বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কোনো মৌলবাদই গ্রহণযোগ্য নয়

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

কোনো মৌলবাদই গ্রহণযোগ্য নয়

বাংলাদেশের প্রবীণ রাজনীতিবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেনের সাম্প্রতিককালের কর্মপদ্ধতি দেখে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন আইনজীবী শুধু বিস্মিতই নন, তারা মনে করেন কামাল হোসেনের মতো জ্ঞানীগুণী ষোল আনা বাঙালি কী করে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে জোট বাঁধলেন; যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। এই মৌলবাদী সংগঠনগুলো শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে পাকিস্তানের সঙ্গে হাত মেলায়নি, তারা ৩০ লাখ লোক খুন করেছিল পাকিস্তানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তিনি কি জানতেন না যে, সেদিনকার রাজাকার-আলবদর-আলশাম্স আজকের জামায়াত। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে তিনি আইনমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশের সংবিধান রচনা করেছিলেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমি তখন ঢাকায়। বিদেশি সংবাদদাতা হিসেবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আমাকে সপ্তাহে দু-তিন দিন যেতে হতো। সেই সুবাদে আমরা পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে চিনতাম, জানতাম। প্রায় ৩৫ বছর পর ২০১২ সালে আমি যখন ঢাকায় যাই তখন তার সঙ্গে আমার দেখা হয় ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণের বাড়িতে। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিদেশ থেকে ফোন করে দিল্লিতে অনেকের সঙ্গে আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দিতে বলতেন। আমি করেও দিয়েছি।

ড. হোসেন ঐক্যফ্রন্ট নামে একটি ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন, সেই ফ্রন্টে শামিল হয়েছিল বিএনপি। আর তাদের সঙ্গে শামিল হয়েছিল জামায়াত। যার পরিণামে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এই ফ্রন্টকে ভোট না দিয়ে শূন্যহাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। গত বছর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগে সব দলই যাতে নির্বাচনে অংশ নেয় সেজন্য বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলকে ডেকে কথাও বলেছিলেন সবাইকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর কামাল হোসেনরা এই ফল মানি না বলে বিবৃতি দিয়েছিলেন। কিছু দিন যেতে না যেতেই কামাল হোসেন এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন যে, জামায়াতকে সঙ্গে নেওয়া ঠিক হয়নি। ভবিষ্যতেও তিনি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করবেন না। এটা যে তার একটা ঐতিহাসিক ভুল তা ভারতের শুভাকাক্সক্ষীরাও স্বীকার করবেন। তারাও মনে করেন ড. কামালের জামায়াতের সঙ্গে যাওয়া উচিত হয়নি। এর ফলে মৌলবাদী শক্তি সক্রিয় হয়েছে। ভারতের শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেন, ড. কামাল যে কাজ করেছেন তা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। আমি দুঃখিত যে আমাদের বন্ধু ড. কামাল বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। বামপন্থি মনোভাবসম্পন্ন কলকাতা উচ্চ আদালতের বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য এবং অরুণাভ ঘোষকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দুঃখের সঙ্গে তারা বলেন, ড. কামাল বার বার পল্টি খেয়ে যাচ্ছেন। ১/১১-এর পর তিনি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। তার পরও তিনি আওয়ামী লীগে ফিরতে চেয়েছিলেন, অনেকবারই তিনি সুযোগসন্ধানী রাজনীতি করতে চেয়েছেন যা বাংলাদেশের মানুষ মেনে নিতে পারছে না। কথা বলেছিলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক ড. ওমপ্রকাশ মিত্রের সঙ্গে। তার মতে, ড. কামাল নির্বাচনের আগে যা করেছেন এবং পরবর্তীকালে যেসব বক্তব্য রেখেছেন তা বোধগম্য নয়। তিনি জানতেন না বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামায়াত ২৫টি আসনে প্রার্থী দেবে এবং তারা সবাই বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করেছেন। তখন তিনি কেন স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে কথা বলেননি? কেন তিনি ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দেননি। এসব প্রশ্ন এখন পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। নির্বাচনের আগে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আমি বাংলাদেশে ছিলাম। আমি দেখেছি ড. কামাল হোসেন এবং ঐক্যফ্রন্টের বেশকিছু নেতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ। অনেকে আমাকে বলেছেন, তাদের নেত্রী শেখ হাসিনা ১০ বছরে বিশ্বের দরবারে যেভাবে বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন তা কল্পনাতীত। তাই আমরা লজ্জা পাচ্ছি ড. হোসেনের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা কী করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে হাত মেলালেন। ড. হোসেন আমারও ব্যক্তিগত বন্ধু, তাই তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, সংবিধানে আপনি ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা সাম্প্রতিককালের কর্মকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিপরীত।

বাংলাদেশের মৌলবাদীরা বিশেষ করে জামায়াত যেভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও পাকিস্তান ও আইএসএসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে চাইছে তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। কলকাতা থেকে শুরু করে গোটা পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত জেলাগুলোয় জামায়াত শুধু আস্তানাই গাড়েনি, তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষতা মুক্ত করা।

ভারতের অবসরপ্রাপ্ত একাধিক কূটনীতিবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সময় অনেকেই মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর জাাময়াত অত্যাচার করেছে। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, জমি-জায়গা দখল করেছে, নারীদের ওপর অত্যাচার করেছে। ফলে সংখ্যালঘুদের একমাত্র ভরসা হলো শেখ হাসিনা; কিন্তু দু-এক জন কূটনীতিবিদ যারা একসময় ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনে কাজ করেছেন তারা অনেকেই মনে করেন ১-১১ থেকে শুরু করে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের বামপন্থিরা। এই বামপন্থিরা মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন।

একটি সূত্র থেকে বলা হয়, সদ্য বদলি হয়ে যাওয়া ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সাউথ ব্লকে পাঠানো তার গোপন রিপোর্টে বলেছেন, ‘বিপুল ভোটে হাসিনার জয়ের পরও জামায়াত দোসর পাকিস্তান গোয়েন্দা আইএসআই যে কোনো সময় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।’ মৌলবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের দরকার বামপন্থিদের সঙ্গে নেওয়া। বামপন্থিদের একটা নির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে তা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সাবেক হাইকমিশনার তার রিপোর্টে আরও বলেছেন, গত ১০ বছরে শেখ হাসিনার শাসনকালে হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে যেখানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে সেখানেই বামপন্থিরা সরকারের পাশে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। মৌলবাদী হামলা সর্বদাই আসে সংখ্যালঘুদের ওপরে। যদিও প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বার বার ঘোষণা করেছেন। তবু জামায়াতকে কি বিশ্বাস করা যায়?

এবার জামায়াতের কর্মকাণ্ডের এপার পশ্চিমবঙ্গের কিছু ঘটনা তুলে ধরছি। অঙ্গরাজ্যের আঞ্চলিক দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি হাজার হাজার জামায়াতিকে পশ্চিমবঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন তবে তা বিনা স্বার্থে নয়। বাংলাদেশ ও ভারত সরকার উভয়েই জানে কলকাতার বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনের অফিসে একজন বিধবা মহিলা কর্মচারী আছেন যিনি দেশের স্বার্থ না দেখে কলকাতায় বসবাসকারী বাংলাদেশবিরোধী নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তারা বলেন, আমরা এসব ঢাকায় জানিয়ে দিয়েছি। এর বেশি কিছু বলতে তারা অস্বীকার করেন। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কূটনীতিকরা মনে করেন, বাংলাদেশের প্রবীণ ও নবীন নেতাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে ভারতের কংগ্রেস দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী যে নীতি গ্রহণ করেছেন তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও নবীনদের উদ্যোগ যৌথভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে বলে ভারতের কংগ্রেস দল মনে করে। একটি দৃষ্টান্ত হলো, সম্প্রতি রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে অভিজ্ঞ প্রবীণদের রেখে দিয়ে নবীনদের দিয়ে একই সঙ্গে নির্বাচন পরিচালনার প্রস্তুতি নিয়েছেন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা মনে করেন, আওয়ামী লীগ ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের গঠনতন্ত্রের মধ্যে একটা মিল আছে। উভয় দেশের সংবিধানের মধ্যেও মৌলিক অধিকারের একটা সাদৃশ্য আছে। আরএসএস ও জামায়াতের মধ্যেও একটি গোপন আঁতাত আছে। আরএসএস যেমন ভারতের সংখ্যালঘুদের ‘ভারতছাড়া’ করতে চায়, একই কায়দায় জামায়াতও চায় বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়ন। ভারতে তিনবার দেখা গেছে, একবার ১৯৬৯ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে, ১৯৯১ সালে নরসিমা রাওয়ের আমলে এবং ২০০৪ সালে ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে কংগ্রেস যখন সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে তখন বামপন্থিরাই আরএসএসের হাত থেকে ভারতকে বাঁচানোর জন্য কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে সেই সরকার টিকে গিয়েছিল।

ড. কামাল হোসেনকে একবার শুধু স্মরণ করিয়ে দেব- একটু খোঁজ নিলেই তিনি জানতে পারবেন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মমতার নিরাপদ আশ্রয়ে জামায়াত নেতা-কর্মীরা কীভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। উদ্দেশ্য একটাই- যারা মমতার সাহায্যে ভারতের আশ্রয় পেয়েছেন তারা নির্বাচনে মমতার ভোটব্যাংক পূর্ণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন। মৌলবাদ- তা হিন্দু মৌলবাদ বা মুসলিম মৌলবাদ হোক- কোনো দেশের পক্ষেই বাঞ্ছনীয় নয়। ড. কামাল সাহেব এখন যা-ই বলুন না কেন তিনি যে ঐতিহাসিক ভুল করেছেন তার খেসারত বাংলাদেশের মানুষকেই দিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত কি? একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে- উভয় দেশের স্বার্থে মৌলবাদ ও সন্ত্রাসবাদকে কীভাবে বন্ধ করা যায় সে বিষয়ে তার অমূল্য মতামত দুই দেশের কাছেই তিনি রাখতে পারেন।

            লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর