বৃহস্পতিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধর্ষণ বন্ধ করার দায়িত্ব কাদের?

তসলিমা নাসরিন

ধর্ষণ বন্ধ করার দায়িত্ব কাদের?

রাজধানীর গেন্ডারিয়ায় দু’বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রবিবার রাতে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে প্রতিবেশী যুবক জয়দেব। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে ৪ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। সাভারে এক পোশাক কর্মীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। কী ঘটেছে তার খবর দেওয়া হয়, কারা ঘটিয়েছে, তা বলা হয় না। ধর্ষকদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে দায় সারা হয়। ধর্ষকদের নাড়িনক্ষত্র জানা দরকার মানুষের। তা হলেই কি মানুষ লজ্জা দেবে ধর্ষকদের, তাদের গ্রাম বা শহর ছাড়া করবে, চাকরি খাবে, জেলে পাঠাবে? মোটেই না। বরং ধর্ষক দিব্যি পথ চলবে। ‘পুরুষ মানুষের সেক্সটা একটু বেশিই’ বলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই ওদের দেখবে লোকেরা।

কিছুদিন আগে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের কিছু পুরুষ এক মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। মহিলার অপরাধ, তিনি ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন। সেই কারণে নৌকা মার্কার লোকেরা ধানের শীষের লোকদের ধর্ষণ করেছে। ঠিক যেমন আফ্রিকার হুটু দল টুটসি দলের মেয়েদের ধর্ষণ করে। পাকিস্তানের সৈন্যরা বাংলাদেশের নিরস্ত্র নারীদের ধর্ষণ করেছিল একাত্তরে। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রতি বছর ৫ লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। রুয়ান্ডাতে মাত্র তিন মাসে আড়াই লক্ষ মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। আফ্রিকার মেয়েদের শরীর ভরে গেছে এইডসে আর যুদ্ধ-শিশুতে। ১৯৩৭ সালে নানকিং ধর্ষণকাণ্ডের সময় হাজার হাজার চীনা মেয়েকে ধর্ষিতা হতে হয়েছে। চীনা মেয়েদের মধ্যে যারা গর্ভবতী হয়েছিল তাদের অনেকেই তাদের শিশু-সন্তানকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। ৯২ সাল থেকে ৯৫ সাল পর্যন্ত বসনিয়ার যুদ্ধে হাজারো মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে। জন্ম নিয়েছে হাজারো যুদ্ধশিশু। আমরা খুব ভালো করেই জানি, যুদ্ধের সময় সৈন্যরা পরাজিত দলের মেয়েদের ধর্ষণ করে, শত্রুপক্ষের নারীদের ধর্ষণ করে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, ভিন্ন ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের মেয়েকে হিংসেয়, ঘৃণায়, প্রতিশোধে ধর্ষণ করে। কিন্তু দু’বছরের শিশুকে কেন ধর্ষণ করে, যে শিশুর বাবা মা ধর্ষকের কোনও শত্রু নয়, প্রতিশোধ নেওয়ার কোনও কারণ যেখানে নেই? ধর্ষণ হাজার বছর ধরে চলে আসছে, এখনও চলছে- এটিও কোনও যুক্তির কথা নয়। হাজার বছর ধরে যা যা ছিল, তার বেশির ভাগই এখন দুনিয়া থেকে বিদেয় নিয়েছে, তবে ধর্ষণ কেন আজও বিদেয় নিচ্ছে না? কেন ধর্ষণ থেকে নির্বোধ নিরীহ শিশুও রেহাই পাচ্ছে না? এগুলোর উত্তর অধিকাংশ মানুষ জানে না।

নোয়াখালীর খবরটি পরিবেশন করা হয়েছে এভাবে, ‘চার সন্তানের এক জননীকে দুষ্কৃতকারীরা গণধর্ষণ করেছে। ধর্ষকদের পরিচয় ‘দুষ্কৃতকারী’, আর ধর্ষণের শিকারের পরিচয় ‘চার সন্তানের জননী’। মহিলা ক’টি সন্তানের জননী, তার উল্লেখ এই খবরটিতে জরুরি কেন? ধর্ষকরা ক’টি সন্তানের জনক তা কিন্তু একবারও জানানো হয়নি। জরুরি ছিল এই তথ্যগুলো জানা, ধর্ষকেরা বিবাহিত কী অবিবাহিত, কার কত বয়স, কে ক’টি সন্তানের জনক, তাদের নাম ঠিকানা, পেশা, ইত্যাদি। ধর্ষণের শিকার ১ মাসের শিশু থেকে শুরু হয়ে ১০০ বছরের বৃদ্ধাও। আমেরিকায় তো সেদিন ১০ বছর ধরে অচেতন পড়ে থাকা এক রোগীর বাচ্চা হলো, এর মানে হাসপাতালে শুয়ে থাকা অচেতন অজ্ঞান রোগীকে কেউ এসে ধর্ষণ করে গেছে। গবেষণা হওয়া উচিত ধর্ষকদের নিয়ে। কেন পুরুষেরা ধর্ষণ করে, কেন তারা আজও ধর্ষণ বন্ধ করতে পারছে না। ধর্ষণ বন্ধ করতে অসুবিধেটা পুরুষদের কোথায় হচ্ছে।

‘চার সন্তানের জননীকে ধর্ষণ করেছে ওরা’, এভাবে না লিখে ‘নোয়াখালীর এক মহিলাকে ধর্ষণ করেছে ওরা’ লিখলো না কেন সাংবাদিকরা? সম্ভবত ধর্ষিতা হলে ‘নোয়াখালীর এক মহিলা’ যতটা সহানুভূতি পায়, তার চেয়ে বেশি পায় ‘চার সন্তানের জননী’! এক সন্তান অথবা নিঃসন্তান ধর্ষিতা রমণী যত পায়, তার চেয়েও হয়তো বেশি। চার সন্তানের জননী ধর্ষণের শিকার হলে, স্বামীর কতটা লজ্জা হবে তার স্ত্রীকে নিয়ে, আর চার সন্তানের কতটা লজ্জা হবে তাদের মা’কে নিয়ে, সেটা ভেবে আফসোস করে সমাজের মানুষ। সহানুভূতিটা আসলে ধর্ষিতাদের জন্য নয়, সহানুভূতি ধর্ষিতার স্বামী সন্তানের জন্য। অবিবাহিতা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে যে আহা আহা রব ওঠে, সেই আহা আহা সম্পূর্ণই মেয়েটির হবু স্বামীর কথা ভেবে। স্বামীটি একটি অনাঘ্রাতা মেয়ের স্বাদ পাবে না, এই দুঃখে। ধর্ষণকে এখনও সমাজ শুধু যৌনসংগম হিসেবেই বিচার করে, পুরুষের পেশি বা ক্ষমতা প্রদর্শন, পুরুষের অত্যাচার-নির্যাতন বা নারীবিদ্বেষ হিসেবে নয়। ধর্ষণের সঙ্গে সহানুভূতির একটি সম্পর্ক আছে, তবে তা নির্ভর করে, ধর্ষিতাটি কে, তার ওপর। দরিদ্র মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে যতটা মানুষ দুঃখ করে, তার চেয়ে বেশি দুঃখ করে ধনী মেয়ে ধর্ষিতা হলে। চুল-খোলা মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে ততটা নয়, হিজাবি মেয়েদের জন্য মায়াটা বেশি হয়। মদ-সিগারেট খাওয়া মেয়েরা যদি ধর্ষিতা হয়, তবে সহানুভূতি জন্মায় খুব কম। ছেলে-বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাফেরা করা মেয়েরা ধর্ষিতা হলে খুব একটা অসন্তোষ দেখি না কারোর। যেন এ হওয়ারই কথা ছিল। পতিতাকে খদ্দের-পুরুষেরা যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ করলে কেউ প্রতিবাদ করে না, একইরকম স্ত্রীকে যখন স্বামীরা ধর্ষণ করে, তার বিরুদ্ধেও কাউকে রুখে উঠতে দেখি না। সুতরাং সব ধর্ষণ এক হলেও, লোকের কাছে সব ধর্ষণ এক নয়। আমার মেয়েকে ধর্ষণ করা হলে আমি সইবো না, কিন্তু তোমার মেয়েকে ধর্ষণ করা হলে ধর্ষণটা ওর প্রাপ্য ছিল বলে মনে মনে ভাববো, এমন লোকেরও অভাব সমাজে নেই।

নোয়াখালীতে ধর্ষণ কী করে ঘটেছিল, এই খোঁজ করতে গিয়ে যা তথ্য পেলাম তা হলো, ‘ভোটের দিন ‘চার সন্তানের জননী’ (তার কোনও নাম পেলাম না কোথাও) ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে গেলে একদল লোক তাকে ধানের শীষে ভোট দিতে বারণ করে। কিন্তু জননী ধানের শীষেই ভোট দেন। এ কারণে লোকগুলো তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেয়। পরে রাত ১২টায় কয়েকজন লোক তার বাড়িতে গিয়ে পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বলে। দরজা খুলে দিলে ১৫-১৬ জন লোক জননীর স্বামীকে আর তার তিন সন্তানকে বেঁধে ফেলে। ধানের শীষে ভোট দেওয়ায় লোকগুলো জননীকে গালাগাল করে এবং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে যায়। এরপর সবাই মিলে তাকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে। জননী ধর্ষকদের চিনে ফেলায় তারা তাকে জবাই করার উদ্যোগ নেয়। ধর্ষকদের হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে তিনি জীবন ভিক্ষা চান। এরপর তাকে জবাই না করে ধর্ষণের পর বাড়ির উঠানে ফেলে রেখে ভোর ৪টার দিকে ধর্ষকরা চলে যায়। সকালে প্রতিবেশীদের সহায়তায় তার স্বামী তাকে হাসপাতালে নিতে গেলে রহুল আমিন মেম্বার ধর্ষণের ঘটনা কাউকে বা সাংবাদিকদের জানালে তাকে ও তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।’

ধানের শীষে তো অনেকেই ভোট দিয়েছে। সবাইকে তো ধর্ষণ করেনি আওয়ামী লীগের লোকেরা। যাকে সম্ভব হয়েছে ধর্ষকরা তাকেই করেছে। ধানের শীষের লোকেরাও ক্ষমতায় থাকলে একই রকম কীর্তি করতো। নৌকায় ভোট দেওয়ার অপরাধে খুন ধর্ষণ করতো। ওরা কি একই মুদ্রার দু’পিঠ নয়?

নিরীহ একটি মহিলাকেই টার্গেট করেছে ওরা, যে মহিলা তাদের নির্দেশ মান্য করেনি। মেয়েদের শাস্তি দেওয়ার চাবুকের নাম পুরুষাঙ্গ। তাই ওটি দিয়েই অবাধ্য মহিলাকে শাস্তি দিয়েছে পনেরো-ষোলো জন পুরুষ। এতগুলো পুরুষের মধ্যে একজন পুরুষও বলেনি, কাজটা অন্যায় হচ্ছে। বিবেক আজ কোন ধুলোয় লুটোচ্ছে, ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়।

বাংলাদেশ সেই কতকাল থেকে শাসন করছেন দুই মহিলা। অথচ প্রতিদিন মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিদিন ঘটছে নারী নির্যাতন। নারীবিদ্বেষ আর নারীবিরোধ ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ একবেলাও চলে না। তাহলে কী লাভ নারীর ক্ষমতায়নে? নারী যদি পুরুষের মতোই পুরুষের ভূমিকা পালন করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকেই জল সার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে!!

নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী সুযোগ পেয়েছেন দেশকে আদর্শ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার। দুষ্ট শক্তির সঙ্গে আর আপস নয়। শেখ হাসিনা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে এখন ফিরে যেতে পারেন ৭২-এর সংবিধানে, ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারেন। কোনও রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজন কারোর নেই, তিনিও জানেন। মানুষের ধর্ম থাকে, রাষ্ট্রের ধর্ম থাকতে নেই। রাষ্ট্র সবার। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান আস্তিক নাস্তিক সবার। শেখ হাসিনা এখন মন দিয়ে দেশের ভালোর জন্য কাজ করুন। আমার বিশ্বাস গত ১০ বছরের ভুলগুলো তিনি আগামী ৫ বছরে শোধরাবেন। কওমিদের ডিগ্রিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমান করার সিদ্ধান্তকে বাতিল করবেন। হেফাজতিদের হেফাজত করা বন্ধ করবেন। ওলামা লীগকে নিষিদ্ধ করবেন।

নারীবিরোধী ওয়াজ নিষিদ্ধ করবেন। প্রচার মাধ্যমকে স্বাধীনতা দেবেন। মানুষকে মত প্রকাশের অধিকার দেবেন। সংখ্যালঘু এবং সরকারের সমালোচকদের নিরাপত্তা দেবেন। পারিবারিক আইন ধর্মভিত্তিক না করে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ভিত্তিক করবেন। আশা করছি শেখ হাসিনা দেশের ভালোর জন্য যা দরকার সব করবেন। তিনিই ভরসা।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

সর্বশেষ খবর