রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য খাত : বিশৃঙ্খলার মাঝেও বিপুল অর্জন

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

স্বাস্থ্য খাত : বিশৃঙ্খলার মাঝেও বিপুল অর্জন

আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ও কিছুটা অস্বস্তিকর এবং বিশৃঙ্খল অবস্থায় বিরাজমান। জনগণের মাঝেও ভয়-ভীতি, ক্ষোভ, এর সঙ্গে চিকিৎসক এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থার কমতি নাই। প্রায়ই সংবাদপত্রের পাতায় কিংবা টিভি খুললেই দেখা যায় ‘চিকিৎসা সেবা পাতালে’, ‘সেবার নামে বেহাল অবস্থা’, ‘অভিজাত হাসপাতালগুলো বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত’, ‘সরকারি হাসপাতালে বেহাল দশা’, ‘সাধারণ মানুষ জিম্মি’, ‘টাকা দিয়েও চিকিৎসা মেলে না’, ‘খোদ রাজধানীতেই অস্ত্রোপচার করলেন ভুয়া ডাক্তার, অপারেশন টেবিলেই রোগী রেখে পালালেন তিনি, ভুল চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ নষ্ট’ এসব চাঞ্চল্যকর অপ্রিয় সত্য কথা। রোগী বা জনগণের বিরাট অংশই ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি কমবেশি ক্ষুব্ধ। তাদের অভিযোগের পাহাড়, যেমন হাসপাতালে ভালোভাবে চিকিৎসা হয় না, ডাক্তার নার্স ঠিকমতো দেখে না, চিকিৎসকের উচ্চ ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কমিশন ও ওষুধ কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নানা উপঢৌকনের বিনিময়ে ওষুধ লেখা এবং অযথা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, রোগীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, এমনকি অনেকের দৃষ্টিতে ডাক্তাররা ‘কসাই’। অভিযোগগুলো অযৌক্তিক নয়, অনেকাংশেই সত্যও বটে। অন্যদিকে সুনামধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যাও কম, সরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীরা সহজে তাঁদের দেখা পান না, বাধ্য হয়ে সুচিকিৎসার আশায় যেতে হয় প্রাইভেট চেম্বারে। সেখানেও রোগীদের লম্বা লাইন। আবার বিশেষজ্ঞদের সিরিয়াল পেতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাঁদের অনেক রোগী দেখতে হয়, তাই প্রত্যেক রোগীকে যথেষ্ট সময় দিতে পারেন না। অনেকের অভিযোগ, বেশি টাকা ফি নিলেও অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর গায়ে হাত না দিয়েই বা কথা ভালোভাবে না শুনেই ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। এমনকি একগাদা ওষুধসহ অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেন, তাও আবার নিজের পছন্দসই ল্যাবরেটরিতে। তড়িঘড়ি করে দেখার ফলে চিকিৎসকের প্রতি রোগীরা অসন্তুষ্ট ও আস্থা রাখতে পারছেন না। সামর্থ্যবান রোগীরা চলে যাচ্ছেন বিদেশে। এ ছাড়া চিকিৎসার খরচও দিন দিন বেড়েই চলছে। হঠাৎ কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসার খরচ মিটাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। সরকারি হাসপাতালে খরচ কম হলেও অতিরিক্ত রোগীর চাপে এবং প্রয়োজনের তুলনায় সুযোগ-সুবিধা কম থাকায়, প্রত্যাশিত এবং সুষ্ঠু চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হয় না। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে চিকিৎসা খরচ আকাশচুম্বী, সেখানে চিকিৎসা নেওয়া অনেকেরই সামর্থ্যরে বাইরে। ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি, পরীক্ষার-নিরীক্ষার মানহীনতা, মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্টের ব্যবহার, প্রায়ই অনেক ল্যাবরেটরির বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্টের অভিযোগ, অদক্ষ টেকনিশিয়ান আর ভুয়া ডাক্তারের আধিক্য, এমনকি দালালদের দৌরাত্ম্যে রোগীরা দিশাহারা। মাঝে মধ্যেই দেখা যায় ম্যাজিস্ট্রেটসহ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিভিন্ন ল্যাবরেটরি, হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে অভিযান চালান, সঙ্গে সঙ্গে অনিয়মের দায়ে জরিমানাও করেন। কিন্তু তাতে অবস্থার পরির্বতন হয় না। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব ও প্রশাসনিক অদক্ষতায় ভরপুর, গ্রামে-গঞ্জে, উপজেলা, জেলা এমনকি বিভাগীয় পর্যায়েও, স্বাস্থ্যব্যবস্থার হ-য-ব-র-ল অবস্থা। সব মিলিয়ে সারা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার হতাশাজনক চিত্রটাই ফুটে ওঠে সর্বত্র।  স্বাস্থ্য খাতের অর্জন : কিন্তু অনেক সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের অর্জন একেবারে কম নয়, সফলতা অবশ্যই যুগান্তকারী। স্বাস্থ্যবিষয়ক সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর, প্রশংসিত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের আন্তরিকতার কমতি নাই। সীমাবদ্ধ সম্পদ, দারিদ্র্য, জনসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও বাংলাদেশের এই অর্জন অনুকরণীয়। দেশের সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার নেটওয়ার্ক। ‘১৬২৬৩’ নম্বর ব্যবহারের মাধ্যমে মোবাইল ফোনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদান এবং ৯৫টি হাসপাতালে টেলিমেডিসিন সেবা চালু হয়েছে। ২০১১ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। মজবুত অবকাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের মাত্রার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, যা উন্নয়নশীল অনেক দেশের জন্য মডেল। জনবল বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বাংলাদেশকে পোলিও এবং ধনুষ্টঙ্কারমুক্ত ঘোষণা, ওষুধের সরবরাহ বৃদ্ধি, উন্নত শিশু স্বাস্থ্যসেবা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের স্বাস্থ্য পরিসেবা ব্যবস্থা, চিকিৎসক ও নার্স নিয়োগ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের জন্য ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং টিকাদানে দৃষ্টান্তমূলক সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ৯৯ ভাগ উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবার উন্নয়নে আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, নতুন হাসপাতাল চালু ইত্যাদি উন্নয়নমূলক অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সরকার। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা এবং পুষ্টি (এইচপিএন) খাতে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। অন্য একটি কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের বিশেষ করে মহিলা, শিশু এবং সুবিধাবঞ্চিতদের স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেবাপ্রাপ্তির চাহিদা বৃদ্ধি, কার্যকর সেবাপ্রাপ্তি সহজলভ্য এবং স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেবাসমূহের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস, রোগের প্রাদুর্ভাব ও মৃত্যুর হার হ্রাস এবং পুষ্টিমান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর পর্যন্ত শিশুমৃত্যুর হার, এক বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যু হার, নবজাতক মৃত্যুহার এবং মাতৃমৃত্যু হার বিগত সময়ের তুলনায় অনেক কম, যার ফলে গড় আয়ু ৭২.৮-এ উন্নীত হয়েছে। মূলত স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবায় সরকারি সুবিধার উৎকর্ষের কারণেই এই অর্জন। বর্তমানে প্রায় ৯১.৩ শতাংশ শিশুকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। ১১টি টিকা দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় পুষ্টি পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৭% এ হ্রাস, পরিবার-পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীর হার ৬২.৪% এ উন্নীত, মোট প্রজনন হার বা মহিলা প্রতি গড় সন্তান জন্মদানের হার ২.০৫ এ হ্রাস পেয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আওতায় ৩২২ চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ‘১৬৭৬৭’ নম্বর ব্যবহার করে ‘সুখী পরিবার’ সেবায় প্রদান করা হচ্ছে পরিবার-পরিকল্পনা কার্যক্রম। কয়েক দফায় গত ১০ বছরে সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রায় ৫০০ অ্যাম্বুলেন্স প্রদান করা হয়েছে। দেশের সব স্থানে গর্ভবতী মায়েদের অ্যাম্বুলেন্স সেবা বিনামূল্যে প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজমকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সরকার কাজ করছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ে বহু হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সারা দেশে ১৩ হাজার ৭৭৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ১ হাজার ২৭৫টি ইউনিয়ন সাব সেন্টার এবং ৮৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অচিরেই আরও চার হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করা হবে। এ ছাড়া ‘কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট’ গঠন করা হয়েছে। টাঙ্গাইলের কালিহাতী, মধুপুর ও ঘাটাইলে অতি দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রাপ্তি সহজলভ্য করতে ‘শেখ হাসিনা হেলথ কার্ড’ বিতরণ শুরু। ৫০টি রোগের চিকিৎসার খরচ এই কার্ডের মাধ্যমে বহন করা হবে। পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বর্তমানে দেশে শতাধিক সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চালু রয়েছে। অনেক বিশেষায়িত হাসপাতালে বিনামূল্যে মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি, প্রসূতিসেবা, অর্থোপেডিক, চোখ, নাক-কান-গলা, হৃদরোগ, নবজাতক ও অপুষ্টিজনিত সেবার ব্যবস্থা রয়েছে। সংক্রামক ব্যাধি, কুষ্ঠ ও অন্যান্য রোগের জন্য ১৪টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ছাড়াও সব মেডিকেল কলেজ, জাতীয় হৃদরোগ, বিশেষায়িত এবং ১২টি জেলা হাসপাতালে সিসিইউর চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে। ক্যান্সার রোগীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউটে। এ ছাড়াও ১০টি বিশেষায়িত হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউট চালু এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়েছে। মোট ১৫ হাজার ৫৯৬ জন চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং নতুন নার্স নিয়োগ পেয়েছেন ১৫ হাজার। চিকিৎসকদের জন্য উচ্চশিক্ষার আসন বৃদ্ধি, নতুন কোর্স চালু, নার্সিং বিষয়ে পিএইচডি ও মাস্টার্স প্রশিক্ষণ, বিএসসি নার্সিংয়ের আসন সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি কোর্স চালুসহ দক্ষ জনবল তৈরিতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য ৭৫০টি আসন বাড়ানো হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে নতুন ১০ হাজার ৯৮৩ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। নতুন ১৩টি বেসরকারি হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজ, সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ২২৫ জন হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল অফিসার ও প্রভাষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন অনেক হাসপাতাল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে, যেমনÑশেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালের সম্প্রসারণ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডাইজেস্টিভ ডিজিজেস রিসার্চ অ্যান্ড হসপিটাল, বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে সরকারি হাসপাতালে রূপান্তর, জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, মুগদায় ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল, জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, কুর্মিটোলা ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, খুলনার আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, গোপালগঞ্জের শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল এবং এই হাসপাতালকে কেন্দ্র করে অনলাইন চক্ষুসেবা কার্যক্রম চালু করতে ‘ভিশন সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে। অনলাইনে মেডিকেল শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়া চালু, মেডিকেল শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে ‘ওভারসাইট কমিটি’ গঠন এবং সারা দেশে ২২ জেলায় ৪২১টি মডেল ফার্মেসি চালু করা হয়েছে। ২০১১ সালে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের পর বর্তমান সরকার জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬, মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-২০১৮ সহ নানাবিধ আইন কাঠামো প্রণয়ন, জাতীয় পুষ্টি পরিষদ গঠনের মাধ্যমে দেশে পুষ্টিসেবা জোরদার, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস প্রচলনের মাধ্যমে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্বারোপ, উচ্চতর স্বাস্থ্যশিক্ষায় নতুন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। ওষুধশিল্পে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। ইডিসিএলের নতুন প্লান্ট চালু করা হয়েছে। দেশেই ওষুধের কাঁচামাল তৈরির জন্য গজারিয়ায় এপিআই পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। এ পর্যন্ত ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওষুধ রপ্তানি হয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থারও উন্নতি হয়েছে যুগান্তকারী। আগে যেসব রোগে ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, আমেরিকার বিকল্প ছিল না, বর্তমানে এসব রোগের চিকিৎসা দেশেই হচ্ছে। বিভিন্ন জটিল ও ব্যয়সাধ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা যথেষ্ট কম খরচেই হচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাসহ শত শত অপারেশন সফলভাবে করা হচ্ছে। এমনকি কিডনি, লিভার ও বোনমেরো ট্রান্সপ্লান্ট, হৃদরোগের বাইপাস, রিং পরানো, চোখের লেন্স পরানো, নিউরোসার্জারিসহ অনেক আধুনিক চিকিৎসা উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেই হচ্ছে। নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। অপারেশন, সিসিইউ, আইসিইউ ও ডায়ালাইসিস সেবার ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্য নেওয়া হয়। সব সরকারি হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে ৩০ প্রকারের ওষুধ।

প্রক্রিয়াধীন প্রকল্প : অনেক প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন, যা দ্রুতই সম্পন্ন হলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার আরও যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। যেমন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণ, ঢাকা মেডিকেল কলেজকে পাঁচ হাজার শয্যায়, জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালকে ১৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, রাজধানীতে ৫০০ শয্যার অত্যাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল নির্মাণ, জাতীয় কিডনি হাসপাতাল, নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, অ্যাজমা সেন্টার ও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ। এ ছাড়াও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ ২০টি মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণ, সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী এবং ফরিদপুর মেডিকেলে বার্ন ইউনিট নির্মাণ। ৩৬টি জেলা হাসপাতাল ও ৩৪টি উপজেলা হাসপাতালের সংস্কার ও সম্প্রসারণ প্রকল্প। ১২টি উপজেলায় ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল নির্মাণ, ৯৭টি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ চলছে। ১০ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রণীত পাঁচ বছরমেয়াদি ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি’ ২০১৭-২২-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন হলে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন ঘটবে।  তিনটি জাতিসংঘ পুরস্কারসহ মোট ১৬টি আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও পুরস্কার অর্জন করেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত। গত ১০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট সাত গুণ বেড়ে ২৩ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা হয়েছে। নোবেল লরিয়েট ড. অমর্ত্য সেন ‘ল্যানসেট’ জার্নালে ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর লিখেছিলেন, ‘যাঁরা স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তাঁরা ভাবতেও পারেননি এই বাংলাদেশ একদিন ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সামনে এগিয়ে যাবে।’ শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত আশাতীতভাবে অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, চলমান প্রকল্পগুলোর সুষ্ঠু ও সঠিক সময়ে বাস্তবায়ন এবং ভবিষ্যতের সুচিন্তিত নতুন পরিকল্পনা এ অগ্রযাত্রার পথে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর