মঙ্গলবার, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ওদের কি সামান্যতম লজ্জাও নেই

কামাল লোহানী

ওদের কি সামান্যতম লজ্জাও নেই

রক্ত স্বাক্ষরের সীমন্তিনী এই বাংলা। বায়ান্নতে এ মাটির সন্তানরা প্রাণ দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার মান রক্ষা করতে দ্বিধা করেননি। আমাদের জাতীয় মুক্তির সোপান রচিত হয়েছিল সেই রক্তলেখায়। যে পথরেখার প্রবল সংগ্রামে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে পৌঁছে গিয়েছিলাম হানাদার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে আত্মপ্রতিষ্ঠার গৌরবে বাংলাদেশ প্রায় অর্ধশতাব্দী পেরোতে যাচ্ছে, অথচ আজও আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে পারিনি। বাংলা মায়ের অবমাননার মধ্য দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছি। উল্টো দেশে পশ্চিমা অপসংস্কৃতি অনুপ্রবেশ করেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে।

ভাবলে অবাক লাগে, যে দেশ রক্ত দিয়ে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, সেই দেশেও আজ ভাষা সংগ্রামের ৬৭ বছর পরও বাংলাকে সর্বস্তরে ব্যবহারে অনীহা লজ্জাজনকভাবে দৃশ্যমান। রাস্তায় বেরোলেই আমাদের চোখ ঝলসে যায় দোকানপাটের নাম দেখে। শুধু কি তাই, ইংরেজি এমনভাবে সর্বত্র চেপে বসেছে যে, বাংলার অপমান বাড়িয়েই যাচ্ছে নিঃসংকোচে। স্কুল-কলেজ, বাড়িঘর, দোকানপাট, অফিস-আদালত, বেতার-টেলিভিশন কোথাও বাংলা ব্যবহারে কোনো তোয়াক্কাই নেই। প্রযুক্তি উন্নতির অগ্রযাত্রায় আমরা এগিয়ে চলেছি বটে কিন্তু মাতৃভাষাকে অবমাননা করে। আজ হোটেল, রেস্তোরাঁ, ক্লিনিক, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র, হাসপাতাল- সবাই যেন বিদেশি ভাষায় নিজেদের নাম লিখতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। বিশেষ করে দেখবেন, খাবার-দাবারের যেসব দোকান হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটতে, তার নাম সবাই ইংরেজিতে লিখছেন। ওদের কি সামান্যতম লজ্জাও নেই? ওরা বিদেশি নাম রাখছে আর ইংরেজিতেই নাম-পরিচয় লিখছে দেদার। পুঁজি খাটিয়ে মুনাফা লোটার এক ঘৃণিত উদ্যোগ। এসব রুখে দেওয়া উচিত ছিল। বাংলায় নাম লিখুন, বাংলায় পরিচয় লিখুন, তার সঙ্গে ইংরেজিতেও পরিচয় লিখুন, আপত্তি নেই।

কিন্তু প্রধান পরিচয় (সাইনবোর্ড) যা বাংলায় লিখতেই হবে, তার নিচেই ইংরেজিতেও পরিচয় লিখতে কেউ বাধা দেবে না। বাংলাকে বেপরোয়া বিসর্জন দিয়ে এই সাহেবি যারা দেখাচ্ছেন মুনাফালোভী, মাতৃভাষাবিরোধী, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্র এবং প্রধানত সরকারের দায়িত্ব। কেবল ‘একুশে পদক’ যাকে খুশি তাকে দিয়ে প্রতি বছর অনুষ্ঠান করলেই কি বাংলা ভাষা এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়? কেউ বা দাবি করবেন, একুশে ফেব্রুয়ারি তো এখন ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এর মর্যাদা পেয়েছে এবং বিশ্বের দেশে দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে, এ তো আমাদের বিরাট অর্জন। হ্যাঁ, তা তো বটেই, কিন্তু সেই আমরা কেন যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও বাংলাকে যথার্থ সম্মান ও শহীদদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে এবং সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ব্যবস্থা নিতে পারিনি?

যে কওমি মাদ্রাসা এত দিন পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ‘কারিকুলাম ও সিলেবাস’কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, নিজেদের ইচ্ছামতো তাদের নিয়ম ও নীতি অনুযায়ী সাম্প্রদায়িকতা শিক্ষা দিয়ে ধর্মান্ধতাকেই ছড়িয়ে এসেছে, তাদের সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার নাম করে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার ডিগ্রির সঙ্গে ‘একাকার’ করে দেওয়া হলো যে যুক্তিতে, সেখানে ১৬ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে কেন সর্বত্র চালু করতে ব্যর্থ হচ্ছেন? কয়েক লাখ কওমি কিশোর-যুবকের জন্য যে দরদ আমরা দেখালাম, তা মানসিকতার দিক থেকে ভালো বটে, কিন্তু তুলনামূলকভাবে ‘বাংলা’ কী অপরাধ করেছে যে বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েও কওমি মাদ্রাসার তালেবে এলেমদের মতো সহানুভূতি পাচ্ছে না।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন তো কখনই বলেনি বাংলা ছাড়া আমরা আর কিছু পড়ব না। ভাষার লড়াই শুরুই হয়েছিল সব ভাষা এমনকি আঞ্চলিক ভাষারও সমান মর্যাদার দাবিতে। তাঁরা তো ইংরেজি, আরবি, উর্দু বা অন্য কোনো ভাষা শেখা, বলা বা লেখার প্রতি কোনো অনীহা দেখাননি। তাহলে কেন নিজ মাতৃভাষা বাংলাকে এত অসম্মান করে চলেছি এই আমরা, যারা বাঙালি হিসেবে নিজ দেশকে মুক্ত করেছি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করে এবং সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারসহ অগণিত শহীদের প্রাণ বলিদানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে অর্জন করেছি।

দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তার সর্বজনীনতা ছিল বলে তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল সার্বিক। কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন হরেকরকম ‘ব্যবস্থা’ চালু হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি ভাষা ও ব্যবস্থার প্রাধান্য প্রকট হয়ে গোটা জাতিকেই এক ‘বেয়াড়া’ সম্প্রদায়ে পরিণত করেছে। বুঝলাম, এর কদর বিশ্বময়। তাই তো শিখতে বারণ কাউকেই করা হয়নি, হচ্ছেও না। কেবল মাতৃভাষার প্রতি দরদটা যেন যথার্থ থাকে, এটাই আমাদের দাবি। মনে রাখতে হবে, শহীদদেরও এটাই ছিল দাবি। যতই বর্তমানে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করা হোক না কেন, বাইরে বিদেশে পড়তে গেলে সেই দেশের ভাষা তাকে শিখতেই হবে, না হলে পড়াশোনা করতে দেওয়া হয় না। বিদেশ যে নিজ নিজ মাতৃভাষার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা করেছে, সে ক্ষেত্রে আমরা কেন নিজ মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি না। ক্রমে নিজ মাতৃভাষা বাংলাকে অবমাননাই করে চলেছি।

মুক্তিযুদ্ধের পর ৪৭ বছরেও আমরা কেন শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত স্বদেশের মতোন করে প্রচলিত করতে পারছি না। তার অন্যতম প্রধান কারণ, আমরা পরাশ্রয়ী। অন্যের যা-ই দেখি না কেন তা-ই শেখাটাকে অর্জন মনে করছি। নিজেদের ওদের কাছে খাটো করে দেখানোর মনমানসিকতা গড়ে উঠছে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে পরিবর্তন আনা উচিত ছিল তা হয়নি বলেই আজ দেশময় এ দুরবস্থা। এই যে শ্রেণিবিভাজন তৈরি হচ্ছে, এটাকে রাষ্ট্র না হলেও সরকার, যখন যে আসুক, তারা তাদের মতোন পূর্ব ব্যবস্থা অনুসরণ করেই চলছে। ফলে ইংরেজি, আরবি শিক্ষা যেন ক্রমে বিস্তৃত হয়েই চলেছে। একে রুখে দেওয়ার যে প্রগতিশীল শিক্ষা আন্দোলন পাকিস্তান আমলে সৃষ্টি হয়েছিল সেই মানসিকতা স্বাধীন ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে আজ আর নেই। শিক্ষাব্যবস্থা ক্রমে বিত্তশালীদের কবলে নির্যাতিত হলো এবং সন্তানদের বিদেশযাত্রী করার নিত্যপ্রয়াসে নতুন ব্যবস্থাকে সেই শিক্ষা দিয়ে বাইরে যাওয়ার উপযুক্ত বানাচ্ছেন। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরবি, উর্দু, ফারসি, পালি, সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা বহাল রয়েছে। কিন্তু অভিজাত শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর সেখানে যা কিছু হচ্ছে, তা কেবলই ইংরেজিতে হচ্ছে। ...সরকার যে-ই থাকুক না কেন, তারা এসব শিক্ষায়তন গড়ে তোলায় মনে হয় উৎসাহিত বোধ করে। ফলে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাঙের ছাতার মতোন গজিয়ে উঠেছে। হয়তো এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার মান উঁচু, মেনে নিচ্ছি। এর ফলে সংস্কৃতিও আক্রান্ত হয়েছে। আমার ভাবনা, এত উন্নতই যদি হবে অনুপ্রবেশকারী শিক্ষাব্যবস্থা তাহলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ডি এল রায়, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত সৃষ্টি হয় না কেন? রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্টি হয় না কেন? জগদীশ বসু, সত্যেন বোস, কুদরত-ই খুদা, আবদুল্লাহ আল মূতী জন্মাচ্ছে না কেন?

দেশের শোষণ-বঞ্চনা, শিক্ষা-সংস্কৃতির যথার্থ সংস্কার, নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা, সর্বজনীন শিক্ষা প্রবর্তন, জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাস জাতির নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ ইতিপূর্বে আকররূপে রচিত হয়েছে, তা থেকে অবিকৃত ইতিহাস রচনা জরুরি। এজন্য নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতি কমিশন গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন অপরিহার্য। শিক্ষার মাধ্যমকে একমাত্র বাংলায় প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মদের হাতে সঠিক ইতিহাস না দিলে আমরা যে ক্রমে সাম্প্রদায়িকতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছি। এ প্রবণতা চলমান রাজনীতিকে সুবিধা দিলেও জাতির যে ক্ষতি করছে তা শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসাবিদদের ভাবতে হবে। তাঁরা সরব হলে মুক্তিযুদ্ধকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দেওয়া রুখে দেওয়া যাবে। আমরা তো অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই চেয়েছিলাম। আজ কেন এই দুর্দশা? সরকার যদি দেশময় অসংখ্য মসজিদ ও ইসলামী সংস্কৃতি কেন্দ্র্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে অন্য ধর্মের নাগরিকদের কী হবে? তাদের কি ভাবতে বাধ্য করব, এ দেশ তো আমার নয়?

জাতির মৌলিক পরিচয় ভাষা। রাজনীতি, অর্থনীতির ভিত্তি হলো মানুষ। আর মানুষের কথা, ভাষা তার পরিচয়, সুতরাং জীবনধারণ ও যাপনের প্রয়োজনে মাতৃভাষাই হলো প্রথম সহজাত শিক্ষা, তাকে অবহেলা করলে জাতিকেই পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়। আজ সেই ‘সন্ত্রাস’ আমাদের আঁকড়ে ধরেছে। আমরা মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে পারলে ‘শৈবালদামে’ই কেলি করছি। সরকারকে বলব, এ তো আপনাদেরই দায়িত্ব, সঠিকভাবে শুদ্ধ মাতৃভাষা শিক্ষা দেওয়া। সেই সঙ্গে ভাষাসংগ্রামীদের সেই স্লোগান- সব আঞ্চলিক ভাষার সমান মর্যাদা চাই, মনে করিয়ে দিয়ে সাধুবাদ জানাই চলমান সরকারকে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত গ্রন্থপ্রকাশ ও লেখাপড়ার সুযোগ করে দিয়ে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করেছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠী আজও সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়নি। এ প্রশ্নে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি, বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরে চালুর দাবির সঙ্গে সঙ্গে।

                লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সর্বশেষ খবর