রবিবার, ২০ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাহুল গান্ধীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

রাহুল গান্ধীর নিরাপত্তা হুমকির মুখে

২০১৪ সালের মে মাসে ক্ষমতায় এসেই বিজেপি-আরএসএস প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র ভাই দামোদরদাস মোদি ঘোষণা করেছিলেন তার বুকের ছাতি ৫৬ ইঞ্চি। তাই তিনি কিছু ভয় পান না। তিনি যা চাইবেন তা-ই করবেন। তিনি দেশের জনগণের জন্য একগুচ্ছ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বিদেশের ব্যাংকে গচ্ছিত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের কালো টাকা ফিরিয়ে এনে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ করে জমা করে দেবেন। তার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের বেরোজগারি যুবক-যুবতীদের চাকরি দেওয়া। তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের কৃষকদের ঋণ মওকুফ করা। এর একটাও তিনি পালন করেননি। ফলে গোটা দেশ এখন ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। ভারতের যে সংবিধানের নামে তিনি প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন, কার্যক্ষেত্রে তার সব কটি তিনি ভঙ্গ করেছেন। বিরোধীরা তাকে চেপে ধরেছেন। তিনি পালানোর চেষ্টা করছেন।

তার কর্মকাল আর মাত্র তিন মাস বাকি। এ তিন মাসের মধ্যে সারা দেশে রাজনীতির চাপান-উতর যা দেখা যাচ্ছে তা স্বাধীনতার ৭০ বছরেও হয়নি। তিনি ক্ষমতায় এসেই গুজরাটি ব্যবসায়ীদের নানাভাবে কোটি কোটি টাকা পাইয়ে দিয়েছেন। সাংবিধানিক সংস্থাগুলো যেমন সিবিআই এনফোর্স মোস্ট ডাইরেক্টরেট, দেশের রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া তিনি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছেন। তার ঔদ্ধত্য ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোটবন্দী করে লাখ লাখ ছোট ব্যবসায়ীর টুঁটি টিপে মেরেছেন, দেনার দায়ে বহু ছোট প্রান্তিক ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেছেন। নোটবন্দীর পর ব্যাংকের সামনে লাইন দিতে গিয়ে কয়েক শ লোক মারা গেছেন। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন ভারতের লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট প্রকাশের আগে ১০০টি সভা করবেন। তাই তিনি সংসদে না এসে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দুটি করে সভা করছেন আর দেশের মানুষকে একগুচ্ছ মিথ্যা কথা বলে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। তার প্রতিশ্রুতি ছিল তিনি ‘কংগ্রেসমুক্ত’ ভারত গড়ে তুলবেন। গত বছরের শেষ দিকে হিন্দি বলয়ের তিনটি রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেস জয়ের পর এখন তিনি সভা-সমিতিতে বলছেন, নেহরু-গান্ধী পরিবারকে তিনি ভারত থেকে মুছে দেবেন, হিংসাশ্রয়ী মোদিজি এখন তাল সামলাতে পারছেন না, প্রতাপ কমে গেছে। তাই তার আক্রমণের একমাত্র লক্ষ্য হলেন রাহুল গান্ধী। সন্দেহ দেখা দিয়েছে ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধী, বাবা রাজীব গান্ধী ও কাকা সঞ্জয় গান্ধীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল- রাহুলের ব্যাপারে মোদি কি সেই পথেই হাঁটছেন? ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিজেপি ও আরএসএস নেতাদের প্রশ্ন করলেই তারা বলেন, দেখুন না রাহুলের কী হয়! কথাটা এড়িয়ে গেলেও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য মোদি, অমিত শাহরা সবকিছু করতে পারেন। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে এবং অমিত শাহ তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে যে ২২টি ভুয়া সংঘর্ষ দেখিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে শুরু করে তাদের বিরোধী অনেক সংখ্যাগুরু লোককেও তারা হত্যা করেছেন। বিষয়টি এত দিন চাপা পড়ে ছিল। কিন্তু চাপা দিলেই কি সব চাপা দেওয়া যায়? কারণ ভারতে একটি সংবিধান আছে, আইন-আদালত আছে।

তাই সম্প্রতি ভারতের শীর্ষ আদালতে ওই ২২টি ভুয়া সংঘর্ষের ব্যাপারে একটি মামলা রুজু হয়। মামলাটি করেছেন গীতিকার জাভেদ আখতার ও সাংবাদিক  ডারগিস। মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ওই ২২টি ভুয়া সংঘর্ষের তদন্ত রিপোর্ট গোপন রাখার জন্য শীর্ষ আদালতে চেষ্টার কসুর করেননি গুজরাট সরকারের আইনজীবীরা। কিন্তু শীর্ষ আদালত তাদের আরজি খারিজ করে দিয়েছে। ২০০২ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে ২২টি ভুয়া সংঘর্ষের অভিযোগ নিয়ে মামলা করেছিলেন গীতিকার জাভেদ আখতার ও সাংবাদিক ডারগিস, শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি এইচ এস বেদীর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি তৈরি হয় এবং তার রিপোর্ট মামলাকারীদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে শীর্ষ আদালত, সিবিআই ডিরেক্টর আলোক বর্মাকে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত খারিজ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বদের শীর্ষ আদালতে ধাক্কা খাওয়ায় বিরোধীরা কটাক্ষ করেন- প্রধানমন্ত্রীর সময়টা বোধহয় এখন ভালো যাচ্ছে না, এ অবস্থা দেখে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য নারীদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও সংরক্ষণের কথা মোদি বললেও আসলে অস্বস্তি তিনি এড়াতে পারছেন না। ২০০২ থেকে ২০০৬-এর অনেকটা সময় অমিত শাহ ছিলেন গুজরাট রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। গুজরাট সরকারের দাবি ছিল কোনোভাবেই সংঘর্ষের তদন্ত রিপোর্ট মামলাকারীদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। কারণ সেই রিপোর্ট সংবাদমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যাবে। আর ভোটের আগে এ নিয়ে নতুন করে গণ্ডগোল শুরু হলে মোদি ও অমিত শাহকে বিপদে পড়তে হতে পারে। প্রায় পৌনে পাঁচ বছর মোদি দেশের ও বিদেশের কোনো সাংবাদিকের মুখোমুখি হননি। বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি বিজেপিঘনিষ্ঠ একটি টিভি চ্যানেলে ৯০ মিনিট ধরে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। রাজধানীর রাজনৈতিক মহলের খবর- প্রশ্নগুলো লিখে দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেই। এ সাক্ষাৎকারে মোদি ও অমিত শাহের প্রচার ছাড়া বিশেষ কিছু দেশবাসী পায়নি। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সংসদের উভয় কক্ষে বিরোধীরা প্রশ্ন তুললে মোদি তার কোনো জবাবও দেননি। কিন্তু রাফাল দুর্নীতিকাণ্ডে বহু গুজরাটি ব্যবসায়ী অনিল আম্বানিকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঘুষ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলে কংগ্রেস সভাপতি যখন তোলপাড় করছেন তখন গেরুয়াবাহিনী তার জবাব না দিয়ে মিথ্যা, ভুয়া, অসত্য অভিযোগ এনে পাল্টা আক্রমণ করছে। ইন্দিরা গান্ধীর নাতিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তিনি প্রমাণ করেছেন দেশের চৌকিদার চোর। রাহুল গান্ধীও বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে যুদ্ধবিমান রাফাল দুর্নীতিকাণ্ডের নেতা মোদিকে সরাসরি আক্রমণ করে জনগণের সামনে সব দুর্নীতি তুলে ধরছেন।

নির্বাচন এসে গেছে, আগামী তিন মাসের মধ্যে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তা-ও জনগণ বুঝে গেছে। তাই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা মনে করছেন গোটা দেশে আজ মোদি-অমিত শাহ জুটি বিপন্ন। ভারতে এখন খবরের বিরাম নেই। রিজার্ভ ব্যাংকের প্রাক্তন গভর্নর রঘুনাথ রমনাজন ও মোদির সাবেক আর্থিক উপদেষ্টা সুব্রামানিয়াম বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলছেন, গোটা দেশ আজ বিপন্ন, কী আর্থিক কী সামাজিক, কী নিরাপত্তা- সব দিক দিয়েই রাজ্যে রাজ্যে মোদি কাহিনী প্রচার করার জন্য ইতিমধ্যে লাখ লাখ হাজার কোটি টাকা খরচ করে চলেছে মোদি সরকার। মোদি সরকারের প্রবীণ মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি আরএসএসের ঘনিষ্ঠ হলেও সোজাসাপ্টা কথা বলেন। গত ১৫ দিনে তিনি অন্তত ১০টি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশে কোথাও কাজ নেই। মোদির কী দরকার ছিল ২০১৪ সালে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার? বিদেশ থেকে কালো টাকা আনার প্রতিশ্রুতিরও কোনো প্রয়োজন ছিল না। গড়কড়ি একসময় বিজেপিরও সভাপতি ছিলেন।

ছিঃ, মোদি কোনো কাজ করেননি এ কথা যারা বলছেন তারা ঠিক বলছেন না, মোদি অনেক কাজ করেছেন। তিনি বেকার যুবক-যুবতীদের পকোড়া ও তেলে ভাজা বিক্রির নির্দেশ দিয়েছেন। আর কী করেছেন তা একবার দেখা যাক- গোমাংস খাওয়ার জন্য গো-হত্যাকারীদের হত্যা এক বছর ধরে তার দল এবং তিনি অনুমোদন করে চলেছেন। তারা এখন বুঝিয়েছেন যে, গোমাতার চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য কম, কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, গবাদিপশু তথা গরুও খাদ্যের সন্ধানে নিত্য শহরের আবর্জনার স্তূপে স্তূপে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রশ্ন হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভীতসন্ত্রস্ত করে সত্যি কি গরুদের হত্যার হাত থেকে বাঁচানো যাচ্ছে? নাকি এটা শাসকের ছাতার নিচে থেকে এক ধরনের গুণ্ডামি?

প্রসঙ্গত বলা যায়, গরুর মাংস মনে করে যেসব মাংসের নমুনা পরীক্ষার জন্য হায়দরাবাদ রিসার্চ সেন্টারে পাঠানো হয়েছিল তার ৯৩ শতাংশ গরুর মাংস ছিল না। সুতরাং বলা যায়, গোমাংসের পরীক্ষা-নিরীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতে একটা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই প্রচলিত বিধি কিন্তু ব্যাপারটা যে স্বাভাবিক নয় তা বোঝা যায় যখন শাসক কাঠামোর পছন্দের শোবয় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়া যোগী আদিত্যনাথ নিজেই সাম্প্রদায়িক চ্যালেঞ্জের ভিত্তিতে মেরুকরণের প্রধান উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেন। নির্বাচনের আগে এসব প্রশ্ন এখন ভারতীয় ভোটারদের মনে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এর উত্তর ভারতের জনগণই দেবে নির্বাচনের ভোটবাক্সে। উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালে দক্ষিণ ভারতে নির্বাচনী প্রচারে গেলে রাজীব গান্ধীকে হত্যা করা হয়। তাই বিরোধীরা দাবি তুলেছে রাহুলের নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে। কারণ মোদি যেভাবে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণ করে গেরুয়াবাহিনীকে খেপিয়ে তুলছেন তা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর