শিরোনাম
সোমবার, ২৮ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

লোপেজ ওব্রাদার এবং আমরা

মহিউদ্দিন খান মোহন

লোপেজ ওব্রাদার এবং আমরা

গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিন ল্যাটিন আমেরিকার দেশ মেক্সিকোর বর্তমান প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদার-এর ওপর যে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা নজর কেড়েছে প্রায় সবার। পাতাজুড়ে মেক্সিকান এ রাষ্ট্রপ্রধানের জীবনযাত্রা, রাজনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ এবং চিন্তাভাবনার যে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে, তা কৌতূহলী পাঠকদের মনোযোগ এড়াতে পারে না। প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাক্সিক্ষত পদটিতে আসীন হওয়ার জন্য লোপেজ ওব্রাদারের দীর্ঘ সংগ্রাম এবং ধৈর্যের কথাও। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তাকে পার হতে হয়েছে অনেক চড়াই-উৎরাই। মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতি। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও তিনি হেরেছেন একাধিকবার। প্রেসিডেন্ট পদেও একই ঘটনা ঘটেছে। অবশেষে ২০১৮ সালের ১ জুলাই দেশটির মোট ভোটারের ৫৩ শতাংশের সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন তিনি। না, তার এ রাজনৈতিক জীবন বা প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠান মানুষকে ততটা চমকিত করেনি। এমনটি সারা পৃথিবীতে অনেকই ঘটে। আমাদের বিস্মিত করেছে তার সততার দিকটি। প্রতিবেদনটিতে ওব্রাদারের যে সহায়-সম্পদের বিবরণ দেওয়া হয়েছে, তাতে অবাকই হতে হয়। সম্পদের প্রতি নির্মোহ এ রাজনীতিকের নেই গাড়ি, বাড়ি বা ক্রেডিট কার্ড। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি দেখিয়েছেন তার প্রায় শূন্য মানিব্যাগ, যাতে ছিল মাত্র ২০০ পেসো যা ১০ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। আর ছিল ২ ডলারের একটি বিল যেটি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী এক মেক্সিকান তাকে দিয়েছিল ‘সৌভাগ্য কবচ’ হিসেবে। 

লোপেজ ওব্রাদারের সম্পদ অনুসন্ধান করে উল্লেখযোগ্য কিছুই পাওয়া যায় না। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তিনি সম্পদের যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে তার দুটি ব্যাংক হিসাবের উল্লেখ আছে, যাতে মোট জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২৩ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ মেক্সিকান পেসো। স্ত্রীর নামে একটি গাড়ি আছে যেটি ব্যবহার হয় পারিবারিক কাজে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি মাসিক ভাতা পান ১ লাখ ৮ হাজার ৭৪৪ পেসো, যা ৫ হাজার ৬০০ মার্কিন ডলারের সমান। ব্যক্তিগত সম্পদ বলতে তার একটি খামার রয়েছে, তাও দিয়ে দিয়েছেন ছেলেদের নামে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্ত্রী বিয়াত্রিজ গুতিয়ারেস মুলারের চেয়ে সম্পদ কম প্রেসিডেন্ট লোপেজ ওব্রাদারের। স্ত্রীর রয়েছে তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যেগুলোতে সর্বমোট জমা আছে প্রায় ৭২ হাজার ডলারের সমপরিমাণ পেসো। এ ছাড়া তিনটি গাড়ি, একটি বাড়ি, একটি অ্যাপার্টমেন্ট এবং দুটি বিশালাকৃতির জমি রয়েছে।

চমক আরও আছে। যেখানে আমরা দেখি দায়িত্ব পালনরতরা নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন সেখানে মেক্সিকান এ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় এসেই কমিয়ে দিয়েছেন নিজের বেতন। ওই দেশের নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের বেতন-ভাতা ২ লাখ ৭০ হাজার পেসো। ওব্রাদার তা ৬০ শতাংশ কমিয়ে করেছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৭৪৪ পেসো। এরপর তিনি ঘোষণা দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্টদের ব্যবহৃত বিলাসবহুল ৬০টি উড়োজাহাজ ও ৭০টি হেলিকপ্টার নিলামে বিক্রি করে সেই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করবেন। বর্তমান সময়ে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদার যে ব্যতিক্রম এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানদের কিংবা তাদের মন্ত্রী-এমপিদের দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজের খবর প্রতিনিয়ত সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে, সেখানে একজন লোপেজ ওব্রাদার একদম আলাদা তো বটেই। এ ব্যতিক্রমী প্রেসিডেন্টের উদাহরণ সামনে রেখে আমাদের দেশের দিকে তাকালে বুকের গভীর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাসই বেরিয়ে আসবে। প্রেসিডেন্ট ওব্রাদার নিজে যতটা সৎ এবং নির্লোভ তার সহকর্মীরা ততটা কিনা তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। তবে, ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে’-চীনা এ প্রবাদটি স্মরণে রেখে এটা বলা যায় যে, ওব্রাদার যদি তার সহকর্মীদের নিজের পথে চালিত করতে পারেন তাহলে মেক্সিকো থেকে দুর্নীতি দূর হওয়া হয়তো কঠিন হবে না।

লোপেজ ওব্রাদার বর্তমান সময়ে একজন ব্যতিক্রমী রাজনীতিক সন্দেহ নেই; যিনি তার মেধা, শ্রম, আর ভাবনাকে ব্যয় করেছেন দেশ ও জনগণের কল্যাণ চিন্তায়। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি মেক্সিকোর মেয়রও ছিলেন। তিনি যদি ব্যক্তিগত বিত্তবৈভব অর্জনের দিকে মনোযোগ দিতেন, তাহলে একজন বিলিয়নিয়ারে পরিণত হওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। অথচ তিনি সে পথে হাঁটেননি। আর আমাদের দেশে সিটি কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের অনেকেই আছেন, যারা একবার নির্বাচিত হয়ে হাতে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। আঙ্গুল ফুলে বনে যান বটগাছ! কীভাবে তারা এমন রাতারাতি ধনকুবেরে পরিণত হন সে রহস্য কারও অজানা নেই।

বাংলাদেশ প্রতিদিন এমন একটি দিনে ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, যে দিনটি এ দেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় একটি দিন। এই দিনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তমানব হয়ে ফিরে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনিও বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনা আছে। মত ও পথের ভিন্নতার কারণে এ ধরনের সমালোচনা অস্বাভাবিক নয়। তাঁর সহকর্মী-সহচরদের কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতি বা অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ ছিল। কিন্তু একজন বঙ্গবন্ধু ছিলেন এসবের বাইরে। অর্থ-বিত্তের প্রতি তাঁর নির্মোহ মনোভাবের কথা অবিতর্কিত ও সর্বজনবিদিত। সহায়-সম্পদ গড়ার কোনো মনোবৃত্তিই তাঁর ছিল না। তিনি ভেবেছেন এদেশ ও মানুষের কথা। আর মানুষের কথা যারা ভাবেন, তারা যে নিজের সুখ-সুবিধার কথা ভাবার চিন্তাও করেন না-বঙ্গবন্ধু তার উদাহরণ হতে পারেন। জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের আরেকজন সাবেক রাষ্ট্রপতি। তার বিরুদ্ধবাদীরা তার রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন, দল গঠন, স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের রাজনীতির সুযোগ দেওয়া-ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচনা করে থাকেন। সেসব অভিযোগ সর্বাংশে সত্য বা অসত্য কিনা সে বিতর্ক এখানে তুলব না। তবে, তার চরম শত্রুও তার ব্যক্তিগত সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত এ রাষ্ট্রপ্রধানের কোনো কোনো স্বজনের বিরুদ্ধে অসততার অভিযোগ থাকলেও তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এখন পর্যন্ত কেউ তুলতে পারেনি। আমরা যাদের রাজনীতির ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বপুরুষ বলে থাকি, তারা কি অর্থবিত্তের মোহে পড়ে নিজেদের নীতি-নৈতিকতাকে বিসর্জন দিয়েছেন? হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী-তারা কি কখনো দেশ ও জনগণের বাইরে আত্মস্বার্থের কথা ভেবেছেন? তাদের রাজনৈতিক কর্মকা-, বক্তব্য-ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্থাৎ অর্থবিত্ত অর্জনের জন্য তারা তাদের রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করেছেন-এমন কোনো নজির নেই। আফসোস হয়, এমন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হয়েও আমরা আজ পরিচিত দুর্নীতিপরায়ণ জাতি হিসেবে। কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের জবাবে অনেকেই আঙ্গুল তুলবেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে। কিন্তু এটা তো সত্যি যে, আমরা, মানে এদেশের নাগরিকরা যদি যার যার অবস্থানে সৎ থাকার চেষ্টা করি, তাহলে দুর্নীতির বিষবৃক্ষ আর ডালপালা মেলতে পারবে না।

বর্তমানে আমরা কী দেখি? রাজনীতি যেন হয়ে গেছে ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এখানে এখন এমপি মনোনয়ন বেচাকেনা হয়। আমরা জানি না মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট ওব্রাদার তার নির্বাচনে কত টাকা খরচ করেছেন। তবে আমাদের দেশে কোনো কোনো এমপি প্রার্থী দলের কাছ থেকে মনোনয়ন কিনতেই তারচেয়ে বেশি অর্থ নানা খাতে নানা ঘাটে ব্যয় করে থাকেন, তা বোধকরি অস্বীকার করা যাবে না। কেন তারা এ বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে থাকেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুব একটা কঠিন নয়। তারা এমপি হওয়ার খরচকে ব্যবসায়ে বিনিয়োগ বলেই মনে করে থাকেন। কারণ, একজন এমপির অনেক ক্ষমতা। তার ডিও লেটারে অনেক অসাধ্য সাধন হয়। রাস্তা খুলে যায় নানারকম ব্যবসা বাগিয়ে নেওয়ার। না, এটা বলছি না যে, সবাই এরকম করেন। তবে আমাদের রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আমলনামা দেখে এরকম ধারণা হওয়াটা কি খুব দোষের? মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট লোপেজ ওব্রাদার তার পূর্বসূরিদের ব্যবহার করা বিলাসবহুল উড়োজাহাজগুলো বেচে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আর আমাদের দেশের মাননীয় সংসদ সদস্যরা ‘ডিউটি ফ্রি’ গাড়ি আমদানির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের পার্লামেন্ট মেম্বারদের রাষ্ট্রকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে এমন সুবিধা দেওয়ার নজির আছে কিনা আমার অন্তত জানা নেই। তবে, আমরা এটা দেখেছি যে, মাননীয় এমপি মহোদয়দের কেউ কেউ ডিউটি ফ্রি সুবিধার আওতায় বিশ্ববিখ্যাত মডেলের ব্র্যান্ড নিউ এর ফাঁকে তার পকেট কিছুটা স্ফিত হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অবিশ্বাস্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে বিজয়ের পর সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। গত ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালেও তিনি বলেছেন, ‘কোনো দেশের পক্ষেই শতভাগ দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব নয়, তবে আমাদের দায়িত্ব হলো, এটা প্রতিরোধ করা, যাতে তা দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে এবং আমাদের সব সাফল্য ম্লান করে না দেয়। সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি ও মাদক নির্মূলের ক্ষেত্রে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে’। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যয়দীপ্ত এ বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। প্রকৃতই তিনি এদেশের মানুষের অন্তরের প্রত্যাশার কথাই বলেছেন। বাংলাদেশের মানুষ তেমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা চায়, একটি সমাজ চায়, যেখানে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি থাকবে না। তারা চায় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা হবেন অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। তারা থাকবেন লোভ-লালসা, অর্থবিত্ত লিপ্সার ঊর্ধ্বে।  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার বা এর রাশ টেনে ধরার যে প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন, তাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে যে কঠোরতা প্রয়োজন, তা তিনি দেখাবেন-এ প্রত্যাশা তো  দেশবাসী করতেই পারে।

লেখক : সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর