শনিবার, ৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

ইসলামের আদব কায়দা

মুফতি মাওলানা মো. এহছানুল হক মোজাদ্দেদী

ইসলামের আদব কায়দা

আমাদের প্রিয় নবী রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের জন্য আদব তথা শিষ্টাচারের সব নিয়মই শিখিয়ে গেছেন। তঁর শেখানো শিষ্টাচার তথা আদবের মধ্যে রয়েছে চলাফেরা, খাদ্য-পানীয় গ্রহণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, নিদ্রা, স্ত্রীর ভালোবাসা, দাম্পত্য জীবনের আদবসহ আরও অনেক বিষয়। এমনকি তিনি টয়লেটে যাওয়ার শিষ্টাচারও শিখিয়েছেন উম্মতকে। হজরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, ‘মুশরিকরা আমাদের বলে, এ কেমন কথা! তোমাদের নবী তোমাদের সব-কিছুই শিক্ষা দেন, এমনকি টয়লেটের নিয়মও! আমি বললাম, হ্যাঁ! তিনি আমাদের পায়খানা-প্রস্রাবের সময় কিবলামুখী অথবা কিবলা পেছনে দিয়ে বসতে নিষেধ করেছেন। ডান হাতে ঢিলা-কুলুপ ব্যবহার, তিনটির কম পাথর ঢিলা হিসেবে ব্যবহার অথবা হাড় কিংবা গোবর দিয়ে ঢিলা ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।’ মুসলিম। আসুন, কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলামের শিষ্টাচার সম্পর্কে কিছু কথা জেনে নিই।

ইসলাম সমাজে সালামের মাধ্যমে একে অন্যকে অভিবাদন জানানোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। এর ফলে পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্ব বৃদ্ধি পায়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা ততক্ষণ জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ইমান আনয়ন কর এবং ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না পরস্পর পরস্পরকে ভালোবাস। আমি কি তোমাদের এমন কিছু বলে দেব না যা করলে তোমরা পরস্পরকে ভালোবাসতে পারবে? তোমরা পরস্পরের মধ্যে সালামের প্রসার  কর।’ মুসলিম। কেউ যদি কাউকে সালাম দেয় তার জবাব দেওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তোমরা সালাম ও অভিবাদনপ্রাপ্ত হও, তখন তোমরা তার চেয়ে শ্রেষ্ঠতর সম্ভাষণ কর অথবা একইভাবে অভিবাদন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব বিষয়ে হিসাব গ্রহণকারী।’ সূরা নিসা, আয়াত ৮৬। ইসলাম  বলেছে কে কাকে সালাম করবে। এ বিষয়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘একজন আরোহী পথচারীকে, একজন পথচারী বসা ব্যক্তিকে এবং ছোট দল বড় দলকে সালাম করবে।’ মুসলিম। সালামের পর আসে কালাম তথা কথার প্রসঙ্গ। এ সম্পর্কেও প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিষ্টাচার শিখিয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেকের উচিত পরিষ্কার-ভাবে কথা বলা, যেন শ্রোতা তার বক্তব্য বুঝতে পারে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা এতটাই পরিষ্কার ও শ্রুতিমধুর ছিল যে, তাঁর কথা বুঝতে কারও কোনো অসুবিধা হতো না।’ আবু দাউদ। বক্তা ও শ্রোতা উভয়েরই মুখের চেহারা এবং কথাবার্তা যেন তৃপ্তিকর ও আনন্দদায়ক হয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা কোনো নেক কাজকেই হেলাফেলা করো না, যদিও তা হাসিমুখে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করা হয়।’ মুসলিম। তিনি আরও বলেছেন, ‘মানবদেহের প্রতিটি জোড়ের জন্য সদকা রয়েছে। দুজন লোকের মধ্যে ন্যায়বিচার করা একটি সদকা; কাউকে বাহনে আরোহণ করায় সহযোগিতা করা অথবা তার ও তার সামগ্রী তুলে দেওয়া একটি সদকা; উত্তম কথা বলাও একটি সদকা; ফরজ নামাজের জন্য মসজিদের পথে প্রতিটি কদম একটি সদকা এবং পথ থেকে কোনো কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে দেওয়াও একটি সদকা।’ বুখারি।

ইসলাম ঘরে প্রবেশের আদব সম্পর্কে বলেছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে অনুমতি না নিয়ে এবং তাদের সালাম না দিয়ে প্রবেশ করো না।’ সূরা নূর, আয়াত ২৭। ‘তোমাদের সন্তানরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে তারাও যেন অনুমতি প্রার্থনা করে, যেমন তাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা করে।’ সূরা নূর, আয়াত ৫৯। এর উদ্দেশ্য হলো, মানুষের নিরাপত্তা ও ঘরের গোপনীয়তা রক্ষা করা। একটি ঘটনা : ‘এক ব্যক্তি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে উঁকি মারে। সে সময় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে একটি দাঁতন ছিল যা দিয়ে তিনি মাথা চুলকাচ্ছিলেন। তিনি তাকে বললেন, যদি আমি দেখতাম তুমি উঁকি মেরেছে, তাহলে আমি এটা দিয়ে তোমার চোখ ফুঁঁড়ে দিতাম। অবশ্যই অনুমতি নেওয়া খুব জরুরি, যেন কেউ অন্য কারও গোপন কিছু দেখে না ফেলে।’ বুখারি। নাছোড়বান্দার মতো অনুমতি চাইতেই থাকা ঠিক নয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তিনবার অনুমতি প্রার্থনা করা উচিত। যদি অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে ভালো, অন্যথায় তার ফিরে যাওয়া উচিত।’ মুসলিম। খাওয়া-দাওয়ার আদব সম্পর্কে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে ডান হাতে খাও এবং নিজের সামনে থেকে খাও।’ বুখারি। তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষ পেটের চেয়ে খারাপ কোনো পাত্র পূরণ করে না। মানুষের জন্য কয়েক গ্রাস খাবার খাওয়াই যথেষ্ট যা দ্বারা সে নিজের পৃষ্ঠদেশ সোজা রাখতে পারে। আর যদি তাকে বেশি খেতেই হয় তাহলে সে যেন পেটের এক-তৃতীয়াংশ খায়, এক-তৃতীয়াংশ পান করে এবং এক-তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য ফাঁকা রাখে।’ তিরমিজি। পাত্রের মধ্যে শ্বাস ত্যাগ করা বা ফুঁঁ দেওয়া নিষেধ। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাত্রের মধ্যে শ্বাস ত্যাগ করতে বা ফুঁঁ দিতে নিষেধ করেছেন। আবু দাউদ। এমনিভাবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিষ্টাচার কী হবে তা হাতে কলমে শিখিয়ে গেছেন। এসব মেনে চললে আমাদের দুনিয়ার জীবন যেমন ইমানের আলোয় আলোকিত হবে তেমনি আখেরাতেও সুন্নাহর আলোয় তাঁর সঙ্গে সরাসরি জান্নাত নসিব হবে। আল্লাহ কোরআন-সুন্নাহর অনুসরণে আমাদের সেই রাজভাগ্য দান করুন।

লেখক : এমফিল গবেষক, মুফাসসিরে কোরআন, বেতার ও টিভির ইসলামবিষয়ক উপস্থাপক; খতিব, মণিপুর বাইতুর রওশন জামে মসজিদ, মিরপুর, ঢাকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর