বুধবার, ৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
আন্তর্জাতিক

ন্যায় আচরণ সবারই প্রাপ্য

মুহাম্মদ আজিম উদ্দিন

ফিলিস্তিন, আরব তথা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছেন মানবতাবাদী লেখক সাংবাদিক এমনকি রাজনীতি- বিদরাও। তাদের একজন জার্মান পার্লামেন্টারিয়ান জারগেন টডেন হফার। তিনি তার টেন থিসিসে লিখেছেন, ‘মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আচরণ, অবশ্যই ইসরায়েলের সঙ্গে তার আচরণের মতোই হওয়া উচিত। মুসলমানরা ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মতো একই রকম গুরুত্বপূর্ণ।’

পাশ্চাত্যের অনেকেই নিজেদের নির্ভুলতা, অজ্ঞতা এবং ঘৃণার সংমিশ্রণে উৎপন্ন চিন্তাধারা থেকে ইসলামকে একটি রক্তপিপাসু ধর্ম এবং মুসলমানদের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হিসেবে ধরে নেন যারা গণতন্ত্র, নারী, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের প্রতি শত্র“ভাবাপন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের বন্ধু এবং আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা ফ্রংক গ্রাহাম ইসলামকে অত্যন্ত অশুভ ও মন্দ ধর্ম হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমেরিকান রক্ষণশীল-দের জনপ্রিয় টিভি ব্যক্তিত্ব বিল ও রেইলি মন্তব্য করেছেন, ‘আমরা পুনরায় মুসলিম বিশ্বের ঝামেলায় জড়াতে পারি না। আমরা যা পারি তা হচ্ছে বোমা মেরে তাদের বেঁচে থাকার আলো নিভিয়ে দিতে।’ আমেরিকান টিভি আলোচক অ্যান কোলটার মনে করেন- ‘আমাদের উচিত তাদের দেশগুলো আক্রমণ করা, তাদের নেতাদের হত্যা করা এবং তাদের খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত করা।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুসলমানদের সঙ্গে আমরা হয়তো ৯/১১-পরবর্তী ফালতু ভালো ব্যবহারের প্রতিযোগিতা বাদ দিয়ে এ মুহূর্তে আমাদের যা করা দরকার তাতে মনোনিবেশ করতে পারি- সিরিয়াকে বোমা মেরে প্রস্তর যুগে ফিরিয়ে আনতে পারি এবং তারপর ইরানকে চিরস্থায়ী রূপে অস্ত্রহীন করতে পারি।’ এ ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতির তালিকা সীমাহীনভাবে দীর্ঘ করা সম্ভব। এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখুন গ্রাহাম ও রেইলি অথবা কোলটার যদি ‘ইসলামের’ পরিবর্তে ‘ইহুদি ধর্ম’ ও ‘মুসলিম রাষ্ট্রের’ বিপরীতে ‘ইসরায়েল’ উচ্চারণ করতেন তবে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যেত এবং সেটাই স্বাভাবিক। কেন মুসলমান এবং তাদের ধর্মের প্রতি কোনো ফ্যাসিস্ট মন্তব্য মেনে নেওয়া হবে এবং তা খ্রিস্টান ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে হলে অগ্রহণযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যান করা হবে? ইসলাম ও মুসলমানদের দানবীয় রূপদানের এ প্রচেষ্টা আমাদের বন্ধ করতে হবে। এটা শুধু নিন্দনীয়ই নয়, তা আমাদের স্বার্থের জন্যও ক্ষতিকারক।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অব্যাহত গভীর বিভক্তি ইসরায়েলের নিরাপত্তাকেও বিপৎসংকুল করে তুলছে। ইসরায়েল ও তার ৫০ লাখ ইহুদির নিরাপত্তার সর্বাধিক দৃঢ় নিশ্চয়তা শত্র“তা নয়, রবং তার পাশের ও দূরবর্তী ৩০ কোটি আরব অধিবাসীর সঙ্গে বন্ধুত্ব। তা অর্জনের জন্য পাশ্চাত্য ও ইসরায়েলকেও ন্যায়সংগত অবদান রাখতে হবে। ইহুদি জনগোষ্ঠী তাদের নৈতিক গরিমা সামরিক বিজয় অথবা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কৃতী ও পারদর্শী সদস্যের কারণে অর্জন করেনি; বরং তা তারা অর্জন করেছে ধার্মিকতা, প্রজ্ঞা, মানবিকতা, উদ্ভাবনী শক্তি এবং একই সঙ্গে ন্যায়বিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘ সাহসী ও প্রায় চতুর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এটা বোধগম্য যে, হলোকাস্টের পর ইসরায়েল তার সামরিক শক্তি নিশ্চিত করা এবং তার স্বার্থ রক্ষায় আশ্রয় নিয়েছে সক্রিয় শক্তি ও কঠোরতার, কিন্তু ন্যায়বিচারহীন কঠোরতা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য। ইসরায়েল কেবল ধ্বংসই করতে জানে তাহলে সে নিজেকেও ধ্বংস করে ফেলবে। অবশ্যই ইসরায়েল এবং সমগ্র পাশ্চাত্যকে নিদেনপক্ষে অস্ত্রের পেছনে বিনিয়োগকৃত সমপরিমাণ অর্থ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ করতে হবে। ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে যে ব্যবহার করা হচ্ছে তা ইহুদি জনগণের নৈতিক গুণ ও উৎকর্ষের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়- ইহুদি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা পোষণকারী কোনো ব্যক্তির পক্ষে কেবল এ উপসংহারেই পৌঁছা সম্ভব।

ফিলিস্তিনিদেরও তাদের নীতির পরিবর্তন করতে হবে। পাশ্চাত্য সঠিকভাবেই এ দাবি তুলতে পারে যে, তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের আচরণ পরিত্যাগ করবে। কিন্তু তাহলে তাদের কি এ দাবি উত্থাপন করাও উচিত নয় যে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতা পরিত্যাগ করবে?

ইহুদি ও আরবের মধ্যকার সমঝোতা জার্মানি ও ফরাসিদের মধ্যকার অবিশ্বাস্য সমঝোতার মতোই সম্ভবপর। অধিকাংশ মানুষ যেমন মনে করে ইহুদি ও আরবের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক ক্ষেত্রে তার চেয়েও অধিক পারস্পরিক অংশীদারিত্ব রয়েছে। যেমন ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ বলেছিলেন, তাদের রয়েছে একই পিতা, ইবরাহিম ও মূসা। বহু শতাব্দী ধরেই ইহুদি ও আরবরা নির্যাতিত হয়েছে এবং তা শুধু ক্রুসেড ও রিকনকুইস্তার সময়ই নয়। ফ্রান্সের সরকার ইহুদিদের বিরুদ্ধে তার জাতিবিদ্বেষী বৈষম্যমূলক নীতি প্রয়োগ করেছিল যা তারা আগে আলজেরীয়দের ওপর ‘সফলভাবে’ পরীক্ষা করেছিল।

আমাদের বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষত সারিয়ে তোলার জন্য সহযোগিতা করা এবং তা অর্জনে ইউরোপকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দৃঢ় সামরিক সহায়তা প্রদান করতে হবে এবং একই সঙ্গে একটি কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়ও সহযোগিতা দিতে হবে। আমাদের সেতু রচনা করতে হবে, দেয়াল নয়। মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, বিশ্বশান্তির জন্য জারগেন টডেন হফারের বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক; যার বিকল্প নেই বললেই চলে।

           

            লেখক : ধর্মবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর