শিরোনাম
বুধবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

প্যারিসে ঘাড় ফেরালেই বাংলা ভাষা...

আতাউর রহমান

প্যারিসে ঘাড় ফেরালেই বাংলা ভাষা...

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জেনারেল চার্লস দ্য গল (De Gaulle : 1870-1970) এতটাই দীর্ঘকায় ছিলেন যে তিনি যখন দেশের ভিতরে ও বাইরে সরকারি সফরে যেতেন, তখন রাতযাপনের প্রয়োজন হলে হয় তার জন্য স্পেশাল খাট তৈরি করা হতো না হয় তার শোবার খাট উড়োজাহাজ -বাহিত হয়ে তার সঙ্গেই যেত। আর রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তিনি নাকি দুটো খুব মজার মন্তব্য করে গেছেন ক. রাজনীতিবিদরা মনিব হওয়ার জন্য সেবক সাজেন খ. যা বলেন তা তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন না বিধায় একজন রাজনীতিবিদের কথায় যখন লোকেরা বিশ্বাস করে তখন তিনি খুবই বিস্মিত হন।

সে যা হোক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই হিটলার ১৯৪০ সালে ফ্রান্স দখল করে নিলে দ্য গল বিজিতের বেশে লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করেন এবং ১৯৪৪ সালে হিটলারের পতনের পর বিজেতার বেশে প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। যেন ঠিক তদ্রুপ ১৯৭৮ সালের শীতার্ত জানুয়ারি মাসে আমরা অর্থাৎ আমি ও আমার সঙ্গী সহকর্মী-বন্ধু ফরাসি ভাষায় ব্যুৎপত্তি না থাকার কারণে প্যারিস পরিত্যাগ করে ভিসি শহরে আশ্রয় নিয়েছিলাম এবং সেখানকার ‘কাবিলামে’ সাড়ে তিন মাস ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স সমাপন করে যখন প্যারিসে ফিরে এলাম, তখন মনে হলো চার্লস দ্য গলের মতো বিজেতার বেশে প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করলাম।

তদ্দিনে ফরাসিদের জীবনযাত্রা ও আচার-আচরণের অনেকটাই আমাদের জানা হয়ে গেছে। সব কথা লিখতে গেলে সাতকাহন হয়ে যাবে। তবে কিছু কথা না লিখলেই নয়।

প্রথম কথা হলো, আমরা বাঙালিদের সঙ্গে ফরাসিদের বেশকিছু মিল পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মতো ওরাও অনেকটা অলস, আড্ডাবাজ ও পলিটিক্সপ্রিয় জাতি। অফিস-আদালতে বিনা নোটিসে হঠাৎ অনুপস্থিতির বিশ্বখ্যাত পরিভাষা হচ্ছে ফ্রেঞ্চ লিভ এবং অহেতুক কথাবার্তা বলতে আমাদের মতো ওরাও ওস্তাদ। গল্প আছে : রাত আড়াইটার সময় দুই ফরাসি নার্সের গল্পগুজবে হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীর ঘুম ভেঙে গেলে তিনি যখন অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন তখন তাদের একজন বলে উঠল, আমরা কাজের কথা আলাপ করছি, মঁসিয়ো। এটা বন্ধ করলে আপনার চিকিৎসা হবে কীভাবে?

আরেকটি ব্যাপারেও আমরা ও ফরাসিদের মধ্যে বেশ মিল পরিলক্ষিত হয়। আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যম পুরুষে যেমন আপনি ছাড়াও তুমি ও তুই আছে (যেটা ইংরেজিতে নেই), ফরাসি ভাষায়ও তেমনি ভু (আপনি) ও তু (তুমি) আছে এবং ওগুলোর ব্যবহারবিধিও আমাদের মতোই। আর আমাদের দেশের যে অঞ্চল থেকে আমি আগত, সেখানে সচরাচর ‘ক’ উচ্চারিত হয় ‘খ’-এর মতো (যেমন ‘কথা’ উচ্চারিত হয় ‘খতা’) তেমনিভাবে ফরাসি ভাষায় ‘জ’ অক্ষরের উচ্চারণ অনেকটাই ‘খ’-এর মতো। আমার ওই সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটা তাই ওখানে খুব কাজে লেগে গেল। ভৈরব থেকে আগত আমার সহকর্মী-বন্ধু কিংবা আরবীয়রা ফরাসিদের সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে যখন বলত ‘বন্জুর’ তখন ওরা ড্যাবড্যাব চেয়ে থাকত। আমি যখন বলতাম ‘বঁজুখ’ তখন ওরা বলত ‘মেথ্না সাভা’; অর্থাৎ ‘এখন ঠিক আছে’।

অবশ্য ফরাসিদের সম্পর্কে বলা হয়, ওরা নাকি কঞ্জুস। ‘কঞ্জুস’ কথাটা বলতে মনে পড়ে গেল আমাদের দেশের জনৈক কঞ্জুস ব্যক্তি মৃত্যুকালে তার পুত্রকে বলেছিলেন, আমার অবর্তমানে আমার বন্ধু কটু মিয়ার কাছে বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য যেও। তো এক রাতে পুত্রধন পিতৃবন্ধুর বাড়িতে পরামর্শের জন্য গেলে কটু মিয়া কক্ষের বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে দিয়ে বললেন, কথা বলতে তো আর বাতির প্রয়োজন নেই, বাতিটা নিভিয়ে রাখি। কথা শেষে বন্ধুপুত্র চলে যাওয়ার সময় হলে কটু মিয়া বাতি জ্বালাতে উদ্যত হতেই সে বলে উঠল, ‘দাঁড়ান, আগে আমি লুঙ্গিটা পরে নিই। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না; তাই ওটা বেশিদিন টিকবে বলে খুলে রেখেছিলাম। এটা শুনে কটু মিয়া বললেন, ‘বাবা! তুমি বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য আমার কাছে এসো না, প্রয়োজনবোধে আমিই তোমার কাছে যাব।’ তা টাকাকড়ির ব্যাপারে ফরাসিরা কঞ্জুস কিনা তা বলতে পারব না; তবে তাদের শব্দভাণ্ডার ও শব্দ প্রয়োগের বেলায় কথাটা বললে বোধকরি খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। আপেলের ফরাসি হলো ‘পম’; আলুর জন্য আলাদা শব্দ তৈরি না করে ওরা আলুকে বলে ‘পম দ্য তেখ্’ অর্থাৎ ‘ভূমির আপেল’। অনুরূপভাবে লাঞ্চ তথা মধ্যাহ্নভোজনকে ফরাসিতে বলা হয় ‘দেজুনে’; ব্রেকফাস্ট তথা প্রাতরাশের জন্য আলাদা শব্দ তৈরি না করে ওরা বলে ‘পেতি দেজুনে’, অর্থাৎ ‘ক্ষুদ্র মধ্যাহ্নভোজন’। উদাহরণ আর বাড়িয়ে লাভ নেই।

আর ফরাসিরা খুব ভোজনরসিকও বটে। পরিচিত কেউ খেতে বসছে দেখলে ওরা বলবে ‘বন আপেতি’, অর্থাৎ (তোমার) খুব ক্ষিধা হোক; আর লোকটি খাওয়ার পরে শেষ কথা বলবে, জো সুই কন্তা; অর্থাৎ ‘আমি কনটেনটেড তথা পরিতৃপ্ত’। তা ছাড়া খাবারের মধ্যে ওদের প্রিয় বস্তু হলো এক ধরনের লম্বা পাউরুটি, যেটাকে ওরা ‘বাগেট’ বলে। ওটা আত্মরক্ষার্থেও ব্যবহার করা যেতে পারে, কিংবা বাস থেকে অবতরণকালে ওটা দিয়ে সহযাত্রীদের গুঁতো দিয়ে অবতরণের পথও পরিষ্কার করা যেতে পারে। ওদের অন্য প্রিয় খাবার হচ্ছে ‘ফ্রমাজ’ তথা পনির, যেটা অসংখ্য ধরনের হতে পারে। এমনকি প্যারিসের একটি দোকানে নাকি বছরে ৩৬৫ কিসিমের পনির পাওয়া যায়। আশ্চর্যের কিছুই নয় যে প্রেসিডেন্ট দ্য গল নাকি একদা বলেছিলেন, ‘যে জাতি ৩৬৫ ধরনের পনির তৈরি করে সে জাতিকে একত্রীভূত করা যায় না।’

ফরাসিদের বিয়েবহির্ভূত যৌন আচরণও বিশ্ববিশ্র“ত যে কারণে দুর্মুখেরা বলাবলি করেন, ফ্রান্সের প্যারিসে স্ত্রী নিয়ে যাওয়া আর ইংল্যান্ডের নিউক্যাসেলে কয়লা নিয়ে যাওয়া একই কথা। আর এ সম্পর্কে একটি মজার গল্পও আছে : আমেরিকানদের প্রায় সবাই অভিবাসীদের বংশধর বিধায় ফরাসি লেখক পল বুর্জে একবার আমেরিকান হাস্য-সম্রাট মার্ক টোয়েনকে বলেছিলেন, একজন আমেরিকানের জীবন কখনো একঘেয়ে হতে পারে না। অন্য কিছু করার না থাকলে সে তার দাদা কে ছিলেন, তা নিয়ে গবেষণা করে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিতে পারে। প্রত্যুত্তরে মার্ক টোয়েন বলেন, ‘এই সুবিধাটুকু একজন ফ্রেঞ্চম্যানেরও আছে; অন্য কিছু করার না থাকলে সে তার প্রকৃত পিতা কে, তা নিয়ে গবেষণা করে অনেকটা সময় পার করে দিতে পারবে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ফরাসিরা মনে করেন, ওরা আর কোনো দিক থেকে না হোক অন্তত আর্ট ও কালচারের দিক থেকে পৃথিবীতে সবচেয়ে উন্নত। ওদের এবংবিধ মনোভাব বহুলাংশে সঠিক কেননা প্যারিস হচ্ছে বিশ্বের তাবৎ শিল্পীর তীর্থস্থান। আমাদের চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন ও কালিদাস কর্মকার, মূকাভিনেতা পার্থপ্রতিম মজুমদার আর অধুনা প্রয়াত ভাস্কর নভেরা আহমদের কথাই ধরা যাক না কেন। প্রসঙ্গত, ষাট দশকের প্রারম্ভে আমরা যখন মফস্বল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলাম তখন পাবলিক লাইব্রেরির বারান্দায় নভেরা আহমদের বিবিধ ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছিল। ওগুলো দেখে ও পরে হাসনাত আবদুল হাই সাহেবের ‘নভেরা’ শীর্ষক উপন্যাসটি পড়ে তাকে স্বচক্ষে দেখার খুব আগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু প্যারিসে অবস্থানকালে শত চেষ্টায়ও দুর্ভাগ্যক্রমে তা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।

যাকগে। ফরাসিরা সচরাচর আইন-কানুন মেনেই চলেন, আমাদের মতো নয়। তবে কিছু ছোটখাটো ব্যাপারে যেমন গাড়ি পার্কিং, ড্রাইভিং এবং কোথায় ব্ল্যাডার খালি করা যাবে আর কোথায় যাবে না ইত্যাদি ব্যাপারে ওরা প্রায়শই আইন মানতে চান না। তো এ প্রসঙ্গে একটি মজার গল্পও মনে পড়ে গেল : ফরাসি মেয়েটি মোটরওয়েতে ফ্রি লিফটের আশায় দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজ যুবক গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, সে গাড়ি থামিয়ে ইংরেজিতে প্রশ্ন করল, ‘ডু ইউ ওয়ান্ট এ লিফট তুমি কি লিফট চাও?’ মেয়েটি ফরাসিতে জবাব দিল, ‘উই-উই’ (oui), অর্থাৎ ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ’। ছেলেটি বুঝল ইংরেজি ‘উই’ (wee), যদ্বারা বিলেতে ইতর বুলিতে প্রস্রাব করা বোঝায়। তাই সে তড়িঘড়ি গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘নট্ ইন্ মাই কার আমার গাড়িতে না, প্লি­জ!’

সেও থাকগে। প্যারিসে দর্শনীয় স্থান ও বস্তুর অভাব নেই। যাতায়াত ব্যবস্থাও খুব উন্নত ও তুলনামূলকভাবে সস্তা। ‘মেট্রো’ তথা প্যারিসের পাতালরেল পৃথিবীতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ এবং ওটা সাধারণ প্যারিসবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের এতটাই অবিচ্ছেদ্য অংশ যে ‘মেট্রো-ব্যুরো-দোদো’, এ তিনটি শব্দ দ্বারা বোঝানো যেতে পারে। একজন প্যারিসবাসী সকালে মেট্রোয় চড়ে ব্যুরো তথা কাজের জায়গায় যায় আর বিকালে আবার মেট্রোয় চড়ে বাসায় ফিরে ঘুমায়। আর ‘দোদো’ শব্দটি এসেছে ফরাসি ‘দখ্মিখ্’ নিদ্রা যাওয়া থেকে। অন্যদিকে প্যারিসে আমাদের প্রশিক্ষণ ছিল খুব পরিশ্রান্তিকর। তবু সুযোগ করে আর্ক দ্য ট্রায়াম্ফ, নটর ড্যাম ক্যাথেড্রাল, মমার্ত, আইফেল টাওয়ার, লুভর মিউজিয়াম, ভার্সাই প্রাসাদ ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে পরিদর্শন করা হলো।

আইফেল টাওয়ার হচ্ছে প্যারিসের আইকন। গুস্তাভ আইফেল যখন এ টাওয়ারের চূড়ায় বসে প্যারিস নগরীর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন তখন কি তিনি ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিলেন যে আগাপাশতলা একটা স্টিলের স্ট্রাকচার কেবল শৈল্পিক অন্তর্দৃষ্টির কারণে একদিন নান্দনিকতা ও ট্যুরিস্ট আকর্ষণের বস্তুতে পরিণত হবে। তা আইফেল টাওয়ার দেখার পর গেলাম লুভর মিউজিয়াম পরিদর্শনে। এখনব্ধি প্রবেশপথে এখনকার বিশাল গ্লাস-ফাইবারের তৈরি পিরামিড প্রস্তুত হয়নি। লুভর মিউজিয়াম পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও সেখানের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ হচ্ছে লিওনার্দ দ্য ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার চিত্র। লিওনার্দ চিত্রটার নাম দিয়েছিলেন ‘লা জোকান্ড’ এবং মডেলের নাম ছিল মোনালিসা। অথচ কী আশ্চর্য, মডেলের নামেই চিত্রকর্মটি বিখ্যাত হয়ে রইল! বুলেট-প্র“ফ গ্লাসের আধারে রক্ষিত মোনালিসার সামনেই ছিল দর্শনার্থীর ভিড় সবচেয়ে অধিক। মোনালিসাকে ঘুরেফিরে যতবারই দেখা যাক না কেন, তৃপ্তি যেন মেটে না এবং বৃহৎ শিল্পকর্মের গুণই হলো তাই। একবার নাকি এক দর্শনার্থী মোনালিসার দিকে ঢিল ছুড়ে মেরেছিলেন; কেননা তার মনে হয়েছিল মোনালিসা বুঝি তাকে ভেংচাচ্ছে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, চিত্রকর্মটি সম্পাদনের সময় মোনালিসা নাকি ছিলেন সন্তানসম্ভবা, যে কারণে তার মুখের হাসি এতই রহস্যময় তথা বিভ্রান্তিকর।

আরেকদিন গেলাম প্যারিসের উপকণ্ঠে অবস্থিত ভার্সাই প্রাসাদ পরিদর্শনে। সুবিশাল ও সুসজ্জিত বাগান পরিবেষ্টিত ঐতিহাসিক প্রাসাদটিতে প্রবেশ করে হাজারো দর্শনার্থীর ভিড়ে সম্রাট ষোড়শ লুই ও সম্রাজ্ঞী মেরি আঁতোয়ার সুশোভিত শয্যাকক্ষ অতিক্রমকালে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ইতিহাসের বইতে পড়া সেই উপন্যাসটি : প্রাসাদের বাইরে রাস্তায় ম্যাংগো পাবলিক তথা আমজনতাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করতে দেখে সম্রাজ্ঞী তার দেহরক্ষীদের কারণ জিজ্ঞাসা করায় জবাব এলো, ‘ওরা রুটি খেতে পাচ্ছে না, ইওর ম্যাজেস্ট্রি’। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, ‘তাহলে তারা কেক খায় না কেন?’ কী বাস্তববিবর্জিত চিন্তা-ভাবনা! তাই তো স্বামীসহ গিলোটিনের নিচে প্রাণ দিতে হলো।

পূর্বাহেœই বলা হয়েছে, সে যাত্রায় ফ্রান্সে ছিলাম সাকল্যে সাড়ে সাত মাস। প্রায় দুই দশক পরে প্যারিসে প্রত্যাবর্তনপূর্বক সর্বাগ্রে যে জিনিসটা নজরে এলো, তা হলোÑ আগে ফরাসিরা ইংরেজি ভাষাটা জানলেও বলতে চাইত না, কিন্তু এখনকার অবস্থা ভিন্ন। কেননা ওরা বিচার-বিশ্লে­ষণ করে দেখেছে যে, ওদের বার্ষিক রেভিনিউ বাজেটের বিরাট অংশ আসে পর্যটন খাত তথা ইংলিশ-স্পিকিং ট্যুরিস্টদের কাছ থেকে। বিশেষত আমেরিকানদের সারা জীবনের স্বপ্ন হলো জীবনে অন্তত একবার হলেও প্যারিসটা ঘুরে আসা। ফরাসিরা আমাদের মতো নয়, তাই দেশের স্বার্থেই অহমিকা ভুলে ইংরেজিকে অধিকতর প্রাধান্য দিচ্ছে। এমনিতেও একটা চটকদার কথা আছে যে, একজন আমেরিকান মারা গেলে তার আত্মা নাকি প্যারিসে মাইগ্রেট করে।

এরপর যা নজরে এলো, তা হলো প্যারিসে বাঙালির আধিক্য, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের ভাষায় ‘স্বদেশী ভাই, সিলট্যা-নোয়াখাল্যা’। আটাত্তরে প্যারিসে স্বদেশীর সাক্ষাৎ পেতে হলে দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হতো, পঁচানব্বইয়ে পয়েন্টে পয়েন্টে বাঙালির জটলা; আর বর্তমানে, আত্মজের বর্ণনামতে, ঘাড় ফেরালেই বাংলা তথা মাতৃভাষা কর্ণকুহরে প্রবেশ করে। আমাদের এক প্রাচীন কবি লিখেছিলেন, ‘(বাঙালিরা) হেলায় লংকা করিল জয়’। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা তাই-ই ঘটেছে বলতে হবে। জয় হোক বাঙালির সর্বত্র!

নিবন্ধটি শেষ করতে যাচ্ছি ফরাসি স্টাইলে। ফরাসিরা বিদায় নেওয়ার কালে যা বলে তা শোনায় ‘আভওয়া’; কিন্তু আসলে ওরা বলে ‘অ রিভায়াখ’ (Au revoir), এর অর্থ হচ্ছে ‘পুনর্দর্শন পর্যন্ত (বিদায়)’। অতএব আমিও ‘আভওয়া, মঁসিয়ো এ মাদাম’, এটা বলে বিদায় নিচ্ছি।

লেখক : রম্য সাহিত্যিক সাবেক মহাপরিচালক, ডাক বিভাগ।

সর্বশেষ খবর