মঙ্গলবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

মালদ্বীপে চীনা আধিপত্য ও নির্বাচন

অধ্যাপক ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক

মালদ্বীপে চীনা আধিপত্য ও নির্বাচন

মালদ্বীপ প্রজাতন্ত্র, উত্তর-মধ্য ভারত মহাসাগরে অবস্থিত স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্র। প্রায় ১ হাজার ২০০ ছোট-বড় কোরাল দ্বীপ নিয়ে গঠিত এ দেশের প্রায় ২০০ দ্বীপে জনবসতি রয়েছে। জনসংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। সাবেক রাষ্ট্রপতি নাশিদ যখন আবদুল্লাহ ইয়ামিনের কর্তৃত্ববাদী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারতকে আহ্বান জানান তখন বিশ্বের দৃষ্টি আর্কষিত হয়। চীন ইয়ামিনের সরকারের পক্ষে দাঁড়ায়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মালদ্বীপ সরকারকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়। বিরোধী দলের ঐক্যজোটের নেতা সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে মালদ্বীপ সফরের মাধ্যমে ভারত এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশ মালদ্বীপের পক্ষে আছে, এটাই মূলত প্রদর্শন করেছেন। প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছর আগে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে মানুষ মালদ্বীপে বসতি স্থাপন করে। তারা ছিল বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। তথ্যমতে, ১১৫৩ সালে মালদ্বীপের জনগণ ইসলামের অনুসারী হয়ে যায়। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, ১৫৫৮ থেকে ১৫৭৩ পর্যন্ত পর্তুগিজরা মালদ্বীপে দখল বজায় রাখে। সপ্তদশ শতাব্দীতে ডাচ শাসকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এই দ্বীপপুঞ্জ এবং এরপর ১৭৯৬ সালে ব্রিটিশ শাসনাধীনে চলে যায়। ঔপনিবেশিক আমলে এ দেশটি সুলতানের শাসনাধীনে থাকে।

সুলতান ঔপনিবেশিক প্রভুদের নির্দেশনা মেনেই চলতেন। ১৯৬৫ সালে মালদ্বীপ ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ১৯৬৮ সালে আবার প্রজাতন্ত্র গঠিত হয়। ১৯৭৬-এর ২৯ মার্চ ব্রিটিশ সৈন্য মালদ্বীপ ত্যাগ করে। এ দিনটি মালদ্বীপে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে। ইবরাহিম নাসির দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৭৮ সালে মামুন আবদুল গাইয়ুম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ছয়বার নির্বাচিত হয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন থাকেন।

২০০৮ সালে নতুন সংবিধান অনুযায়ী বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংবিধান রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে। পার্লামেন্ট ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ২০০৮ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে মোহাম্মদ নাশিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন এবং মামুন আবদুল গাইয়ুমের ৩০ বছরের শাসনের অবসান হয়। এক কক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের নাম জনতার মজলিস, যা কমপক্ষে বছরে তিনবার অধিবেশনে বসে। মন্ত্রিপরিষদে উপরাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীগণ ও অ্যাটর্নি জেনারেল অন্তর্ভুক্ত। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত। রাষ্ট্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে নাশিদ প্রথম দফায় নির্বাচনে বেশি ভোট পেলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম জয়লাভ করেন। প্রসঙ্গত, ইয়ামিন, মামুন আবদুল গাইয়ুমের সৎভাই। বন্দী অবস্থায় নাশিদের বিচার করে ২০১৫ সালে ১৩ বছর সাজা দেওয়া হয়। ২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় এবং সেখান থেকে তিনি শ্রীলঙ্কায় যান। মালদ্বীপের জনগণ মালদ্বীপীয় নৃ-গোষ্ঠীর লোক যারা বিভিন্ন সময় দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে। যারা তামিল ও সিংহলি জনগোষ্ঠীর লোক, কয়েক শতাব্দী ধরে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্র, মালয়, মাদাগাসকার, ইন্দোনেশিয়া ও চীন থেকে লোকজন আসা-যাওয়া করেছে। সরকারি ভাষা ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার অন্তর্ভুক্ত এবং দিবেদি নামে পরিচিত। হিন্দি, আরবি ও ইংরেজির প্রচলন আছে। মালদ্বীপের অর্থনীতি একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতি যা মাছ ও পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। এটা দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। কারণ পর্যটন ও মাছ উৎপাদনের দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু জিডিপি ১৯ হাজার ২০০ ডলার, গড় আয়ু ৬৮ বছরের মতো। আরব আমিরাত, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। নৌকা বিভিন্ন দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম এবং নৌপথে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও সিঙ্গাপুরের সঙ্গে সংযুক্ত। রাজধানী মালেতে বিমানবন্দর রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে জাতীয় বিমান সংস্থা। সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধীদলীয় প্রার্থী ইবরাহিম মোহাম্মদ সোলিহ নির্বাচিত হন।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংস্থার পক্ষ থেকে অবিলম্বে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া সব রাজবন্দীর মুক্তিরও আহ্বান জানানো হয়েছে। সোলিহ ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ইয়ামিন পান ৪২ শতাংশ ভোট। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৫ সালের নির্বাচনে শ্রীলঙ্কার চীনাপন্থি সরকারের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে গঠিত জোট জয়লাভ করে। মালয়েশিয়ার নির্বাচনেও বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে চীন কর্তৃক প্রদত্ত অর্থের প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসে। মাহাথির সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে এর অনেক বন্ধ করে দেয়। দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ভারত মহাসাগর ও আরব সাগরের সংযোগস্থলে হওয়ায় বিশ্বের নৌপথের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে চীন এ দেশকে ব্যবহার করে তার নৌবাহিনী ও বাণিজ্যিক পথ সম্প্রসারণ করতে চাচ্ছে।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারতের পক্ষ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। এটা মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম সোলিহ বলেছেন, তিনি বিশ্বশক্তিসমূহের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করবেন এবং ভারতের সঙ্গে যে সুসম্পর্ক ছিল তা পুনরায় স্থাপন করবেন। তিনি এও বলেছেন, ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তা বজায় রাখার ব্যাপারে পাশের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। সাম্প্রতিককালে মালদ্বীপে একনায়কতত্ত্ববাদী ইয়ামিন সরকারের অগণতান্ত্রিক ও মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডের ফলে অনেকেই নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এমনকি তিন দশক ধরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন যে মামুন আবদুল গাইউম তাকেও অন্তরিন থাকতে হয়েছিল। নির্বাচনের পর তিনি এক প্রচারমাধ্যমের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। এ সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি বিগত দিনের ঘটনাবলি ও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় মালদ্বীপের কী করণীয়, সে ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, মালদ্বীপের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভারত ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে এবং স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ব্যাপারে নতুন সরকার অবশ্যই সচেতন থাকবে। তিনি এও বলেন, রাষ্ট্রপতি আবদুল্লাহ ইয়ামিন মালদ্বীপের অনেক ক্ষতি করেছেন, তবে গণতান্ত্রিক শক্তি জয়যুক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত, ১৯৮৮ সালে গাইউম সরকারকে হামলার মাধ্যমে উৎখাতের চেষ্টা করলে সরকারের আহ্বানে ভারত হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যগতভাবে মালদ্বীপ ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, ইয়ামিন ক্ষমতায় থাকার জন্য মালদ্বীপে ফেব্রুয়ারিতে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং বহু বিরোধী নেতাকে অন্তরিন রাখা হয়। এর মধ্যে তার সৎভাই সাবেক রাষ্ট্রপতি মামুন আবদুল গাইউমও ছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইয়ামিন ও তার সহযোগীরা নির্বাচনে বিরোধী পক্ষ কারচুপি করেছে বলে অভিযোগ করেন এবং সুপ্রিম কোর্টেও এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। গাইউম আরও বলেন, ভারত অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারের সঙ্গে মিলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি ভারতকে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, মালদ্বীপের ভৌগোলিক প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। তিনি মনে করেন নতুন সরকার সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই কাজ করবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান উপলক্ষে মালদ্বীপ সফর করেছেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ বার্তাই দেওয়া হয়েছে যে, মালদ্বীপের নতুন সরকারকে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারত সমর্থন করে। মালদ্বীপের অন্য প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে। রাষ্ট্রপতি মাত্রিপালা সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহকে অপসারণ করে চীনাপন্থি হিসেবে পরিচিত মাহিন্দ্র রাজাপক্ষের হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। বিক্রমসিংহের নেতৃত্বাধীন জোট সিরিসেনার এ পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। স্পিকার ও সুপ্রিম কোর্ট বিক্রমসিংহের জোটের আইনানুগ পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়েছে। আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক শক্তিও এর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে বিক্রমসিংহ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া।

চার দেশের এই কূটনৈতিক জোটকে অনানুষ্ঠানিকভাবে কোয়াড বলা হয়। সিঙ্গাপুরে দেশ চারটির বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের এক বিবৃতিতে মালদ্বীপের নতুন সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয় এবং শ্রীলঙ্কা গণতান্ত্রিক রীতির প্রতি সম্মান জানাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। নরেন্দ্র মোদি তার বার্তায় বলেছেন, নতুন মালদ্বীপ সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন কার্মকান্ডে ভারত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা, সংযোগ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন অন্যতম। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক দেশগুলো সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা করবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।

                লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদত

সর্বশেষ খবর