বুধবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

শুধু একটি ছবি, একটি মুজিবকোট

অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত

শুধু একটি ছবি, একটি মুজিবকোট

খুব হিংসা হয়। নিজের ওপর অভিমান বা ঘৃণা হয়, কেন আমার কাছে আরাধ্য সেই ছবিটা নেই। ছবি মানুষকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখে। ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ছবি শুধু মনের আকুতি বাড়ায় তা নয়, আত্মতৃপ্তি দেয়। বন্ধুবান্ধব, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, স্কুল-বন্ধু, কলেজ-বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়-বন্ধু এমনকি বিদেশে অধ্যয়নরত অবস্থায় শিক্ষক-বন্ধুসহ যাদের সান্নিধ্যে ধন্য হওয়া যায়, তাদের ছবি মানসপটে সব সময় ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাদের ছাপা ছবি অনেক সময় শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা বাড়িয়ে দেয়। ঠাকুরদা-দিদিমার ছবি, মা-বাবার ছবি, নানা-নানীর ছবি, পুত্র-কন্যার ছবি সেগুলো ঘরের দেয়ালে যখন শোভা পায়, অবসর সময়ে তাও অনেক স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ছবিগুলো, অদৃশ্য আত্মার মতো আপনাকে আশীর্বাদ এবং সদা প্রহরায় রাখে, আপনাকে সৎপথে আসার নির্দেশ দেয়। যখন দেখি রাস্তাঘাটে, কোনো সুদৃশ্য জায়গায় অথবা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সান্নিধ্যে গেলে ফটো তোলার হিড়িক পড়ে যায় তখন আনন্দ ও বেদনা একই সঙ্গে আমাকে ভোগ করতে হয়। মাঝে মাঝে অনেক সেলিব্রেটিও আমার চেম্বারে এলে তাদের সঙ্গে ফটো তুলতে অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা ব্যস্ত হয়ে যায়, বিশেষ করে যখন মাশরাফি ও সাকিব আসেন। তাদের সঙ্গে ছেলেমেয়েদের ফটো তুলতে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাই। দেশ যেমন তাদের নিয়ে গর্ব করে, আমিও ব্যতিক্রম নই। কিন্তু আমার মনে একটা নিদ্রিত কষ্ট তখন জেগে ওঠে।

পিতা-পিতৃব্য, গুরুজন সবাই তার অনুজদের সৎপথে চলার নির্দেশ দেন, কখনো বলেননি অসৎ পথে চলার, বরং যখনই অসৎ পথে চলার গন্ধ পেয়েছেন তখনই শাসন করেছেন। ছোটবেলায় তাদের সবচেয়ে প্রিয় কথা ছিল Nothing is secret অর্থাৎ এমন কোনো কাজ করো না যা করলে আমরা জানব না। সত্যিই আমি দেখেছি, সাত দিন আগে কোনো একটা অপকর্ম করেছি যা ছেলে বয়সে গ্রামে করাটা খুব বড় অপরাধ নয় বরং স্বাভাবিক, যেমন কারও গাছ থেকে কিছু না জানিয়ে খেয়ে ফেলা ইত্যাদি। তার খবর সাত দিনের মধ্যেই পৌঁছে যেত বাবার কাছে। শাস্তি তৎক্ষণাৎ।

আমার বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘কখনো মিথ্যা বলো না’। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায়, বার্ষিক পরীক্ষার সময় আমার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নূরুল ইসলাম মজুমদার (নূরু) আমাকে সরল অঙ্কের ফল কত জিজ্ঞাসা করায় তাকে হয়রানি করার জন্য ১-এর জায়গায় ‘০’ বলেছিলাম। বেচারা দ্বিতীয় স্থানে থাকত। সেই অঙ্কের ফল মেলাতে গিয়ে গলদঘর্ম। ফলত অঙ্কে সে খারাপ ফল করে এবং তার রোল নম্বর দ্বিতীয় থেকে চতুর্থে চলে যায়। এ তথ্যও বাবার কাছে পৌঁছে যায় পরীক্ষার ফল বের হলে। নূরুলের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আমার বাবাকে এ কথা জানালে, উনাদের সামনেই আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, সত্যি কিনা। আমি হ্যাঁ বললে, কান ধরে ডিসপেনসারি ঘরে নিয়ে, এক দিস্তা কাগজ এবং একটি কাঠ পেনসিল দিয়ে বললেন প্রতি পৃষ্ঠায় ২০ লাইন করে ‘জীবনে কখনো মিথ্যা বলব না’ লেখার জন্য, সঙ্গে পেনসিল ধারালো করার জন্য ব্লেড। বেলা ৩টায় লেখা শেষ করে দেখাতে গেলে আবার কলম দিয়ে পেনসিলের লেখার ওপর একই লেখা লিখতে দিলেন। দুপুরের খাবার ভাগ্যে জোটেনি। সন্ধ্যা ৬টায় দুপুরের খাবারের জন্য বাবা-ঠাকুরমার ঝগড়ায় ঠাকুরমা জয়ী হওয়ায় ভাগ্যে জুটেছিল। হাত ব্যথা হয়েছিল, সন্ধ্যার খাবারটা ঠাকুরমা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছিলেন। মিথ্যা বলার এত বড় শাস্তি, জীবনে মিথ্যা বলা থেকে কিছুটা হলেও বিরত রেখেছিল।

নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হন চিকিৎসক ও বিএমএ নেতা ডা. শামসুল আলম খান মিলন। শহীদ মিলনের স্ত্রী কবিতা এবং একমাত্র কন্যা শ্যামা আমাদের সঙ্গে ১৯৯২-৯৩ সালে মানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল Horniman House-এ পাশাপাশি রুমে থাকতেন। আমি, আমার স্ত্রী ডা. জয়া ও কন্যা তুলি। শ্যামা প্রায়ই তার মাকে প্রশ্ন করতেন, তুলি আপুর বাবা আছে, আমার বাবা কোথায়? নিষ্পাপ শিশুটির এ প্রশ্নের জবাব ছিল, তোমার আব্বু আল্লাহর কাছে গেছেন, কখন আসবেন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মেয়েকে বকুনি দিয়ে থামানোর চেষ্টা করলে, সে আমাদের মিনি ফ্ল্যাটে চলে আসত আর কান্না করত। আমার স্ত্রী ছিল তার শেষ ভরসাস্থল। একজন বাবার চাহিদা তার সন্তানের কাছে কত বড়- ওই ঘটনা আমার কাছেও কঠিন বেদনার কারণ হতো। শ্যামা প্রায়ই তার বাবার ছবিগুলো আঁকড়িয়ে থাকত। আজ আমাদের শ্যামা ডাক্তার হচ্ছে। আমেরিকায় মায়ের কাছে থেকে লেখাপড়া করছে, খুবই গর্ববোধ করি। ১৯৬৮ সাল, ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। বৃত্তির টাকা পেলাম সাড়ে সাত শ, বাবার হাতে দিয়ে একটা আবদার করলাম ৩০ টাকা আমাকে দেওয়ার জন্য। জিজ্ঞাসা করলেন কেন? অনেক ইতস্তত করে বললাম, আমি একটা ‘মুজিবকোট’ বানাব। ভাবলাম ছাত্রলীগ করি, বন্ধুদের অনেকের এই ড্রেসটা আছে। আমার একটা অবশ্যই দরকার। বাবা না বলেননি। কিন্তু উনার জবাবটা ছিল অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বললেন, মুজিবকোট শুধু শেখ মুজিবকেই মানায়, যেমনটি গান্ধীর ন্যাংটি গান্ধীকেই মানায়, তোমার বাবা পরলেও মানাবে না! পুরো উপমহাদেশের সাধু-সন্ন্যাসী থেকে শুরু করে কেউ তা পরিধান করলে মানাবে না। এখন যখন দেখি রাম, শ্যাম, যদু, মধু সবাই মুজিবকোট পরিধান করে, চোরাকারবারি, ব্যবসায়ী, খুনি মুজিবকোট পরে তখন বাবার কথা মনে হয়। যে-ই পরিধান করুক, যত দামি পাঞ্জাবির সঙ্গে, দামি মুজিবকোট পরলেও জাতির পিতার মতো এত সৌম্য, সুদর্শন ব্যক্তিত্ব মনে হয় না। তবু অনেকে সাহস করে মুজিবকোট পরেন। গান্ধীর ন্যাংটি কিন্তু কেউ আর পরিধানের সাহস পাননি। এ পর্যন্ত আমার মুজিবকোট বানানোর সাহস বা সুযোগ কোনোটাই আসেনি। এ ব্যাপারে অনেক কিছু লেখার ছিল, লিখলে অনেকেই কষ্ট পাবেন তাই বিরত রইলাম। যেই ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা আমার ছিল না, বাবার নির্দেশ অমান্য করে রসায়নে পড়ার জন্য সচেষ্ট ছিলাম, সেই বাবা এবং তার সহপাঠী বান্ধবী আমার অতি শ্রদ্ধেয় ফুফু অধ্যাপক সৈয়দা ফিরোজা বেগম আমাকে ডাক্তারি পড়তে বাধ্য করেছিলেন, সেই বাবার সব সিদ্ধান্তই যে সঠিক ছিল তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কিন্তু মনের গভীরে সবচেয়ে বড় কষ্ট যা প্রতিদিন সকালে আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়- যখন আমি বের হওয়ার সময় আমার মায়ের, শ্বশুর-শাশুড়ির ছবিগুলোকে প্রণাম করে বেরিয়ে যাই, অতৃপ্ত হৃদয় নিয়ে দেখি সেখানে নেই বাবার ছবি। অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাড়িঘর পোড়ানোর সময় সবই ছাই হয়ে যায় এবং স্বাধীনতার ঊষালগ্নে ১৩ নভেম্বর তার দেহটাও ছাই হতে দেখি নিজেদের পারিবারিক শ্মশানে রাজাকার বা পাকিস্তানি জান্তাদের ভয়ে মুখাগ্নিও করতে পারিনি। আধা মাইল দূরের গ্রাম থেকে চিতার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে কিন্তু ছবি আর পাইনি। তখন প্রযুক্তি ছিল না, আজকের মতো মোবাইল বা সেলফি ছিল না, যে কারও কাছে ছবি থাকতে পারে। বাবা দুটি অক্ষরের একটা মিষ্টি শব্দ। এ শব্দটি শুধু আমাদের আবেগ আর অনুভূতির সঙ্গে জড়িত তা নয়, এখন এটা যেন আমার হৃদয়ের এক হাহাকার। এত শাসনের অর্থাৎ কঠোর শাসনের পরে আমার মনে হয় আমার বাবার সততা, পরোপকারের মনোভাব, সময়কে মূল্য দেওয়া এবং অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়া এসব গুণ আমার মনের মন্দিরে শ্রেষ্ঠতম স্থানে আসন করে নিয়েছে। আমি কিন্তু তেমন বাবা হতে পারিনি। বাবা তোমাকে প্রণাম, হাজারো প্রণাম, পুনর্জন্ম নিয়েও যদি এসো, তা হলেও তোমাকে দেখতে পাব।

 

            লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর