সোমবার, ১৪ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু সেদিন যা বলেছিলেন

সাঈম চৌধুরী

লন্ডনে বঙ্গবন্ধু সেদিন যা বলেছিলেন

লন্ডন। জানুয়ারি ১৯৭২। ভর শীতের মৌসুম। তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করছে। আবহাওয়ার রিপোর্ট বলছে, সে বছর জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো খানিকটা রোদ উঠেছিল ১২ তারিখে, তার আগের ১১ দিনই ছিল মেঘ-বৃষ্টির দখলে। বইছিল ঝড়ো শীতল বাতাস। হাড় কাঁপানো এমন শীতে ৮ জানুয়ারি সকালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইট হিথরো বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করে। বিমান অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা আগে ব্রিটিশ সরকার জানতে পারে, এ বিমানে এমন একজন যাত্রী আছেন যিনি ওই সময়ে পৃথিবী নামের গ্রহের সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত পুরুষ; যার জন্য দেশে দেশে প্রার্থনারত শান্তিপ্রিয় মানুষ, টোকিও থেকে মস্কো, দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন, বেইজিং থেকে হাভানা ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর বিজয়গাথা। সেই বিজয়ী পুরুষের জন্য বিজয়ী একটি জনপদের মানুষ নির্ঘুম অপেক্ষায় রয়েছেন, যারা মাত্র ২৩ দিন আগে জাতি হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে লাল সবুজের চিহ্ন এঁকেছেন। দুধশিশু সেই রাষ্ট্রের ৭ কোটি মানুষ তাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতাপ্রাপ্তিকে উদ্যাপন করতে পারছেন না এই একজন মাত্র মানুষের অনুপস্থিতিতে। বিমানে বসে থাকা ওই মানুষটি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

এটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশে ফেরার পথের গল্প। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এই অনন্য অসাধারণ উপাখ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে লন্ডনের নামও। শত্রু মাটি থেকে মুক্তির পর প্রথম যে মুক্ত মাটি স্পর্শ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সেটি লন্ডনের। অবশ্য বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে চাইছিলেন তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে সরাসরি বাংলাদেশেই ফিরবেন। পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমদ বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ইরান-তুরস্ক রুট ধরে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এ রুটটি পছন্দ হয় না বঙ্গবন্ধুর। তিনি কেবল ঢাকায় ফিরতে চান এবং তা সরাসরি।

আজিজ আহমদ জানালেন, এটি সম্ভব নয়। কারণ ভারতের আকাশসীমা তারা ব্যবহার করতে পারবেন না। ঠিক আছে, তবে তোমাদের বিমানে নয়, রেডক্রস কিংবা জাতিসংঘের বিমানের ব্যবস্থা কর, আমি ইরান, তুরস্ক যাব না, নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু।

আজিজ আহমদ বলেন, আমরা চাইছি পাকিস্তান এয়ারলাইনসে আপনাকে ফেরত পাঠাতে। যেহেতু আমরা ভারত হয়ে যেতে পারব না তাই অন্য একটি দেশে আপনাকে যেতে হবে।

শেষ পর্যন্ত অন্য দেশ হিসেবে ব্রিটেনকে বেছে নেওয়া হয়। এরপর ৮ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা বজায় রেখে বঙ্গবন্ধুকে লন্ডন পৌঁছে দেয় পাকিস্তান। হিথরোয় বিমান অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা আগে ব্রিটেন জানতে পারে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অল্প সময়ের মধ্যেই লন্ডন এসে পৌঁছছেন।

দ্রুতগতিতে খবরটি ছড়িয়ে পড়ে। এদিন বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে ভোরের খবরে জানিয়ে দেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর লন্ডন আগমনের খবর। তারা জানায়, কিছুক্ষণের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী প্লেন হিথরো বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। এ খবরে লন্ডনের মেঘভেজা শীতল সকালও যেন সূর্যালোকিত হয়। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে ৮ জানুয়ারি ভোরে লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে আলাদা প্রাণচাঞ্চল্য জাগে। এরই মধ্যে ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করবে, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বরণ করবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ লন্ডনের বাইরে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সব কর্মসূচি বাতিল করে দিয়ে টেন ডাউনিং স্ট্রিটে ফিরে আসেন। দুপুরে এখানেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন।

বিমান থেকে নামলেন বঙ্গবন্ধু। ফরেন অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা তাকে স্বাগত জানিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে আসেন। ভিআইপি লাউঞ্জে ৬ ফুট লম্বা এক পুলিশ অফিসার ছিলেন। কর্মকর্তাদের ভিড় ঠেলে তিনি বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে দাঁড়ান। স্যালুট দেন। তারপর বলেন, আপনিই তো বঙ্গবন্ধু, জানেন স্যার আমি আপনার জন্য প্রার্থনা করেছিলাম! এখনো বলা হয়নি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই বিমানে ছিলেন সহযাত্রী ড. কামাল হোসেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশ ফেরার পথে লন্ডনের এই অনুপম দিনটির কথা ড. কামাল হোসেনের স্মৃতিতে উঠে এসেছে বারবার। এই পুলিশ অফিসারের গল্পটিও আমরা ড. কামাল হোসেনের স্মৃতি থেকে জানতে পারি। জানতে পারি, যখন হিথরো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেজাউল করিমের কাছে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর আগমনের খবর জানানো হয়, তখন রেজাউল করিম অতি আনন্দে কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি আসছি, আমি নিজ চোখে তাকে দেখতে চাই।’

রেজাউল করিম হিথরোয় পৌঁছার আগেই আসেন ফরেন অফিসের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা স্যার ইয়ান সাদারল্যান্ড। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ক্ল্যারিজ হোটেলে নিয়ে যাওয়া হবে।

ক্ল্যারিজ, সেই সময়ে লন্ডনের সবচেয়ে দামি হোটেল। অভিজাত এলাকা মেফেয়ারের ব্রুক স্ট্রিট ও ডেভিস স্ট্রিটের কর্নারে অবস্থিত এ হোটেলটি প্রতিষ্ঠা পায় ১৮১২ সালে। ব্রিটিশ রাজপরিবারের আমন্ত্রিত অতিথিদের আবাসন হিসেবে পরিচিত ক্ল্যারিজ হোটেলকে বলা হয় রানীর আবাসস্থল বাকিংহাম প্যালেসের বর্ধিত রূপ বা উপগৃহ।

মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসানকে বিশেষ একটি কারণে বিশ্ব মনে রেখেছে। বাদশাহ হাসান বিশ্বের যেখানেই বেড়াতে যেতেন সঙ্গে নিজের লেপ-তোশক নিয়ে যেতেন। কিন্তু লন্ডন ভ্রমণে এসে ক্ল্যারিজ হোটেল রুমের স্যাভয় মেট্রেসে শুয়ে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে লন্ডন থেকে মরক্কো ফেরার সময় নিজের লেপ-তোশক ফেলে ২৪টি স্যাভয় মেট্রেস নিয়ে গিয়েছিলেন।

রাজা-বাদশাহরা যেখানে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনই সেখানে আরাম পান না। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে থাকতে চান, সাধারণ মানুষের মতো থাকতে চান। তাই ক্ল্যারিজ হোটেলের নাম শুনে বঙ্গবন্ধু কিছুটা নাখোশ হন। বলেন, ‘না, না এত দামি হোটেলে যাব না, আমার দেশের লোকজন আমাকে দেখতে আসবে, তাদের কাছাকাছি কোথাও আমাকে রাখো। ওরা যাতে স্বস্তি পায় এমন একটা হোটেলে নিয়ে যাও।’

ফরেন অফিসের কর্মকর্তা বলেন, স্যার একজন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে, রাষ্ট্রীয় সম্মান হিসেবে আমরা আপনাকে ক্ল্যারিজ হোটেলে নিচ্ছি। হোটেলে পৌঁছার কিছু সময়ের পর তৎকালীন লেবার পার্টির লিডার (পরে প্রধানমন্ত্রী) হ্যারল্ড উইলসন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। হ্যারল্ড উইলসন হচ্ছেন প্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সম্বোধন করেন। বঙ্গবন্ধুর দিকে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে তার প্রথম উচ্চারিত বাক্য ছিল, ‘গুড মর্নিং মিস্টার প্রেসিডেন্ট’।

২৯০ দিনের জেলজীবন শেষে লন্ডন এসেছেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাস বলছে পাকিস্তান কারাগারে তাকে হত্যার সব আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছিল, কিন্তু ওই সময়ে বিশ্বজনমত প্রবলভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ছিল, বিশ্বনেতারা দাঁড়িয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর পাশে। আর তাই তাঁর গায়ে আঁচড় কাটারও সাহস হয়নি পাকিস্তানের। তবে জেলজীবনের দুঃসহ অনিশ্চয়তায় যতটুকু যন্ত্রণা দেওয়া সম্ভব তার সবটাই ভোগ করেছেন বঙ্গবন্ধু। ৫১ বছর বয়সী শরীর এ চাপ সহ্য করার মতো শক্তি ছিল না কেবল মনের শক্তিতেই প্রাণবন্ত ছিলেন চিরপ্রাণোচ্ছল শেখ মুজিব। হোটেলে পৌঁছেও তিনি বিশ্রামের দিকে খুব মনোযোগী ছিলেন না অথবা বিশ্রাম করার সময়ও ছিল না তাঁর।

দুপুরেই ক্ল্যারিজ হোটেলে আয়োজন করা হয় এক সংবাদ সম্মেলনের। এটিই ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর প্রথম প্রেস কনফারেন্স। এতে আবেগঘন ভাষায় প্রবল আত্মবিশ্বাসী স্বরে তিনি বললেন, ‘আমি কনডেম সেলে ফাঁসির অপেক্ষায় ছিলাম, বাঁচব কি মরব কিছুই জানতাম না, তবে জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই।’ হোটেলের ভিতরে বক্তব্য রাখছেন বঙ্গবন্ধু, বাইরে তখন হাজারো বাঙালির ভিড়। ক্ল্যারিজ কর্তৃপক্ষ তো হতবাক। বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাজা-বাদশাহ, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এ হোটেলে আতিথেয়তা নিয়েছেন, তাদের কারও বেলায়ই এমন ঘটনা ঘটেনি, তাদের কাউকে ঘিরে এমন উন্মাদনা জাগেনি, যেভাবে জেগেছে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুখরিত অভিজাত মেফেয়ার এলাকা। দলে দলে আসছে মানুষ। কীভাবে তারা খবর পেল, কে দিল খবর?

কেউ কাউকে উদ্দেশ করে খবর দেয়নি, খবর রটে যায় কানে কানে, এখানে ওখানে। যারা বঙ্গবন্ধুকে দেখবেন বলে ছুটে আসছেন তাদের অনেকে আবার নিশ্চিত নন, সত্যি সত্যি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন কিনা; সত্যি সত্যি তিনি লন্ডন এসেছেন কিনা। তবু তারা আসছেন, শীত ভেঙে আসছেন, মেঘ-বৃষ্টি ভেঙে আসছেন। বঙ্গবন্ধুকে এক নজর না দেখার আগে যে তাদের আর শান্তি নেই! এত মানুষ দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া ক্ল্যারিজ কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ড. কামাল হোসেনকে নেমে আসতে হলো হোটেল গেটে। তার কাজ হলো, হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের সরিয়ে দেওয়া।

কিন্তু কে শুনবে কার কথা, সবার চোখ খুঁজছে কেবল বঙ্গবন্ধুকে। ‘তাকে চোখের দেখা না দেখে আমরা এক চুলও নড়ব না’, ভিড়ের ভিতর থেকে উঠে আসে এই অনমনীয় সিদ্ধান্তটি। যারা এই ভিড়ে দাঁড়িয়ে আছেন, তারা কেউ কাজ ফেলে এসেছেন। কেউ রেস্টুরেন্টের দরজা বন্ধ করে এসেছেন। কেউ গাড়ির ভিতর বাজার রেখে এসেছেন আবার কেউ কেউ বউ-বাচ্চা পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। এ রকম একটি পরিবারের এক শিশু যার মুখে বাংলা শব্দ শোনা যায়নি কখনো সেও তার বাবার মতো করে ‘বঙ্গবন্ডু’ ‘বঙ্গবন্ডু’ বলে স্লোগান দেয়। বাবা তাকে কাঁধে তুলে দেন। যদি বঙ্গবন্ধু একবার বাইরে আসেন তবে যেন এই শিশুটিকে দেখেন, ছেলেকে কাঁধে তুলে নেওয়ার পেছনে এটাই বাবার সুপ্ত উদ্দেশ্য। বাইরে ভিড়ের খবর ইতিমধ্যেই পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাকে না দেখার আগ পর্যন্ত যে ভিড় ভাঙবে না তা ভালোই জানেন তিনি। আর তাই হোটেলের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ান তিনি।  ভিড়ের ভিতর থেকে চিৎকার ওঠে, ‘ওই তো আমাদের বঙ্গবন্ধু’।

সমবেত জনতার  উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নাড়েন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে, ‘জয় বাংলা’। বাবার কাঁধে থাকা সেই ছোট ছেলেটি তখন আর সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দেয় না, সে অবাক হয়ে যায়, সে নীরব হয়ে যায়। কারণ সে দেখে তার বাবা কাঁদছেন। (ঘটনার ৪০ বছর পর সেদিনের সেই শিশুটি তার এই অসাধারণ স্মৃতির কথা জানায় এই নিবন্ধের লেখককে)। সেদিন কেবল ওই শিশুর বাবাই কাঁদেননি, বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পেয়ে এভাবে আরও বহু প্রবাসী বাঙালির চোখে জল এসেছিল।

বিকাল ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধু গেলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে। তাকে বরণ করে নিলেন কনজারভেটিভ পার্টির লিডার, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ। দুই রাষ্ট্রনায়কের মধ্যে বৈঠক হলো আন্তরিক পরিবেশে। বৈঠকের একপর্যায়ে এডওয়ার্ড হিথ জিজ্ঞাসা করলেন আপনাকে আর কী সহযোগিতা করতে পারি, বলুন?

তৎক্ষণাৎ বঙ্গবন্ধু উত্তর দিলেন, আপনার প্লেনটা চাই, ওটা দিতে পারবেন? আমি খুব দ্রুত দেশে ফিরতে চাইছি।

এডওয়ার্ড হিথ ব্যবস্থা নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বৈঠক চলা সময়েই নিশ্চিত হয়ে গেল ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট জেট বিমানে করে ৯ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেবেন জাতির জনক।

বৈঠক শেষে ঘটে একটা অভাবনীয় ঘটনা। বিদায় নিয়ে যখন বঙ্গবন্ধু তার গাড়িতে উঠবেন তখন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ নিজে এগিয়ে এসে তাঁর জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলেন, দরজা ধরে তিনি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ভিতরে গিয়ে না বসলেন। আর কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য, আর কোনো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এমন সম্মান দেখাননি কখনো, কস্মিনকালেও। ঘটনা নিয়ে তখন প্রধানমন্ত্রী হিথের সমালোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু এক বাক্যে সেই সমালোচনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন হিথ। বলেছিলেন, ‘আমি যাকে সম্মান করেছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাকে এই সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।’ ক্ল্যারিজ হোটেলে ফিরে এসেছেন বঙ্গবন্ধু। বাইরে তখনো উৎসাহী, উচ্ছ্বসিত কয়েকজন বাঙালি দাঁড়িয়ে আছেন। তারা সম্ভবত সারা রাত থাকবেন। পাহারার কোনো প্রয়োজন নেই, তবু তারা হয়তো রাত জেগে পাহারা দেবেন। বঙ্গবন্ধুকে অন্তত এক রাত পাহারা দিতে পেরেছেন এই গর্বও যে অনেক বড়!

সকাল হলেই বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পথ ধরবেন। তাকে বরণ করবে বলে সারা রাত জেগে আছে ৭ কোটি মানুষ। যখন দেশের মাটিতে পা রাখবেন তিনি সে হবে এক অভাবনীয় মুহূর্ত, ইতিহাসের অনন্য উপাখ্যান। তার আগে এই যে লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর এক দিন আর এক রাত সেও তো সোনার থালায় বাঁধা এক উজ্জ্বল সময়। একটা জাতি একবারই পায় এমন সোনার সময়, তারপর আর পায় না কিছুতেই।

            লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক জনমত।

সর্বশেষ খবর