একজন নারী একজন পুরুষ সব সামাজিক, ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় কোনো দিক থেকেই কেউ কারও থেকে পিছিয়ে নয়। পরস্পর সমানে সমান। তারপরও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় অপসংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক কারণে নারীরা বিভিন্নভাবে পিছিয়ে আছে। শুধুই যে পিছিয়ে আছে তা নয়, এই দুর্ভাগ্যের ফলশ্রুতিতে নারীরা আত্মহত্যার প্রবণতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের চলমান ধর্মীয় গোঁড়ামি ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশের কারণে নারীরা চরম অসহায় অবস্থায় বসবাস করে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীবিদ্বেষী নেতিবাচক সংস্কৃতির মধ্যে নারীর অসহায় অবস্থানই নারীকে আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যায়।
সংসার জীবনে একজন নারী একজন যোদ্ধা। গোটা বিশ্ব তার কাছে যুদ্ধক্ষেত্র। তাই তাকে যে পাত্রে রাখা হয় সে সেই পাত্রের রূপ ধারণ করে। যে কারণে নারীর মতিগতি বোঝা দায় হয়ে পড়ে। যুগ যুগ ধরে নারীকে মানুষ না ভেবে তাকে শুধু নারী ভাবা হয়। পুরুষতান্ত্রিক শাসনে থাকবে নারী এই নেতিবাচক মনোভাব থেকে আজও বের হতে পারেনি আমাদের পরিবারপতি ও সমাজপতিরা। নারীর দেহমন, গতিবিধি, পছন্দ-অপছন্দ সব কিছুই পুরুষের অধীনে থাকতে হবে। এটি চিরায়িত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারীর স্বাধীনতা, শালীনতা সব কিছুর নিয়ন্ত্রক তার স্বামী। তবু নারীর আপত্তি কিংবা অভিযোগ নেই। নারীরা আজও বলতে পারে না ‘শরীর আমার সিদ্ধান্তটাও আমার’। বরং নারী তার সংসার জীবনের জয়লাভ করার আধিপত্য ছেড়ে দেয় তার স্বামী পুরুষটির ওপরে। নিজের যাপিত জীবনের সব নিরাপত্তার জন্য ওই একজন মানুষের ওপরে সবটুকু বিশ্বাস নিয়েই বসবাস করে সে অভ্যস্ত।আমাদের দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ইদানীং পিছিয়ে পড়া নারীরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বহু ক্ষেত্রে পুরুষের সমান কাতারে চলে এসেছে। নারীর এই ক্ষমতায়নে প্রয়োজন হয়েছে নিজেকে প্রস্তুত করা তথা চরম চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে নিজেদের জন্য স্বীকৃতি আদায় করা। কিন্তু সবার জন্য সে সুযোগ জোটে না।
পিছিয়ে পড়া নারীরা আশার আলো দেখার মতো সাহস হারিয়ে ফেলে। এখান থেকেও বিষণœতা শুরু হতে পারে।
একজন নারী ‘মা’ হওয়ার জন্য চরম আত্মত্যাগ করেন। এমনকি প্রসূতি মৃত্যুতে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে জেনেও ঝুঁঁকি নেয় মা হতে। সন্তান মানুষ করার পেছনে নারীর অবস্থান শীর্ষে। দিনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই কেটে যায় পারিবারিক কোনো না কোনো কাজে। তবু নারীর নেই নিরাপত্তা, নেই কাজের স্বীকৃতি। স্বামীর নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার আর অবিচারের বলি হতে হয় অনেক নারীকে।
চারপাশের চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরালে এক সময় নারী হয়ে পড়ে নিতান্তই অসহায়। এর একটা অন্যতম কারণ হলো নারীকে সবসময় পুরুষের আবদ্ধ গণ্ডির কয়েদি ভাবা হয়। আর সে জন্যই নারীরা হারিয়ে ফেলে তার নিজস্ব গতিবেগ।
পুরুষের নির্যাতনের সীমানা অতিক্রম হলে নারী তার ধৈর্যের মাঝে বিচ্যুতি ঘটায়। একসময় নারীর চোখের সামনে ঘন কুয়াশার আস্তরণ দেখা দেয়। আর সেই ঘন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে নারী কখনো কখনো প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদের ভাষা যখন নিজের জীবনকে হরণ করে তখন তাকে আমরা আত্মহত্যা বলি। আমাদের দেশে আত্মহত্যা বহুবিধ কারণে হয়ে থাকে। পারিবারিক সৃষ্ট কলহ চরম পর্যায়ে পৌঁছলে, যৌন হয়রানি, নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ, বহুবিবাহ, মান অভিমান, বিষণœতা, হতাশা, অন্তর দহন, স্বামীর সঙ্গে মানসিক দূরত্ব, সম্পর্কের টানাপড়েন, বাল্যবিবাহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি।
বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায়, মুড বা মেজাজের পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক পদার্থ, নিউরোট্রান্স মিটারের গোপন সংশ্রব। এই পদার্থগুলোর মধ্যে সেরোটনিক ও নর এড্রিনালের মাত্রা কমে গেলে মনোজগতে তৈরি হয় নিম্নচাপ। নিম্নচাপ থেকে আসে বিষণœতা। আর গুরুতর বিষণœতা থেকেই আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় মস্তিষ্কের গ্লুটামিক অ্যাসিডের ভারসাম্যহীনতার সঙ্গে আত্মঘাতী আচরণের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরা। যেসব মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে, গবেষণায় তাদের মস্তিষ্কের গ্লুটামিক অধিক কার্যকর থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্লুটামিক হচ্ছে এক ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড যা স্নায়ুকোষের মধ্যে সংকেতের আদান-প্রদান করে। কোষ থেকে কোষে সংকেত পাঠাতে গ্লুটামিককে সহায়তা করে কুইনোলিক অ্যাসিড।
সুইডেনের প্রায় ১০০ আত্মহত্যার রোগীর ওপর এ গবেষণা করেন গবেষকরা। এসব রোগী আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আত্মহত্যার চেষ্টা করা এসব মানুষের স্পাইনালে তরল পদার্থের মধ্যে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে কুইনোলিক অ্যাসিড রয়েছে, যার অর্থ তাদের গ্লুটামিক অধিক কার্যকর। এতে প্রমাণিত হয়, যেসব মানুষের মস্তিষ্কের রসায়নে কুইনোলিক অ্যাসিডের পরিমাণ কম, তাদের আত্মহত্যার ঝুঁঁকি কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর বিশ্বের ১ থেকে ২ কোটি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি মানুষ সফল হয়। ২০১০ সালের স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় এবং সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো গ্রামীণ জনপদে আত্মহত্যার ব্যাপ্তি নির্ণয় করা হয়। সেখান থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এখানে প্রতি লাখ মানুষের মধ্যে ১২৮.৮ জন আত্মহত্যা করে।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চরম প্রতিকূলতার মাঝে সংকীর্ণ পরিবেশে বসবাস করে অসংখ্য মানুষ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে গোটা জাতিকে। নয়তো জীবনের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রলম্বিত সময়ের অবসান ঘটাতে অনেকে বেছে নেবে আত্মহত্যার পথ। বাংলার পিছিয়ে পড়া নারীসমাজ তাদের ন্যায্য অধিকার পেয়ে বেঁচে থাকুক নিজ ভুবনে সেটাই হোক একমাত্র চাওয়া।
লেখক : নারী ও শিশু অধিকার কর্মী।