সোমবার, ২১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

অচল রাজনীতি নিয়ে বিএনপি সচল হতে পারবে না

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

অচল রাজনীতি নিয়ে বিএনপি সচল হতে পারবে না

ড. কামাল হোসেনের ঐক্যফ্রন্ট গঠন, বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া এবং নির্বাচনের প্রাক্কালে তার আচরণ ও কথাবার্তা মানুষ একদম ভালোভাবে নেয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মনে হয়েছে তিনি অসুস্থ মানুষের মতো আচরণ করছেন। নির্বাচনের  দুই-তিন দিন আগে ভারতের একটা পত্রিকার সঙ্গে কথা বলার সময় বললেন, জামায়াতকে ধানের শীষ দেওয়া হয়েছে- জানলে তিনি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতেন না। অথচ প্রার্থী প্রত্যাহারের শেষ দিন ও প্রতীক বরাদ্দের পর অর্থাৎ ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সবাই এ বিষয়টি জানতেন পত্রপত্রিকা হেডলাইন হওয়ার কারণে। বাস্তবেও দেখা গেছে জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন। সব জেনেও নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে, এত দেরিতে কেন ড. কামাল হোসেনের এমন বোধদয় হলো সেটি তখন বোঝা না গেলেও এখন কিন্তু স্পষ্ট। বিএনপির ভূমিধস পরাজয়ের অন্যতম একটি বড় কারণ জামায়াতের ২২ জন সিনিয়র নেতাকে ধানের শীষ প্রতীক প্রদান করা। ড. কামাল হোসেনের দেশি-বিদেশি পরামর্শদাতারা হয়তো তাকে বুঝিয়েছিলেন বিএনপিকে নির্বাচনে ধরে রাখতে পারলেই বাজিমাত হয়ে যাবে। তাতে নির্ঘাত আওয়ামী লীগ পরাজিত হবে এবং তার বহুদিনের ইচ্ছা শেখ হাসিনাকে দেখে নেওয়ার আশাটি পূর্ণ হবে। কিন্তু ভোটের এক সপ্তাহ আগে বিশ্বের বড় বড় মিডিয়া হাউস এবং জরিপকারী সংস্থা থেকে যখন পূর্বাভাস আসা শুরু হলো যে, শেখ হাসিনা ও তার দল বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরছেন, তখন নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে পরাজয়ের দায়-দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে বিএনপির কাঁধে তুলে দেওয়ার একটা জানালা তিনি খুলে রাখলেন এই বলে যে, জামায়াত জোটে আছে জানলে তিনি তাতে থাকতেন না। বিএনপির তখন আর কিছু করার ছিল না। এ নিয়ে বিএনপি একটি উচ্চবাচ্যও করেনি। কারণ, ড. কামাল হোসেনের ওপর সোয়ার হয়ে বিএনপি নির্বাচনে নেমেছে এই কারণে যে, অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের শূন্য গ্রহণযোগ্যতা যদি ড. কামাল টেনে একটু উপরে উঠাতে পারেন এবং তার বিদেশি লবি ব্যবহার করে সরকারকে যদি একটু বেশি চাপে রাখতে পারেন তাহলে বিএনপি অনেকটা সুবিধা পাবে। তা না হলে বিএনপি হয়তো নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিত না অথবা মাঝপথে নির্বাচন থেকে সরে যেত, যেমনটি শোনা গিয়েছিল মওদুদ আহমদ ও বরকতউল্লা বুলুর ফাঁস হয়ে যাওয়া ফোনালাপের কথাবার্তার মাধ্যমে। ড. কামাল হোসেন তার বিদেশি কানেকশনের মাধ্যমে বিএনপিকে কতটুকু উপকার করতে পেরেছেন জানি না। তবে এতটুকু বোঝা যায়, বিএনপি নামক দলটি দেশের ভিতরে যেমন, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তেমন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে তাদের অতীত কর্মকাণ্ড ও ভ্রান্ত রাজনীতির কারণে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে রাজনীতির আদর্শ ও কৌশল পরিবর্তন না করা পর্যন্ত কয়েক ডজন ড. কামালের ওপর সওয়ার হয়েও কাজ হবে না। কয়েক দিন আগেও ড. কামাল আবার বলেছেন, জামায়াত থাকবে জানলে তিনি বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতেন না। এও বলেছেন, আগামীতেও তিনি জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করবেন না। এত দিনে বাংলাদেশের মানুষ বুঝেছে, বিএনপি বর্তমানে পাকিস্তানি মতাদর্শের যে রাজনীতি করছে তা অব্যাহত রাখতে চাইলে জামায়াতকে তারা ছাড়তে পারবে না। কারণ, বিএনপির লন্ডনি নেতা জামায়াতকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত সহজে নিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে। সুতরাং ড. কামাল আর বিএনপির হানিমুন পিরিয়ড শেষ। আনুষ্ঠানিক বিচ্ছেদের ঘোষণা কখন আসবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমি বলে থাকি প্রত্যেকটি মন্দ ঘটনার মধ্যে কিছু না কিছু ভালো দিকও থাকে। বিএনপির কাঁধে চড়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার যে হ্যালিউসিনেশন বা মতিভ্রমে ড. কামাল ছিলেন এবং বিএনপি ড. কামালের ওপর ভর করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার যে ভ্রান্ত হিসাব কষেছিলেন তাতে বাংলাদেশের অন্তত একটা বড় উপকার হয়েছে। ব্যাপক ও সার্বিক অংশগ্রহণমূলক একটা ভালো নির্বাচন হয়েছে, যার খুবই প্রয়োজন ছিল এ সময়ে। নির্বাচন নিয়ে ড. কামাল হোসেন ও বিএনপির যে সব অভিযোগ তা অচিরেই বুড়িগঙ্গার দূষিত জলের নিচে পড়ে মারা যাবে। কেউ তাতে কর্ণপাত এ পর্যন্ত করেনি, আগামীতেও করবে না। যেখানে ২০১৪ সালের নির্বাচনকে তারা অগ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে বিপুলভাবে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এবং সব দলের অংশগ্রহণমূলক ২০১৮ সালের নির্বাচনকে তারা অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এমনটা কেউ বিশ্বাস করে না। মানুষের ধারণা শেষ পর্যন্ত হারাধনের সাতটি ছেলে নিয়েই বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট সংসদে যোগ দেবে। তাদের হাতে অন্য কোনো রাজনৈতিক বিকল্প নেই। ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব এবং এনাদের আরও যে কয়জন সঙ্গী আছেন তাদের আগামী দিনের রাজনৈতিক ভূমিকা বা কার্যকলাপ নিয়ে মানুষ মোটেই ভাবে না। কারণ ভাবার মতো গ্রাউন্ড তারা তৈরি করতে পারেননি। কিন্তু আগামীতে বিএনপির রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাববার কারণ এখনো রয়েছে। এখনো তাদের একটা ভোট ব্যাংক এবং সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে, যা আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেই। একটি রাজনৈতিক দল যেসব উপাদানের জন্য দীর্ঘদিন টিকে থাকে, ঐতিহ্য সৃষ্টি করে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি উপাদান বা ফ্যাক্টর হচ্ছে দলের অনুসৃত রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ এবং শীর্ষ নেতৃত্বের যোগ্যতা, প্রজ্ঞা ও গ্রহণযোগ্যতা। এই দুটি জায়গায়ই বিএনপির জন্য অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমেই নেতৃত্বের কথায় আসা যাক। তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্ব দেওয়ার অক্ষমতা এবং অগ্রহণযোগ্যতা নগ্নভাবে ধরা পড়ে যখন তারা ড. কামাল হোসেনের কাছে ধরনা দেয়। তাদের নেতৃত্বের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আরও আগে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যখন তারা দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করল এই মর্মে যে, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিও দলের নেতৃত্ব দিতে পারবেন। দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয়ে বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘ মেয়াদে সাজা ভোগ করছেন জেলের ভিতরে। দশ বছর মামলা চলেছে, বিএনপি আইনের সর্বোচ্চ সুযোগকে ব্যবহার করেছে এবং তার মধ্য দিয়েই বেগম খালেদা জিয়ার শাস্তি হয়েছে। হাই কোর্ট ইতিমধ্যেই শাস্তি নিশ্চিত করেছে। সুতরাং এই দণ্ড থেকে বেগম খালেদা জিয়া অচিরেই মুক্তি পাবেন এবং জেলের বাইরে আসবেন এমন সুযোগ নেই বললেই চলে। তাতে বোঝা যায়, বেগম খালেদা জিয়া আর বিএনপির জন্য সক্রিয় নেতৃত্ব দিতে পারবেন না। শূন্য চেয়ারের দিকে আর কতদিন নেতা-কর্মীরা তাকিয়ে থাকবেন। তারপর তারেক রহমান পলাতক অবস্থায় লন্ডনে বসে যেভাবে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা আর কতদিন চলবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা একেবারে শূন্য। দেশের ভিতরে বিএনপির অন্ধ অনুসারী ব্যতীত তাদের সমর্থক সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের কাছেও তারেক রহমানের গ্রহণযোগ্যতা নেই। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের সময় এবং গণমাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আগামীতে বিএনপির জন্য কার্যকর নেতৃত্ব দিতে পারবেন না।

নেতৃত্বের এমন ভয়ঙ্কর দুর্বলতার সঙ্গে দলের আদর্শগত অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একেবারে সম্পূর্ণ উল্টো হওয়ায় ক্রমশই বিএনপি তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম ও একাত্তরের মু্িক্তযুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত পাকিস্তানি মতাদর্শের রাজনীতি, যেটি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না তা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে। এতদিন বিএনপি যে রকম ধূম্রজাল সৃষ্টি এবং অসত্য প্রপাগান্ডা চালিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির ভিতর রাখতে পেরেছে তা আর আগামীতে সম্ভব হবে না। জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছে বলে তারাও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল এমন বিভ্রান্তিকর কথায় আর কাজ হবে না। মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় সেটি এতদিন মানুষ বুঝে ফেলেছে। যারা একাত্তরের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে অস্বীকার করে এবং জাতির পিতার প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মান দেখায় না তারা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী দল হতে পারে না, এটা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। হাজার বছরের শেকড়ের বন্ধন বাঙালি সংস্কৃতিপ্রসূত বাঙালি জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার এবং মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের মতো বিশ্বজনীন আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি বাংলাদেশে আর কতদিন রাজনীতি করবে। বিএনপিকে টিকে থাকতে হলে শুধু বাংলাদেশের ভিতরের বাস্তবতা নয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতাকে আরও বেশি করে উপলব্ধি করতে হবে। তথাকথিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, যার কোনো ভিত্তি নেই, শেকড়, ঐতিহ্য, ইতিহাস নেই তার দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে এক সময়ে বিভ্রান্ত করা গেলেও সেদিন এখন আর নেই। ধর্মাশ্রয়ী, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, জামায়াতের মতো চিহ্নিত গণহত্যাকারী উগ্র ওয়াহাবিবাদী দলকে সঙ্গে নিয়ে তারা কোনো দিনই আধুনিক ও উদারনৈতিক বিশ্বের সমর্থন পাবে না। বিএনপিকে আমলে নিতে হবে মানব সভ্যতা এখন একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে পদার্পণ করতে যাচ্ছে, সেখানে গত শতকের সাতচল্লিশের দ্বি-জাতিতত্ত্বের চেতনা নিয়ে এগোনো যাবে না। ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহু আগেই বিএনপিকে জামায়াত ছাড়তে বলেছে। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদে প্রস্তাব উঠেছে, জঙ্গি সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াতের রাজনীতি যেন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। কারণ জামায়াত বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি। ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক স্লোগানে বাংলাদেশের মানুষকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না, এটা বোধহয় বিএনপিও কিছুটা বুঝতে পেরেছে। এবারের নির্বাচনে তারা আগের মতো ভারতবিরোধী স্লোগান দেয়নি, ধর্মীয় ফতোয়া ছাড়েনি।

সুতরাং জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রবর্তিত রাজনীতি বিশ্ব অঙ্গনে অগ্রহণযোগ্য এবং বাংলাদেশে অচল। সুতরাং এই অচল রাজনীতি নিয়ে বিএনপি আর সচল হতে পারবে না।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর