শুক্রবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
স্মরণ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

আতিক হেলাল

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ ছিলেন উপমহাদেশের একজন স্বনামধন্য আইনবিদ। সেইসঙ্গে তিনি ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন। মানবতাবাদী, সমাজহিতৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ১০৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের জন্ম। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।  সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাই কোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এই সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই তো এক পর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারক-জীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর বংশধরদের একজন মুফতি সৈয়দ আলী রাশেদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলের প্রথম দিকে সদর দেওয়ানি আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি তাদের পূর্বপুরুষদের একজন। মাহবুব মোরশেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও একজন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় নিযুক্ত ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছিল। মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। মাতামহ কাজী ওয়াজেদ আলী ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম মুসলমান আইন গ্র্যাজুয়েট প্রখ্যাত সমাজ-সংস্কারক নবাব আবদুল লতিফের জ্ঞাতি ভাই। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাই কোর্টে অইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তবে তিনি মামা ফজলুল হকের সহকারী না হয়ে সুভাষ চন্দ্রের অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) ও খ্যাতনামা অবাঙালি আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য যান। ১৯৩৮ সালে তিনি লন্ডনের বিখ্যাত লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ’৫১ সালে ঢাকা হাই কোর্ট বারে যোগ দেন। ’৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেন। ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা এবং শেরেবাংলার নেতৃত্বে গঠিত সেই সরকারের কেন্দ্র কর্তৃক বরখাস্ত হওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নানামুখী নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনায় সময়টা ছিল উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনিও সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে ইতিবাচকভাবে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। ’৫৫ সালে যখন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাই কোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ’৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেন মাহবুব মোরশেদ ছিলেন তারই একজন। ’৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেক রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাই কোর্ট থেকে            সুয়োমোটো (স্বতঃপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, যার ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টেরও (আপলি বিভাগ) অ্যাডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তার কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এর আগে ১৯৪৩ সালে বেঙ্গল ফেমিন ও ’৪৬-এর দাঙ্গার সময় তিনি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক মানবিক ও সমাজসেবামূলক কাজেও অংশ নিয়েছেন। ’৪৭-এর দেশভাগের পর নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচ- সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ’৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যে ছয় দফার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাবরণ করতে হয়। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ছয় দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ’৬৫-এর যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেন, পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এ বিষয়টিও গভীরভাবে তার চিন্তার মধ্যে ছিল।

লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক জীবনসদস্য, বাংলা একাডেমি।

সর্বশেষ খবর