মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

লাউয়ে লাখপতি

শাইখ সিরাজ

লাউয়ে লাখপতি

পরিবর্তন কখনো একা আনা সম্ভব নয়। কিন্তু পরিবর্তনের শুরুটা করতে হয় একেবারে ব্যক্তিপর্যায় থেকে এবং অবশ্যই শুরুটাই সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কৃষির পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট খুব কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। দেখেছি এ দেশের কৃষক কীভাবে পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে ক্রমান্বয়ে এক এক করে নতুন নতুন কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। প্রয়োজনের তাগিদে নিজেই উদ্ভাবন করেছেন নানা প্রযুক্তি, কৃষিকৌশল। টেলিভিশনে ভিনদেশের কিংবা অন্য অঞ্চলের কোনো প্রযুক্তি বা কৌশলের সন্ধান পেয়ে নিজে নিজে একেবারে নিজস্ব উপায়ে তৈরি করে তা ব্যবহার করে সফল হয়েছেন। এমন উদাহরণ আমার কাছে প্রচুর আছে। কৃষি কৃষকের কাছে গভীর এক সাধনা। আমি বিশ্বাস করি, রাজিয়া খাতুন চৌধুরানীর সেই অমর বাক্য, ‘সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা।’

সম্প্রতি এক সফল কৃষকের সন্ধান পেলাম। মুন্সীগঞ্জের বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের মামাসার গ্রামের হাকিম দেওয়ান। যিনি টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠান দেখে প্রযুক্তি ও কৌশল নিজের কৃষিতে প্রয়োগ করে শুধু নিজের ভাগ্যই নয়, পাল্টে দিয়েছেন পুরো গ্রামের চিত্র। নভেম্বরের শেষ দিন ভোরে রওনা হলাম মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে। গন্তব্য মামাসার গ্রামের হাকিম দেওয়ানের কৃষি খেত। নভেম্বর ফুরিয়ে গেছে। ডিসেম্বর সমাগত। তার পরও শীতের ছিটেফোঁটাও টের পাওয়া যাচ্ছে না। হালকা কুয়াশার দেখা মিলল গ্রামের দিকটায় এসে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে আমাদের চিরচেনা ষড়ঋতু।

হাকিম দেওয়ানের কৃষি খেতে যখন পৌঁছালাম তখন পুবাকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সোনালি আভা ছড়িয়ে আভাস দিচ্ছে একটা উজ্জ্বল দিনের। হাকিম দেওয়ানের দেখা মিলল। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে। দেখেই বোঝা যায় খুব উদ্যমী এক মানুষ। মাথার ঝুড়িতে দশ-বারোটি লাউ নিয়ে তিনি খেতের আলে আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন। মাথা থেকে লাউয়ের ঝুড়িটা নামিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আমায়। বললেন, ‘আপনাকে সত্যি সত্যি দেখতে পাব কল্পনা করিনি। আল্লাহর কৃপায় আপনার অনুষ্ঠান দেখেই আমার দিন বদলেছে।’ পাঠক, কৃষক আমার অনুষ্ঠান দেখে উপকৃত হয়েছে, এ তথ্যটুকু জানার আনন্দের চেয়ে বড় আর কোনো আনন্দ আমার জীবনে নেই। আজ থেকে বছর আটেক আগেও হাকিম দেওয়ানসহ এ এলাকার কৃষকের আলুই ছিল প্রধান ফসল। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতির তীরবর্তী পলিবাহিত এ উর্বর এলাকা অপেক্ষাকৃত নিচু। অনেক জমিতেই বর্ষার পানি জমে থাকে। সাধারণত সেপ্টেম্বর, অক্টোবরে পানি নেমে যায়। পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে চাষ দিয়ে লাগানো হয় আলু। একদিন চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে দেখলেন দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন চাষ প্রক্রিয়া ভাসমান চাষ পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবেদন। আপনাদেরও নিশ্চয়ই মনে আছে। হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে বহুবার বিষয়টি তুলে ধরেছি। এর আগে নব্বই দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে প্রথম ভাসমান চাষ পদ্ধতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম। এরপর ভাসমান চাষ পদ্ধতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিবেচনায় দেশের একমাত্র ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করেছে। কৃষক হাকিম দেওয়ান টেলিভিশনে এ চাষ কৌশল দেখে তার পানি জমে থাকা নিচু জমিতে তা প্রথম অনুশীলন করেন। আশপাশের কৃষক তার কাজকর্ম দেখে তাকে পাগল ভাবলেন। তারা বললেন, ‘বরিশালের চাষ পদ্ধতি কি মুন্সীগঞ্জে চলবে?’ দমবার পাত্র নন হাকিম দেওয়ান। একাই কচুরিপানার গাদা তৈরি করে রোপণ করলেন লাউয়ের চারা। মাচা তৈরি করে শুরু করলেন নতুন কৃষি। প্রথমবারই সফলতা এলো। জলাবদ্ধ জমিতে তিনি ফলালেন লাভের লাউ। তার সাফল্য দেখে শুরু করলেন আরও অনেক কৃষক। মুন্সীগঞ্জের কৃষকের কাছে আলু চাষ যেন অভ্যাস। ঐতিহ্যের আচার। নেশার মতো। আলু চাষ তাদের দেয় ফসল ফলানোর গাঢ় তৃপ্তি। কিন্তু সেই অভ্যাসও পরিবর্তনে তারা ব্রতী হয়েছেন। কারণ আর কিছুই নয়, দিনের পর দিন আলুতে লোকসান গুনে তারা এখন নতুন ফসলের স্বপ্ন বুনছেন। যেমন এই বজ্রযোগিনীর আবাদি জমিগুলো আলুর পরিবর্তে ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে সাফল্যের লাউ। যে জমিগুলো আলু চাষের ফলে খড়ের রঙে গেরুয়া হয়ে থাকত, সে জমিগুলো এখন ছেয়ে আছে সবুজে। মাঠের পর মাঠ লাউয়ের মাচা। মাচায় ঝুলছে হাজার হাজার লাউ। এ অপরূপ দৃশ্য অভিভূত করে। মনে পড়ছে ময়মনসিংহের ভালুকার বেতবাড়ী গ্রামের তরুণ বাবুলের লাউ খেতের কথা। বছর দুয়েক আগের কথা। তরুণ উদ্যোক্তা বাবুল ২০ একর জমিতে লাউ চাষ করে সাড়া ফেলেছিলেন। হাকিম দেওয়ান এখন ১২০ একর জমিতে লাউ চাষ করছেন। শুধু হাকিম দেওয়ানই নন, কথা হয় সেখানকার বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তাদের একজন রাসেল মোহাম্মদ। তিনি জানালেন, এবার লাউ চাষ করেছেন ১৪০ একর জমিতে। দৈনিক লাউ পাচ্ছেন ১০০টির মতো। এভাবে তিন মাস লাউ পাবেন। প্রথম মৌসুমে প্রতিটি লাউ ৪০-৪৫ টাকা করে বিক্রি শুরু করেন। মৌসুম শেষেও এ দর থাকে ৩০-৩৫ টাকা। খেত থেকেই লাউয়ের এ দর পেয়ে খুশি কৃষক। লাউ চাষের ক্ষেত্রে রাসেল মোহাম্মদের হিসাবটা একেবারেই সহজ। ১৪০ একর জমিতে লাউ চাষ করতে তার খরচ হয় সাকল্যে দেড় লাখ টাকা। আর সেখান থেকে আয় আসে ৪ লাখ টাকার বেশি। চার মাসে এ আড়াই লাখ টাকার লাভ পাল্টে দিয়েছে তার জীবনযাপন, এমনকি ভবিষ্যতের স্বপ্নও। আর এক কৃষক ইয়াসিন আরাফাত এবার লাউ চাষ করেছেন ১৬০ একর জমিতে। তিনি বললেন, ‘আলুর চেয়ে লাউয়ে লাভ বেশি। শুধু ফলে নয়, পাতা থেকেও আয় আসে।’ সত্যি, মুন্সীগঞ্জের এই মামাসার গ্রাম যেন সমৃদ্ধ এক নতুন বাংলাদেশের বারতা দিচ্ছে। কৃষক এখন অনেক সচেতন। নিজেদের হিসাবটা ঠিকঠাক গুছিয়ে নিচ্ছে। আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে। নিজেই বেছে নিচ্ছে নিজেদের দিনবদলের হাতিয়ার, কলাকৌশল। মাঠেই উপস্থিত ছিলেন কৃষি বিভাগের উপসহকারী কর্মকর্তা সেলিম হোসেন। পাল্টে যাওয়া কৃষির বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি জানান, বজ্রযোগিনীর ৩৫ হেক্টর জমিতে হচ্ছে লাউয়ের আবাদ। আর এ থেকে কৃষক আলুর চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি লাভ পাচ্ছেন। সেলিম হোসেন হিসাব করে দেখালেন যেখানে ৩৫ হেক্টর জমি থেকে আলু চাষে পাওয়া যায় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা, সেখানে লাউ চাষ করে কৃষক পাচ্ছেন ৩ কোটি টাকার ওপরে। উপস্থিত কৃষকরাও তার কথায় সায় দিলেন।

কৃষিক্ষেত্রে বহুমুখী পরিবর্তন সাধন হচ্ছে। প্রতিনিয়তই পাল্টাচ্ছে কৃষির ধরন। নানামুখী গবেষণা, সম্প্রসারণের পাশাপাশি উন্নত বীজ কৃষকের হাতে পৌঁছে যাওয়ায় বদলে গেছে কৃষির হিসাব-নিকাশ। এ ক্ষেত্রে বলা বাহুল্য, গণমাধ্যমের প্রচারণাও দারুণভাবে প্রভাবিত করছে কৃষককে। কৃষক একদিকে যেমন সমৃদ্ধ হচ্ছে কৌশলগতভাবে, অন্যদিকে সচেতন হয়ে উঠছে নিজের অধিকার সম্পর্কেও। খুঁজে নিচ্ছে সেবা লাভের ক্ষেত্রগুলো। সম্ভাবনা বুঝেই বিনিয়োগে সাহসী ও আগ্রহী হচ্ছেন কৃষক। নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগে যথেষ্ট উৎসাহ ও আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে আজ। মুন্সীগঞ্জের কৃষিবৈচিত্র্য তারই এক সফল দৃষ্টান্ত। কৃষকের এ সাহসী উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে সময়োপযোগী সম্প্রসারণ সেবা ও বাজার সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এতে কৃষক তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে যেমন পৌঁছাতে পারবেন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবেন কৃষি অর্থনীতিতে।

                লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর