শনিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

আসন্ন নির্বাচন ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক ড. মেসবাহউদ্দিন আহমেদ

আসন্ন নির্বাচন ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে খুব আশার কথা এটাই যে, নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলই উৎসব আমেজে নির্বাচনে রয়েছে। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে এ ধরনের উৎসবমুখর অংশগ্রহণ মোটেই সহজ কথা নয়। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রনায়কোচিত মনোভাবের কারণে।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নাগরিকের মৌলিক অধিকার ভোটাধিকার। এ অধিকার প্রয়োগ করেই জনগণ তাদের সমর্থন জানাবে পছন্দের আদর্শের প্রতি। গণতন্ত্রের এই শান্ত-স্নিগ্ধ পথযাত্রায় কেউ জয়ী হবেন, কেউ হবেন পরাজিত। এ পরাজয় মেনে নিতে চায় না বলেই আমরা শাসকদের বার বার গণতন্ত্র হত্যা করতে দেখি। আবার ক্ষমতার মসনদ পেতে অনেককে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠতে দেখি। বন্দুকের নলের দ্বারস্থ হতে দেখি। ক্ষমতায় টিকে থাকতে, বিরোধী কণ্ঠ চিরতরে রোধ করতে জঙ্গিদের ওপর ভর করতে, এমনকি ঘৃণ্য গ্রেনেড হামলা পর্যন্ত আমরা চালাতে দেখেছি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সয়ে গণমানুষের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়তে লড়তে সফল রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হওয়া শেখ হাসিনা আজ আমাদের কাছে বিস্ময়। সত্যিকার অর্থেই বিধাতা যেন তাকে জাতির পিতার অসম্পূর্ণতাকে সম্পূর্ণ করতে পাঠিয়েছেন। তিনি আজ তারই দেওয়া গণতন্ত্রের পরীক্ষায় অবতীর্ণ। ষড়যন্ত্রীরা কিন্তু আজও থেমে নেই। জঙ্গি, রাজাকার, মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী চক্রসহ সব অপশক্তিই যে উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে হটিয়ে দিতে একতাবদ্ধ হয়েছেন তা আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি। দৃশ্যত চোখের সামনেই তারা বের করে দিয়েছেন তাদের রক্তমাখা দাঁত। তাই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তির এখন দায়িত্ব অনেক। এখন কোনো অভিমান নয়, অপশক্তির কোনো মধুর বাক্যে ভুলে যাওয়া নয়। মনে রাখতে হবে একবার হোঁচট খেলে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে ক্ষুধাতুর হায়েনারা। উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকে আর দেওয়া হবে না। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে মানবতা লাঞ্ছিত হচ্ছে বার বার। মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা-বিরোধী শক্তি সমগ্র বাংলাদেশে আজও ওত পেতে আছে সুযোগের অপেক্ষায়। ইতিহাসের যে জঘন্যতম বর্বরোচিত কালো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তী সময়ে, মনে পড়ে কি তার কথা। সেই লোমহর্ষক নারকীয় তা-ব। সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ, সম্পত্তি থেকে উচ্ছেদ, সম্পদ লুণ্ঠন, জোরপূর্বক চাঁদা আদায়, শারীরিক নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মতো অসংখ্য ঘটনায় তখন মানবতা ছিল ভূলুণ্ঠিত। সেদিন পরাজিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল নির্মম, পাশবিক ও হিংস্র আক্রোশের শিকার। প্রতিটি সহিংস ঘটনা ছিল চরম বেদনাদায়ক ও অসহনীয়। অপরাধীদের কোনো জবাবদিহি ছিল না, নির্বিকার ছিল প্রশাসন।

প্রসঙ্গত বলতে হয়, ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। পরাজিত হয় বিএনপি-জামায়াত। ২০০১ সালের নির্মমতার অভিজ্ঞতায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সহিংসতা সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি অমূলক ছিল না। কিন্তু জাতি উৎকণ্ঠিত ও শঙ্কিত হলেও নির্বাচনে বিজয়ী প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতা, সহনশীল আচরণ ও সেমতে তার নির্দেশ বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীদের সংযত করেছে। জাতি তাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। সেদিন শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা, আন্তরিকতা, প্রজ্ঞা ও সহনশীলতা গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য এক অনুকরণীয় শিক্ষা।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলনীতি হিসেবে ভিত্তি করে ১৯৭২ সালের সংবিধান রচিত হওয়ায় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা মৌলিক চার নীতির অন্যতম নীতি হওয়ায় বাংলাদেশে চমৎকার এক উজ্জ্বল অসাম্প্রদায়িক ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বার বার সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আঘাত হেনেছে। আর গণতন্ত্রের নেত্রী শেখ হাসিনা বার বারই সেই কূপ থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছেন। জাতিকে সম্মানের জায়গায় তুলে এনেছেন। দেশকে নিয়ে এসেছেন উন্নয়নের ধারায়।

একটি রাষ্ট্র কতটুকু সভ্য, আধুনিক এবং জনগণের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি কতটা দায়বদ্ধ তার পরিচয় পাওয়া যায় সে দেশের সংবিধানে। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায় এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদের দায় নিশ্চিত করে সংবিধান। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় রাষ্ট্রের দর্শন সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয় উল্লেখ থাকায় তা নিঃসন্দেহে সংবিধানকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধানের মর্যাদা দিয়েছে। অথচ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কাছে তা অসহ্য এবং অপছন্দের ছিল।

একাত্তরের পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ইতিহাসের জঘন্যতম রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও বিকৃত মানসিকতার ঘৃণ্যতম উদাহরণ সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড। এ জঘন্যতম হত্যাকান্ডের পর দেশ প্রগতির ধারার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক ধারায় আবর্তিত হতে থাকে। সংবিধানেও লাগানো হয় কলঙ্কের দাগ। স্বাধীনতার মূল চেতনাগুলো ভূলুণ্ঠিত ও পদে পদে বিকৃতির প্রয়াস চলে। সদম্ভে আত্মপ্রকাশ ঘটে সামরিকতন্ত্রের। পশ্চাদপদ নীতি অনুসৃত হতে থাকে। সেখান থেকে দেশকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে জাতির জনকের কন্যা লড়াই শুরু করেন। বলতে দ্বিধা নেই, যোগ্য হাতে পড়েই দেশ আজ উন্নয়নধারায়। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা না করা গেলে দেশ আবার অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাবে, তাতে সন্দেহ নেই। তাই এ নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিকদের দায়িত্ব অনেক।

মনে রাখতে হবে, স্বাধীন বাংলাদেশের ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী ইসলামের প্রকৃত চেতনায় নয় বরং বিকৃতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নির্বাসিত হওয়ার কারণেই তারা সুযোগটি গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার অশুভ বিষ ছড়িয়েছে।

অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে মানবাধিকার রক্ষা করার অঙ্গীকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা রোধ এবং কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য বা নিপীড়ন রোধ করার বিষয় নিশ্চিত করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৭-এ উল্লেখ আছে, ‘দেশের সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮-এ বর্ণিত, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী, পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ ৩২ অনুচ্ছেদে ‘ব্যক্তি জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো নাগরিককে বঞ্চিত করা যাইবে না’ মর্মে উল্লেখ আছে।

সংবিধানের এসব অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতরূপে সংরক্ষিত হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, ভয়ভীতিমুক্ত নির্বাচন পরিচালনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে আমাদের স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। রাষ্ট্র আজ নির্বাচন কমিশনকে সে স্বাধীনতা দিয়েছে। বলা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে এটিও একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদাহরণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে দৃঢ় ও আন্তরিক। গণতন্ত্রের এই অগ্রযাত্রাকে সমুন্নত রাখতে হলে জঙ্গিবাদমুক্ত  অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন। পুলিশ প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনের নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার বিষয়টি সাংবিধানিক দায়। অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা সর্বজনীন ভোটাধিকারের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের সক্রিয় ও সময়-উপযোগী আইনানুগ প্রশাসনিক উদ্যোগই পারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়নির্বিশেষে দেশের সব ভোটারকে নিরাপদ, সহিংসতা ও শঙ্কামুক্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করতে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে জাতি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও শঙ্কামুক্ত নির্বাচন প্রত্যাশা করে। এবার কোনো অপশক্তি যেন ভোটের পরিবেশ বিনষ্ট না করতে পারে তার জন্য অবশ্যই প্রশাসনিক সকল পর্যায়েই সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

যে কথাটি না বললেই নয়, বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি এখন দৃশ্যমান বিষয়। দেশে ও বিদেশে কোথাও বলার প্রয়োজন পড়ে না, বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশ্বের অন্য মধ্য আয়ের ও উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল। তাই এখন বাংলাদেশের জন্য সব থেকে বড় বিষয় অর্থনীতির এই গতি ধরে রাখা। সামনে নির্বাচন। একটি নির্বাচন এলেই প্রশ্ন দেখা দেয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পরিবর্তন হতে পারে। যদি পরিবর্তন হয় তাহলে কি এই অর্থনৈতিক গতি ধরে রাখা সম্ভব হবে? সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে এগিয়ে নিতে আজ কোন পক্ষকে জয়ী করতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্তে আসতে হবে আমাদের।

একটা ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোনো আবেগে পড়ে ভুল ভোট দেওয়া হলে অনেক বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি পড়তে হতে পারে আমাদের। অর্থনৈতিক মুক্তির স্বাদ বাংলাদেশের মানুষ কেবল পেতে শুরু করেছে। নেতা নির্বাচন করতে ভুল করলেই থেমে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির এই গতিপ্রবাহ। ভোট দেওয়ার আগে একবার ভাবুন, আপনার ভোটটি সত্যিকার অর্থেই দেশের পক্ষে দিচ্ছেন কিনা।

আরেকটি কথা, আসছে জানুয়ারিতে যে সংসদের প্রথম অধিবেশন বসবে, সেই সংসদের আমলেই বাঙালি জাতি উদ্যাপন করবে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের, স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী। এমন একটি সময়ে জাতীয় সংসদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তিকেই আনা জরুরি নয় কি?

                লেখক : শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সর্বশেষ খবর