে।

এ ছাড়া, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন এক কথায় অভাবনীয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে রিফাইনেন্সের মাধ্যমে হাজার হাজার নারী উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনও এ ক্ষেত্রে কাজ করছে। ই-কমার্স, এফ কমার্সের মাধ্যমেও তাদের উদ্যোক্তা হিসেবে বেড়ে ওঠার নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

একই সঙ্গে অর্থনীতিতে ‘উবারাইজেন’ ব্যাপক হারে ঘটছে। ‘উবার’, ‘সহজ’, ‘ও-বোন’সহ অসংখ্য ডিজিটাল পরিবহন উদ্যোগের ফলে যানজটে ভরা পুরো ঢাকা শহরে সাধারণ মানুষের যাতায়াতে খানিকটা স্বস্তি এসেছে। গত দুবছরে লাখ লাখ মানুষ ‘রাইড শেয়ার’ করেছেন। এক লাখেরও বেশি তরুণ এই রাইড শেয়ার অর্থনীতির সুবিধাভোগী হিসেবে কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঘরে ঘরে খাবার পরিবেশনাসহ কত কাজেই না এখন তরুণরা ব্যস্ত। ঢাকা শহর আজ ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে অর্থনীতির ‘হটস্পটে’ পরিণত হয়েছে।

এ বছর অর্থনীতিতে নবেল পুরস্কার প্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ পল রোমার বছর দুই আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ওসমানী মিলনায়তনে এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ একই সঙ্গে বেশি বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে এবং বৈষম্যও কমিয়ে রাখছে। এ ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি সরকারকে তরুণ প্রজম্মে র জন্য নতুন নতুন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির আহ্বান জানান।

গত ১০ বছর ধরেই বাংলাদেশ সরকার শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে সরকার। তাই এখন ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা পাচ্ছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় কারিগরি শিক্ষার হার এখনো অপ্রতুল। প্রচলিত শিক্ষার বাইরেও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আরও বড়ো মাপের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। আশার কথা সেই পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করা, গার্মেন্টস খাতকে সবুজ ও আরও কমপ্লায়েন্ট করা, আইসিটি খাতকে ‘দ্বিতীয় গার্মেন্টস’ খাতে পরিণত করা, টেকসই নগরায়ণের জন্য স্মার্ট পরিবহন, দ্রুত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর নির্মাণ সম্পন্ন করা, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি ও বেসরকারি সামাজিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, সরকার পরিচালনায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়িয়ে সুশাসন নিশ্চিত করা, সার্বজনীন পেনশন চালু করা, কর-ডিডিপি অনুপাত আরও বেশি হারে বাড়ানো এবং সর্বোপরি পুরো অর্থনীতিকে সবুজ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে ধাবিত করার উদ্যোগ আগামী দিনের সরকার যেন গ্রহণ করে সে প্রত্যাশাই করছি। সামনেই নির্বাচন। নিশ্চয় রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সিক্ত হয়ে সামাজিক শান্তি ও অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির নীতি-কৌশল গ্রহণ করে অর্থনৈতিক গণতন্ত্রায়ণের অভিমুখে দেশবাসীর আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজম্মে র চাওয়া-পাওয়ার দিকটি যেসব দলের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পায় সে প্রত্যাশাই করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে তরুণ প্রজম্ম কে আকর্ষণ করার মতো কর্মসূচি তাঁর দলের নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্ত করতে বলেছেন। আমার ধারণা অন্যান্য দলও তরুণদের কথা অগ্রাধিকারে রাখবে। কেননা, তরুণরাই যে আগামীর বাংলাদেশ।

লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর