মঙ্গলবার, ৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

দুদিন আগে আর পরে সবাই এভাবে চলে যাবে

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

দুদিন আগে আর পরে সবাই এভাবে চলে যাবে

মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের বড় ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আর ইহজগতে নেই। কর্মজীবনের সার্থকতা যদি জানাজায় লোকসমাগম দেখে বিচার করা হয় তাহলে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সংসদের দক্ষিণ প্লাজার জানাজায় অভাবনীয় লোক হয়েছিল। সৈয়দ আশরাফ সব সময়ই কিছুটা ভিন্ন ছিলেন। সদালাপী, মৃদুভাষিতা ছিল তার সারা জীবনের পরিচিতি। আগাগোড়া ছাত্রলীগ করেছেন। সব আন্দোলনে সব সময় লতায় পাতায় মিলেমিশে ছিলেন। আজকাল তেমন কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য না থাকলেও পাকিস্তান আমলে ময়মনসিংহের দারুণ আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। ’৬৯ সালে মহকুমা থেকে টাঙ্গাইল জেলায় উন্নীত হয়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ টাঙ্গাইল মহকুমাকে জেলার মর্যাদা দিয়েছিল অনেক আগেই সেই ’৬২-৬৩ সালে। সেবার সম্মেলনে গিয়েছিলেন তখনকার দিনে পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ যুবাদের অহংকার ছাত্রদের হৃদয়ের স্পন্দন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণিসহ আরও বেশকিছু নেতৃবৃন্দ। টাঙ্গাইল রওশন টকিজে ছাত্র সম্মেলনের পর আমাদের গরিবখানায় খাবার খেয়ে বিকালে পুলিশ প্যারেড ময়দানে জনসভা করে বাসে চেপে নেতারা ঢাকা ফিরেছিলেন। সেই সময় অর্থ ছিল না, বিত্ত ছিল না, কিন্তু চিত্ত ছিল ভরপুর। সেই থেকে টাঙ্গাইলের রাজনীতি উত্তরে ময়মনসিংহের দিকে না গিয়ে দক্ষিণে ঢাকার দিকে প্রসারিত হয়। লতিফ সিদ্দিকীর হাতে গড়া প্রিয় কর্মী শাজাহান সিরাজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। শুধু সাধারণ সম্পাদক নন, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন জনাব শাজাহান সিরাজ। বর্তমানে অবক্ষয়ের জমানায় অনেক সত্যকে আড়াল করে রাজনীতি, সমাজনীতি সবকিছু দুর্বার গতিতে চলছে। কিন্তু বর্তমানের নেশা কেটে গেলে ভাবীকালে ইতিহাসের পাতায় অনেক কিছুই স্থান পাবে না, আবার বহু কিছু স্থান পাবে। ময়মনসিংহের সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে সৈয়দ আশরাফের ব্যাপারও তাই। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা অভাবনীয়ভাবে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত বিপথগামী কয়েকজনের হাতে নিহত হন। সেই থেকে সৈয়দ আশরাফ প্রায় ২০-২২ বছর লন্ডনে ছিলেন। যুক্তরাজ্য স্থানীয় সরকারের শিক্ষা বিভাগে একটা চাকরি করতেন। ’৮৯-৯০ সালে লন্ডনে তার বাড়িতে বেশ কয়েকবার গেছি। উত্তর প্রদেশের লক্ষ্নৌর শিলা নামের একটি মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাদের ঘরে এক মেয়ে। আমি যখন লন্ডনে গিয়েছিলাম তখন সে কেবলই হাঁটাচলা করত, আলতো আলতো কথা বলত। আসলে মানুষ স্বাভাবিক থাকলে তার মধ্যে দুর্বার সহমর্মিতা থাকে। সৈয়দ আশরাফের মধ্যেও ছিল। আমরা সেই ছোটবেলা থেকে পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম। আমার বাবা সৈয়দ আশরাফের মাকে মা বলে ডাকতেন। আর আমার বাবার কোনো সম্বোধন ঠুনকো শুকনো পাতার মতো ছিল না যে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবে। আমার বাবার সম্পর্ক ছিল দারুণ দৃঢ়। বাবা ‘মা’ বলে ডাকতেন বলে আশরাফের মা আমাদের দিদা। আমরা কেউ আমাদের দাদিকে দেখিনি। সেই অর্থে আশরাফের মা-ই ছিলেন আমাদের প্রকৃত দাদি। অন্য ভাইবোনেরা তার কাছে কতটা আদরযত পেয়েছে জানি না, কিন্তু আমি তার কাছে অপরিসীম যত্ন পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে তারা যখন কলকাতায় তখন কতবার দাদু নজরুল ইসলামকে তিনি বলতেন, ‘তোমরা কলকাতায় নিরাপদে আছো। আমার নাতিকে এনে দাও।’ আগস্টের আগ পর্যন্ত মুজিবনগর সরকার আমার সম্পর্কে অন্ধকারে ছিল। কিন্তু ৯ আগস্ট যমুনার মাটিকাটায় পাকিস্তানি হানাদারদের দুটি জাহাজ কাদেরিয়া বাহিনী দখল করে নিলে সারা দুনিয়ায় আমাদের প্রতিরোধের খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আমাদের একটা দৃঢ় যোগাযোগ হয়। সেই যোগাযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেপ্টেম্বর থেকে দাদু সৈয়দ নজরুল ইসলাম দিদাকে বার বার বলতেন, ‘তোমার নাতিকে নিয়ে আর চিন্তা করো না। তাকে আমাদের নিরাপত্তা দিতে হবে না। সে শুধু তার নিজের নিরাপত্তা নয়, তার অঞ্চলের মানুষদের নিরাপদে রাখতে রাতদিন লড়াই করে চলেছে।’

আজ সৈয়দ আশরাফ নেই কত কথা মনে পড়ে। ছাত্র আন্দোলনে কতবার কত জায়গায় দেখা হয়েছে কত কিছু একসঙ্গে করেছি কখনো দ্বিমত হয়েছে কখনো আবার একমত। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-জামালপুর-শেরপুর-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা পুরো অঞ্চলেই এক প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। শুরুতেই প্রতিরোধটা পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহকারী অধিনায়ক কে এম শফিউল্লাহ। কে এম শফিউল্লাহর জন্য দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রথম দিকে তেমন গর্ব করার মতো বেশি কিছু করতে পারেনি। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে যেমন প্রথম ১৪ সৈন্য অস্ত্রসহ বেরিয়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাফেলায় শরিক হয়েছিল তেমনি জয়দেবপুর-টঙ্গীর রাস্তায় ব্রিগেডিয়ার আরবারের জয়দেবপুর গিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অস্ত্রহীন করার অভিযানে জনসাধারণ যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল সে প্রতিরোধ ভেঙে দেওয়ার জন্য শফিউল্লাহর নির্দেশে বাঙালি সৈন্যদের গুলি চালাতে বাধ্য হতে হয়েছিল। জনাব শফিউল্লাহ ২৮ মার্চ জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে ময়মনসিংহ গিয়েছিলেন। তিনি যেখান দিয়েই গেছেন সুনামির মতো আমাদের সব প্রতিরোধ ভেঙে তছনছ করে গেছেন। শক্তি প্রয়োগ করে নয়, আমরা এবং আমাদের নেতৃবৃন্দ তাকে ভরসা করতেন তাই যাওয়ার পথে তিনি যা বলেছেন তাই পালন করতে গিয়ে আমরা সেদিন সব খুইয়েছিলাম। টাঙ্গাইলে তেমন সংগঠন গড়ে ওঠার আগেই সেখান দিয়ে জনাব শফিউল্লাহ পার হয়ে গিয়েছিলেন। তাই টাঙ্গাইল তেমন এলোমেলো না হলেও ময়মনসিংহ তছনছ হয়ে গিয়েছিল। কত কষ্ট করে ময়মনসিংহ ছাত্র-জনতা খাগডোহরের ইপিআর ক্যাম্প দখল করেছিল। ইপিআর-পুলিশ-আনসার নিয়ে প্রায় ১০-১৫ হাজারের বাহিনী গড়েছিল। একজন মেজর হিসেবে শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ পৌঁছলে সবাই তাকে সশস্ত্র নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি বুঝে বা না বুঝে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সবাইকে তো সঙ্গে নিয়েছিলেনই উপরন্তু পুলিশ-ইপিআর এবং অবসরপ্রাপ্ত আর্মিদের নিয়ে রেলে ভৈরবের পথ ধরেছিলেন। ময়মনসিংহকে বলেছিলেন, তিনি ওই পথে ঢাকা আক্রমণে যাচ্ছেন। পরিণামে তা হয়নি। হয়েছিল অন্য রকম। ভৈরব সেতু পার হয়ে আখাউড়া ও সিলেটের চা বাগান এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন।

হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল প্রবেশ করে ৩ এপ্রিল। অপরিকল্পিত এক প্রচণ্ড যুদ্ধ হয় পাকুল্যা-সাটিয়াচরাতে। যেখানে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমাদের ১৫-২০ জন শহীদ হন, পাকিস্তান হানাদারদের ক্ষতি হয় অভাবনীয়। কারণ তারা কোনোরকম আক্রমণ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত ছিল না। অতর্কিত আক্রমণের কারণে তারা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। যুদ্ধ শুরু হয়েছিল বেলা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। পাকুল্যা থেকে টাঙ্গাইল ১২ মাইল আশপাশের সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে টাঙ্গাইল পৌঁছতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। টাঙ্গাইল ঢুকেই তারা সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান খান, আহ্বায়ক লতিফ সিদ্দিকী ও উপদেষ্টা আসাদুজ্জামান খানের বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। আমরা ৩ এপ্রিল পর্যন্ত টাঙ্গাইল শহরেই ছিলাম। দুপুরের পর কিছু অস্ত্র নিয়ে গ্রামে পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ি। নেতৃবৃন্দ কে কোথায় সব ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। চর-ভর-পাহাড় ঘোরাফেরা করে এক পর্যায়ে ময়মনসিংহ তারপর সেখান থেকে উত্তরের সীমানা হালুয়াঘাট পর্যন্ত গিয়ে বিফল হয়ে ফিরে আসি। কড়ইতলী থেকে হালুয়াঘাট ফেরার পথে হঠাৎই সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে দেখা। এলাকার অবস্থা কী, সেখানে কী হচ্ছে এসব টুকিটাকি কিছু আলাপ-আলোচনা করে চলে এসেছিলাম। ওর পর পদ্মা-মেঘনা-যমুনার পানি অনেক দূর গড়িয়ে যায়। হঠাৎই সেপ্টেম্বরের ১০-১২ তারিখ সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে তুরাতে দেখা। আমি যাচ্ছিলাম তুরা থেকে তেলঢালা জিয়াউর রহমানের ট্রেনিং ক্যাম্পে, আশরাফ আসছিল মানকারচর থেকে তুরাতে এমপি, এমএনএদের ক্যাম্পে। যুদ্ধের সময় আর দেখা হয়নি। আমিও চার-পাঁচ দিন পর দেশে ফিরেছিলাম। আমার ১০-১২ দিনের জন্য সীমান্তে যাওয়ার কারণ ছিল হানাদারদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে হাতে পায়ে লাগা গুলির চিকিৎসা করা। তাই করেছিলাম। ওর পরে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গভবনে সৈয়দ আশরাফকে দেখি। এরপর মাঝেমধ্যেই দেখাশোনা হয়েছে। অনেক অনুষ্ঠানে পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ’৮৯-৯০-এর দিকে লন্ডনে গিয়েছিলাম। আমার লন্ডন যাওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সে সময় সাজেদা চৌধুরী গিয়েছিলেন লন্ডনে। অন্যদিকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ও অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান গিয়েছিলেন। লন্ডনে আওয়ামী লীগের সমর্থক বাঙালিরা আমাকে পেয়ে ভীষণ উজ্জীবিত হয়েছিল। তারা এক বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। আশাতীত লোক হয়েছিল। তখন নাকি ১০০-২০০ লোক হলে বিরাট সমাবেশ। আমাদের সেই সংবর্ধনায় দুই-আড়াই হাজারের ওপর লোক হয়েছিল। সৈয়দ আশরাফ অতটা সক্রিয় ছিলেন না বলে সামনে শ্রোতাদের আসনে বসেছিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। উদ্যোক্তাদের বলে তাকে মঞ্চে এনে দু-কথা বলে সেখানে আসন দিয়েছিলাম। সে তো ছিল আগের কথা। পরে তিনি মন্ত্রী হয়েছেন, হয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সৈয়দ আশরাফের স্ত্রী শিলা ইসলামের মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার বেইলি রোডের বাড়ি গিয়ে টাঙ্গাইলের শাড়ি উপহার দিয়েছিলাম। তিনি লক্ষ্নৌর মানুষ। আমার স্ত্রীও লক্ষ্নৌর শুনে বাসায় আসতে চেয়েছিলেন। সে আসা আর হয়নি। হঠাৎই শিলা ইসলামের মৃত্যু সংবাদ পাই। তারপর আস্তে আস্তে আশরাফের শারীরিক অবনতি ঘটে। কয়েক মাস কোনো সরকারি কাজও করেননি। তারপর লন্ডনে, সেখান থেকে ব্যাংককে আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে পরপারে চলে গেছেন। সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ৬ জানুয়ারি সাড়ে ১০টায় তার নামাজে জানাজা হয়েছে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের জানাজায় শামিল হয়েছিলাম। এক দারুণ শূন্যতা নিয়ে জানাজা থেকে ফিরেছি। এই নশ্বর পৃথিবী থেকে সবাইকে দুদিন আগে আর পরে বিদায় নিতে হবে। তবু আমরা কত মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি করি। এক মুহূর্তের জন্যও ভাবী না, আমিও একদিন এভাবেই পৃথিবী থেকে চলে যাব। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বার বার প্রার্থনা করেছিলাম- হে আল্লাহ রব্বুল আলামিন! আপনি তার সব পাপ ক্ষমা করে তাকে বেহেশতবাসী করুন।

                লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর