শনিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

এইডস : প্রতিরোধই মূলমন্ত্র

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

এইডস : প্রতিরোধই মূলমন্ত্র

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস পালিত হয়। ১৯৮৮ সাল থেকে দেশে দেশে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উদ্দেশ্য এই রোগ সম্পর্কে জানা এবং এর প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পৃথিবীতে প্রায় ৪ কোটি মানুষ শরীরে এইডসের জীবাণু বহন করে চলেছেন এবং একে নিয়েই বেঁচে আছেন, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় ১ কোটি লোকের কোনো ধারণাই নেই যে, তাঁদের শরীরে এই ঘাতক ভাইরাসটি রয়েছে। তাই ২০১৮ সালের প্রতিপাদ্য ‘আপনার এইডস সম্পর্কে জানুন’। এইচআইভি ও এইডস কী? এইচআইভি মানে হচ্ছে হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েনসি ভাইরাস। আর এইডস একটি মাত্র রোগ নয়, এর পূর্ণনাম হলো অ্যাকোয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েনসি সিন্ড্রোম, যার অর্থ ‘অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ঘাটতির লক্ষণসমুহ’। এইচআইভি এমন এক ভাইরাস, যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করে দেয়। ফলে যে কোনো সামান্য রোগও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আবার কিছু কিছু রোগ যেমন মুখের ছত্রাক, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া ইত্যাদি ঘন ঘন হতে পারে যা যথাযথ চিকিৎসায়ও নিরাময় করা সম্ভব হয় না।

এইডসের লক্ষণ : প্রকৃতপক্ষে এইডসের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষণ নেই। দেশ ও স্থানভেদে এইডসের লক্ষণের পার্থক্য দেখা যায়। এইডসের কিছু সাধারণ লক্ষণ যেমন অনেকদিন বা বার বার জ্বর হয় কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, অতিরিক্ত অবসাদ, শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া, লিম্ফগ্রন্থি ফুলে ওঠা, শুকনো কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাড়ের জয়েন্টগুলো ফুলে থাকা, ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া যেমন যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, প্রস্রাবের প্রদাহ। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ডায়রিয়ার সমস্যা যা স্বাভাবিক চিকিৎসায় কোনোক্রমেই ভালো হয় না, দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা কমে যাওয়া, তীব্র মাথাব্যথা ইত্যাদি। তবে কারও মধ্যে এসব লক্ষণ দেখা দিলেই তার এইডস হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে, এসব লক্ষণ দেখা দিলেই বিলম্ব না করে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।

এইচআইভি কীভাবে ছড়ায় এবং কারা ঝুঁকিপূর্ণ : অসচেতনতা, সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব, সুস্থ জীবনের অনুশীলন না করাটাই এ রোগের প্রধান ঝুঁকি। সুনির্দিষ্টভাবে যেসব উপায়ে এইচআইভি ছড়াতে পারে তা হলো ১. এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত রোগীর রক্ত বা রক্তজাত পদার্থ অন্য কোনো ব্যক্তির দেহে পরিসঞ্চালন করলে। ২. আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক ব্যবহৃত টুথব্রাশ, সুচ, সিরিঞ্জ, ছুরি, ব্লোড বা ডাক্তারি কাঁচি সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত না করে অন্য কোনো ব্যক্তি ব্যবহার করলে। ৩. আক্রান্ত ব্যক্তির অঙ্গ অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে। ৪. এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে (গর্ভাবস্থায়, প্রসবকালে বা সন্তানের মায়ের দুধ পানকালে)। ৫. অনৈতিক ও অনিরাপদ বা কনডম ছাড়া যৌনমিলন করলে। সমকামী, বহুগামী ব্যক্তি এবং বাণিজ্যিক ও ভাসমান যৌনকর্মীর সঙ্গে অরক্ষিত যৌনমিলনের মাধ্যমে। ৬. যুবসমাজের মধ্যে নেশার আধিক্য এবং একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে বার বার মাদকদ্রব্য গ্রহণ। ৭. এইচআইভি আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিবিড় ভৌগোলিক অবস্থান, দীর্ঘ সীমান্ত এলাকা এবং এভাবেই বিভিন্ন দেশে আসা-যাওয়ায় উপরোক্ত উপায়ে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। শ্রমিক অভিবাসন ও মানব পাচারের ফলে এইডস আক্রান্ত জনগণের দেশে গমনাগমন এ রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ৮. সর্বোপরি এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা ও তথ্যের অভাবে রোগটি ছড়ানোর ঝুঁকি থাকে।

মনে রাখতে হবে, কোনো লক্ষণ প্রকাশ না করেও এ ভাইরাস শরীরে বছরের পর বছর সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে এবং এ সময় অন্যকেও সংক্রমিত করতে পারে। কারও শরীরে এইচআইভি আছে কিনা তা বাইরে থেকে অনেক সময় বোঝা যায় না। শুধু সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে এ ভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাই দেখা যায় অনেকে নিজের অজান্তেই এ ভাইরাস বহন করে চলেছেন এবং রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

এইচআইভি কীভাবে ছড়ায় না : কিছু কিছু বিষয়ে অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি থাকে এইডসের বিস্তার নিয়ে। যেসব ক্ষেত্রে এইচআইভি ছড়ানোর সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তা হলো

* বায়ু, পানি, খাদ্য, মশা, মাছি বা পোকামাকড়ের কামড়ে।

* এইডস রোগীর ছোঁয়ায় বা স্পর্শে, হাঁচি, কাশি, থুথু বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, করমর্দন, একই ঘরে বসবাস, মেলামেশা, চলাফেরা ও খেলাধুলা করলে।

* আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত পায়খানা, বাথরুম, বেসিন, থালাবাসন, গ্লøাস, বিছানা, বালিশ ইত্যাদি ব্যবহার করলে।

* এইডস রোগীর চিকিৎসায় কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীরাও ঝুঁকিমুক্ত।

* হাসপাতালে এইডস আক্রান্ত ভর্তি রোগীর আশপাশে অন্য রোগীদের ছড়ানোর ঝুঁকি নেই।

এইচআইভি প্রতিরোধে করণীয় : একবার আক্রান্ত হয়ে গেলে এর থেকে নিস্তার পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। তাই এইচআইভি সংক্রমণের উপায়গুলো জেনে এর প্রতিরোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এইডস প্রতিরোধে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তা হলো ১. প্রয়োজনে অন্যের রক্ত গ্রহণের আগে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কিনা পরীক্ষা করে নেওয়া। ২. অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও অবশ্যই এইচআইভি পরীক্ষা করে নিতে হবে। ৩. ইনজেকশন নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবারই নতুন সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার করা এবং অন্যের ব্যবহৃত সুচ বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা। ৪. অনিরাপদ যৌন আচরণ থেকে বিরত থাকা, যৌন মিলনের সময় অবশ্যই কনডম ব্যবহার করা। ৫. এইচআইভি বা এইডস আক্রান্ত মায়ের সন্তান গ্রহণ বা সন্তানকে বুকের দুধ দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।  ৬. ধর্মীয় অনুশাসন যথাযথভাবে মেনে চলা। ৭. জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রতিরোধমূলক তথ্য নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন ও এইডস প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

উপসংহার : এইচআইভি সংক্রমণ শুধু একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা নয় বরং আক্রান্ত ব্যক্তির ওপর সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক ও মানসিক প্রভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের দেশে এইচআইভি ও এইডসের মাত্রা এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে কম। তবে আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থান, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের অনেকেই এইচআইভি আক্রান্তের ঝুঁকির তালিকায় রয়েছেন। এইচআইভি নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার লক্ষ্যে প্রতিরোধ ও চিকিৎসা কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসন কঠোরভাবে পালন করা উচিত। পারিবারিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইতিবাচক মনোবৃত্তির পরিচর্যা, উন্নত মননশীলতা এবং সুকুমারবৃত্তির অনুশীলন একান্তই জরুরি। নারী বা পুরুষ, যে কোনো মানুষের শরীরে এইচআইভি পাওয়া গেলে তাকে ভয় পাওয়া, ঘৃণা করা বা তার কাছ থেকে দূরে থাকা উচিত নয়। তার প্রতি সমবেদনা জানানো, যত্ন করা ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। রোগটি ঘৃণার হলেও ব্যক্তি তো আর কোনোক্রমেই ঘৃণার পাত্র নয়। তাই শরীরে এইচআইভি শনাক্ত হলে কাউন্সেলিংয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ এ কথা সত্য, এইচআইভি পজিটিভ হলেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটবে না, তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একজন রোগী দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারবেন। রোগীর আশা ও আত্মবিশ্বাস এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি। এইচআইভি নির্মূলে সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার কার্যকর ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। সবশেষে পুরনো প্রতিপাদ্যের সুরে বলতে হয়, আসুন ঐক্যের হাত তুলি, এইচআইভি প্রতিরোধ করি। এইচআইভি প্রতিরোধে জানা ও শোনার বিকল্প নেই, একে নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করার জন্য কাজ করতে হবে আমার, আপনার, আমাদের সবার।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর