বৃহস্পতিবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

যৌতুক মামলা ও সন্তান নিয়ে স্বামীর অপবাদ

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

যৌতুক মামলা ও সন্তান নিয়ে স্বামীর অপবাদ

একটি সিনেমার গল্প দিয়েই শুরু করি। জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা ‘দেনমোহর’। দুই দশকেরও আগে বাবার বকুনি খেয়েও সিনেমাটি দেখেছিলাম। নায়ক সালমান শাহ, নায়িকা মৌসুমী। ঘটনাপ্রবাহে একপর্যায়ে তাদের বিয়ে হয়। দেনমোহর হিসেবে ধার্য হয় নগদ ৫০ লাখ টাকা ও ১০০ একর জমি। জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু শুরুতেই নায়িকার জীবনে নেমে আসে শ্বশুরপক্ষের নির্যাতনের কালো ছায়া। দিনের পর দিন অপমান আর তাচ্ছিল্যের আতিশয্যে নায়িকা মৌসুমী স্বামীগৃহ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই তো সেদিন সিনেমাটির ঘটনার মতোই আমার চোখের সামনে আরেকটি ঘটনার অবতারণা হলো। তবে নায়িকা মৌসুমী নন, একজন রহিমা।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী। যৌতুকের একটি মামলার সাক্ষ্যপর্ব চলছে। মেয়েটি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন। মেয়েটির অভিযোগ, স্বামী তার সন্তানকে অস্বীকার করেছেন। অপবাদ দিচ্ছেন এ সন্তান তার নয়। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের কারণে নানাভাবে অত্যাচার করছেন। নিরুপায় হয়ে যৌতুকের ও সন্তানের ভরণ-পোষণ চেয়ে মামলা করেছেন আদালতে। মেয়েটির নাম রহিমা (ছদ্মনাম)। মাঝারি গড়নের, চিকন ও ফরসা। ডাগর ডাগর দুটি চোখজুড়ে যেন সরলতার প্রতিচ্ছবি। ওই দুটি চোখই বলে দেয় তার হৃদয়ের গহিনে জমে থাকা যন্ত্রণার ঢেউ।

২০১৫ সালে পারিবারিকভাবেই রহিমার বিয়ে হয়। ছেলেটি সৌদি আরবে ব্যবসা করতেন বলে জানিয়েছিলেন। আসলে তিনি ওখানে তিন বছর থাকার পর দেশে চলে আসেন। এসে কিছুদিন একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করেন। বিয়ের সময় পুরোপুরি বেকার ছিলেন। বিয়ের সময় রহিমার বাপ-ভাইয়েরা খোঁজখবর নিলেও তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।

জানার পর রহিমা জিজ্ঞাসা করেন কেন এমন প্রতারণা! তখন তিনি রহিমাকে মানসিকভাবে অত্যাচার শুরু করেন। আস্তে আস্তে তার আসল চেহারা উন্মোচিত হয়। বিয়ের পর তিনি রহিমাকে তার বাবার বাড়ি নিয়ে যাননি। প্রথমে শুধু কাবিন করলেও পরে আর তুলে নেননি। মাঝেমধ্যে আসতেন। নানা কটুকথা আর অপবাদ দিতেন। রহিমার পরিবারের কাছে টাকা চাইতেন। এরই মাঝে রহিমার কোলজুড়ে আসে একটি ফুটফুটে ছেলেসন্তান। ছেলেটিকে সম্বল করেই বেঁচে থাকা রহিমার।

২০১৮ সালে অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেন রহিমা। মামলার পরই প্রতারক স্বামী তালাক দেন রহিমাকে। আসলে রহিমাও তালাক চাচ্ছিলেন। কারণ বিয়ের পর তার প্রয়োজন মেটাতেই আসতেন। আর বাচ্চা হওয়ার পর তো একদমই খোঁজ নিতেন না। এমনকি এই বাচ্চার বাবা কে, তা নিয়ে নাকি তার সন্দেহ আছে! এ কথা শোনার পর রহিমা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে এ রকম সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। রহিমার বিয়ের দেনমোহর ৫ লাখ টাকা। দেনমোহর ও সন্তানের খোরপোশ, অভিভাবকত্ব চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা করেছেন। রহিমার ভয়াবহ কথা, তিনি নাকি তার স্বামীর চার নম্বর বউ ছিলেন! তবে রহিমার ভাষা ‘লড়াইয়ে যখন নেমেছি, থামব না। আমরা নারীরা অনেক বেশি অসহায়। একদিকে বাবা-মায়ের সংসারে ভাইদের ওপর বোঝা হয়ে আছি, তার ওপর মামলা-মোকদ্দমা তবু থামব না। আমার জন্য না হোক, বাচ্চাটির জন্য হলেও চালিয়ে যাব।’ রহিমার কোলে তার ছেলের চেহারাটা কত মায়াবী, চোখ দুটি ছলছল করছে, বাবার আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত চেহারাটা। নিরপরাধ হয়েও জন্ম থেকেই অপবাদের বঞ্চনা সইতে হচ্ছে। ছেলেটি বোবা হয়ে আছে যেন বাবা ডাকার জন্য।

যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি যৌতুক দাবি করে তাহলে দায়ী ব্যক্তি সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত সাজা ভোগ করবে, যা কোনোভাবেই এক বছরের নিচে নয় বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। দেনমোহর ও ভরণ-পোষণের দাবি করে পারিবারিক আদালতে প্রতিকার চাইতে হয়। দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তালাক কার্যকর হওয়ার আগে পর্যন্ত এবং ইদ্দতকাল পর্যন্ত অবশ্যই স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ দিতে হবে। তালাক হওয়ার পর তিন বছরের মধ্যে দেনমোহরের জন্য মামলা করতে হয়। সহকারী জজ আদালতগুলো পারিবারিক আদালত হিসেবে বিচারকাজ করে।

রুপালি পর্দায় অনেক আজগুবি বিষয়ের অবতারণা ঘটে, কিন্তু বাস্তব ঘটনা আরও করুণ। ভাবতে অবাক লাগে, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যৌতুকের নির্মম বলি হন অবলা স্ত্রীরা। পুরুষরূপী কাপুরুষরা যৌতুকের খেলায় মত্ত হয় বার বার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যদিও আছে, তবু আইনের ফাঁক গলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে যৌতুকসহ অন্যান্য অপরাধ। হাজারো রহিমার নয়নভরা জল তারই সত্যতা বহন করে। সামাজিক ব্যাধি হিসেবে শক্ত মূলের ওপর স্থান করে নেওয়া যৌতুক প্রতিরোধে শুধু আইনের কড়াকড়ি নয়, অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত পুরুষের পাশবিক মানসিকতার পরিবর্তন খুব জরুরি। তবেই যদি মুছে দেওয়া যায় অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হতভাগ্য গৃহবধূদের কান্নার রেশ।

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর