রবিবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কোন পথে এগোবে বাংলাদেশের পর্যটন

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

কোন পথে এগোবে বাংলাদেশের পর্যটন

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত। এ দেশের উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্র প্রতিফলিত হয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকের ধারাবাহিক অগ্রযাত্রার মাধ্যমে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এ মুহূর্তে আমাদের দারিদ্র্যের হার ২১% এবং গড় আয়ু ৭৩ বছর। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৭৫২ ডলার এবং জিডিপি ৭.৮৬%। পর্যটন শিল্পের অবদান বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৪.৩% এবং সরাসরি প্রায় ১৩ লাখ লোক এ কাজে জড়িত। পর্যটনই একমাত্র শিল্প যা কোনো রাষ্ট্রের সামাজিক ও পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটায়।

পর্যটন শিল্প হতে পারে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটি হাতিয়ার। এটি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে না বরং নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তাবিধানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। পর্যটন একটি শ্রমঘন শিল্প। এ শিল্পটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির একটি দ্রুততম ও ক্রমবর্ধমান খাত হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং সেই সঙ্গে আঞ্চলিক ও জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য স্বীকৃত হয়েছে। অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনয়নে ও অন্য শিল্পসমূহের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পর্যটন শিল্প উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ব্যাপক সফলতা বয়ে আনছে। গবেষণায় প্রতীয়মান হয়, এ শিল্পটি ১০৯টি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

বাংলাদেশে পর্যটনের যাত্রা অনেক আগে হলেও নানা প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে আজকে আশার আলো ছড়াচ্ছে; যার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাসমূহের নৈমিত্তিক কর্মপরিকল্পনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপার সম্ভাবনাময় আমাদের এ বাংলাদেশ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার একটি আদর্শ পর্যটন ক্ষেত্র। এটি শুধু অর্থনৈতিক চাকাকেই সচল করবে না, সেই সঙ্গে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। বাংলাদেশ পর্যটন পুলিশের তথ্যমতে, এ দেশে প্রায় ৮০০-এর বেশি পর্যটন স্থান রয়েছে। এসব স্থানকে সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত করা হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ শিল্পটি ব্যাপক ভূমিকা পালন করবে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম অ্যান্ড ট্রাভেল কাউন্সিলের প্রতিবেদন মোতাবেক ২০১৭ সালে পর্যটন খাত বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মোট কর্মসংস্থানের শতকরা ৩ দশমিক ৮ ভাগ অবদান রাখে। অন্যদিকে মোট জিডিপিতে শতকরা ৪ দশমিক ৩ ভাগ অবদান রাখে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) হিসাব অনুযায়ী, বছরে ১ কোটি দেশীয় পর্যটক দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ান। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন নাগরিকদের পর্যটনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধ ও আধুনিক অর্থনীতিনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে বর্তমান সরকার ‘ভিশন ২০২১’ লক্ষ্য স্থাপন করেছে। তার প্রতিফলনস্বরূপ ডিজিটাল বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সুস্পষ্টরূপে তুলে ধরেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্যে শিক্ষা খাতের উন্নতি, স্বাস্থ্যসুবিধার উন্নতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং চূড়ান্তভাবে দারিদ্র্যসীমা হ্রাস করা, প্রতিটি ধাপে তথ্যপ্রযুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা এগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এগুলো পর্যটন শিল্প বিস্তারের সঙ্গে অর্জনের দিক থেকে সামান্তরিক। অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মতো পর্যটন হতে পারে ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের একটি নিখুঁত হাতিয়ার। এটি এমন একটি শিল্প যা সমাজের সব নাগরিকের ওপর বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সঙ্গে সঙ্গে ২০২১ সালের লক্ষ্য অর্জনে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হবে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে পর্যটন শিল্পের বিকাশ হতে পারে একটি আদর্শ ক্ষেত্র, কেননা প্রশিক্ষণের জন্য কম অবকাঠামোগত সুবিধা ও দক্ষতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ এ শিল্পে আগ্রহ বেশি সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ‘পর্যটন আইন, ২০১০’-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) গঠন করেছে। এরই সঙ্গে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের পর্যটন প্রসারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে পর্যটকদের আবাসন ও সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে গত ১০ বছরে মোট ২৫টি পর্যটন মোটেল, হোটেল ও রেস্তোরাঁ গড়ে তুলেছে। আর এই নিজস্ব স্থাপনাগুলো ছাড়াও পর্যটন সেবা দিতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেবার মান বাড়াতে নিয়মিতভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করে আসছে এবং সেই সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে পর্যটন করপোরেশনের নিয়ন্ত্রিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে পর্যটনের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকারের গৃহীত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার পদক্ষেপগুলো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

বর্তমানে পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে আসছে; যার ফলে পর্যটন শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এসব উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সাগরের পাড় বেঁধে ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ অন্যতম। এর ফলে দেশি-বিদেশি পর্যটকের কাছে পর্যটননগর কক্সবাজারের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণে কক্সবাজারে তিনটি পর্যটন পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করেছে বর্তমান সরকার। প্রতি বছরে এতে বাড়তি ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ তিনটি ট্যুরিজম পার্ক হলো সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক ও সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক। এসব স্থানে প্রায় ৪০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপ বিশেষ করে নাফ ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার ঘোষণা পর্যটন বিকাশকে ত্বরান্বিত করবে। কারণ এতে বিনিয়োগ করছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কোম্পানি সিয়াম সিয়াম ইন্টারন্যাশনাল। প্রাথমিকভাবে কোম্পানিটি ৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। ২৭১ একর জায়গাজুড়ে প্রায় ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি ১২ হাজারের বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগাবে। আর এ নাফ ট্যুরিজম পার্ক উন্নয়নের প্রকল্প ব্যয় ১৭০ কোটি টাকা এবং এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২০১৯ সাল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) নাফ ট্যুরিজম পার্কের উন্নয়ন কাজ হাতে নিয়েছে। অন্যদিকে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। অন্যদিকে সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে বেজা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় করছে। এ ছাড়া কক্সবাজারের টেকনাফে প্রস্তাবিত নাফ ও সাবরাং ট্যুরিজম পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ শতাংশ সুদে ঋণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে এ ঋণ নেবে বেজা। যে কোনো ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পাদনের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ব্যবহার পারে টেকসই উন্নয়ন সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে। তাই গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণ নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছরেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হইনি পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে। তবে বর্তমান বছরগুলোয় সরকারসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটনকে অর্থনৈতিক একটি কার্যকর খাত হিসেবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়েছে। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশে গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পর্যটনের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাসহ বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত অনুমোদন দিচ্ছে।

বাংলাদেশের উন্নয়নযাত্রায় পর্যটন শিল্পের সংযোজন শুধু আর্থিক সুফলতা বয়ে আনবে না, সেই সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ে এর সুফল ছড়িয়ে দেবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্প বাংলাদেশের জন্য হয়ে উঠতে পারে অন্যতম হাতিয়ার। এজন্য প্রয়োজন সরকারের উন্নয়ন ভাবনায় পর্যটন শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।

লেখক : চেয়ারম্যান,  ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

 

সর্বশেষ খবর