শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

এ মেয়াদ হোক বাংলাদেশকে রূপান্তরের পাঁচ বছর

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

এ মেয়াদ হোক বাংলাদেশকে রূপান্তরের পাঁচ বছর

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত আরেকটি নতুন সরকারের যাত্রা হয়েছে কেবল মাসখানেক হলো। আগামী পাঁচ বছর এই সরকারের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। বিশাল জনম্যান্ডেটপ্রাপ্ত এই সরকারের কাছে দেশের মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা জন্মেছে। এবারের নির্বাচনে জনমনের যে বহিঃপ্রকাশ হয়েছে তার সঙ্গে কেবল ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের তুলনা চলে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছিলাম। সেই সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য ১৯৭৩ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুকে বিশাল জনম্যান্ডেট প্রদান করে। ’৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সব সংসদ সদস্যকে ’৭১ সালের ৩ জানুয়ারিতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শপথবাক্য পাঠ করান এবং তিনি নিজেও শপথ নেন। সেই শপথবাক্যে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ থেকে ছয় দফা এ দেশের জনগণের সম্পদ, এর সঙ্গে কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করলে এ দেশের মাটিতেই তার কবর রচিত হবে, এমনকি আমি করলে আমারও।’ শেষ পর্যন্ত সবাই ছয় দফার প্রতি অটল, অনড় ছিলেন বলেই ’৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

’৭১-এ যুদ্ধের সময় গুটিকয় সংসদ সদস্য বেইমানি করেন। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের শারীরিক কবর না হলেও রাজনৈতিক কবর হয়ে যায়। তারা কোথায় হারিয়ে গেছেন সে খবরও কেউ আর রাখেনি। ’৭৩ সালে পুনরায় জনম্যান্ডেট নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র গড়ার যাত্রা করলেন। সবকিছু এগোচ্ছিল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। যুদ্ধবিধ্বস্ততার ধকল উতরিয়ে সব জায়গায় একটা স্থিতিশীল অবস্থা এনে ’৭৫ সালের শুরুর দিকে তিনি সম্পূর্ণ নতুন কৌশল ও পথে সারা জীবনের স্বপ্ন সোনার বাংলা বিনির্মাণের নবযাত্রা শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই যাত্রার সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ কেমন হতে পারত সে সম্পর্কে পরবর্তীতে বিশ্বের বড় বড় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা মন্তব্য করেছেন এই মর্মে, যে যাত্রা বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন তা যদি অন্তত ১০টি বছর অব্যাহত থাকত তাহলে অনেক আগেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার থেকেও অনেক অগ্রগামী থাকত।

’৭৫ সালের পর যে জঞ্জাল ও আবর্জনা রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে শুধু সৃষ্টি নয়, শেকড় গেড়ে বসেছে তা হতে পারত না। তখন শুধু একটি জায়গায় ভয়ানক দুর্বলতা থাকার কারণে সব শেষ হয়ে গেল। ’৭১-এর দেশি-বিদেশি পরাজিত পক্ষ এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক ক্ষমতাবান পরাশক্তির পাল্টা আঘাত বা কাউন্টার অ্যাটাক অর্থাৎ বিশাল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করার ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেষ্ট প্রস্তুতি তখন ছিল না। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন প্রবল আত্মবিশ্বাসী এবং তার মনোবল ছিল আকাশসম। এ সুযোগটিই নিয়েছে তার আশপাশের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক সহচর। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। আমরা জাতির পিতাকে হারালাম। স্বাধীনতার মূলস্তম্ভ শেষ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ মুখ থুবড়ে পড়ল। রাষ্ট্রের যাত্রা হলো উল্টো দিকে। সে যাত্রাপথ ছিল বাংলাদেশের জন্য ‘অ্যান ইরা অব ডার্কনেস’, নিকষকালো অন্ধকারের যুগ। এই পুরনো কথাগুলোর পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হয় এ কারণে যে, উইনস্টন চার্চিল একটা চিরন্তন সত্য কথা বলেছিলেন, ‘আপনি যত পেছনের দিকে তাকাতে পারবেন ঠিক ততটাই সামনের দিকের ভবিষ্যৎও দেখতে পারবেন।’ অন্ধকার থেকে বাংলাদেশকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য আবার সংগ্রাম শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিগত ৩৮ বছরে সংগ্রামরত শেখ হাসিনার সেই পুরনো শত্রু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ থেকে ১৯বার আক্রমণ চালানো হয় তাকে হত্যা করার জন্য। যার মধ্যে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের আক্রমণটি ছিল তখনকার জামায়াত-বিএনপি সরকারের সরাসরি প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও সহযোগিতায়। মনীষীরা বলেছেন, সংগ্রামরত মানুষের ওপর যত বেশি আঘাত আসবে তিনি তত বেশি খাঁটি হয়ে উঠবেন।

মহাত্মা গান্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং বঙ্গবন্ধুর জীবনের দিকে তাকালে আমরা সে রকমটাই দেখতে পাই। এ কথা এখন অনস্বীকার্য যে, আঘাত-প্রতিঘাতের শিক্ষায় সমৃদ্ধ শেখ হাসিনা গত দুই টার্মে, ১০ বছরে বাংলাদেশকে যে জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন তাতে বাংলাদেশের মানুষের মনে এই মর্মে প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে যে, তিনি আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করে এমন একটা স্থানে নিয়ে যাবেন সেখান থেকে বাংলাদেশকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। এ রকম আশাবাদের কথা এখন আর শুধু কথার কথা নয়। বিশ্বের নামিদামি জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের জরিপের মাধ্যমে জানা যায় বাংলাদেশের শতকরা ৭৪ ভাগ তরুণ-তরুণী মনে করে আগামী ১০ বছরে তাদের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল হবে। এই আশাবাদ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে বস্তুনিষ্ঠ দৃশ্যমান কারণ রয়েছে। গত ১০ বছর ধরে দেশের সার্বিক উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরিতে এককভাবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দুঃসাহস ও দূরদৃষ্টি ছিল এককথায় অভাবনীয় এবং নজিরবিহীন। নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় সে সময় র‌্যাবে কর্মরত সশস্ত্র বাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কয়েকজন কর্মকর্তার আদালত কর্তৃক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান প্রমাণ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তিনি কাউকে ছাড় দেবেন না। তারপর পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মতো এত বড় মামলার বিচার রেকর্ড দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান সম্ভব হয়েছে কেবল শেখ হাসিনার দৃঢ়তার কারণে। এর সঙ্গে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড আক্রমণ এবং একই বছর ১ এপ্রিলে সংঘটিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানসংক্রান্ত মামলা নিয়ে বিএনপি সরকার তখন কী করেছে তার তুলনা করলেই দুয়ের মধ্যে পার্থক্যটা মানুষ বুঝতে পারে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কেবল শেখ হাসিনার দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। আর সব সাফল্য বাদ দিয়ে এ দুটি ইস্যু এবং ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র সীমানাসংক্রান্ত দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা, এই কয়েকটি কাজের জন্যই শেখ হাসিনা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট উন্নয়নশীল দেশের হয়ে তিনি বিশ্বের পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেছেন, বিশ্বব্যাংকের হুমকি মোকাবিলা করেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলায় সাহসী ভূমিকা গ্রহণে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। তুলনামূলক তালিকা করলে দেখা যাবে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের অন্য কোনো নেতা একসঙ্গে এতগুলো বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সাফল্য অর্জন করতে পারেননি, যা শেখ হাসিনা পেরেছেন। তাই সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় মানুষের মনে প্রত্যাশা জন্মেছে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের এমনভাবে রূপান্তর ঘটাবেন যেখানে কোন দল ক্ষমতায় থাকল সেটা বড় কথা হবে না, সবচাইতে বড় কথা হবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থানকারী দল আর কোনো দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসবে না এবং বিরোধী দলেও থাকবে না। এ লক্ষ্যে গত ১০ বছরে অনেকখানি অগ্রগতি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল বিরোধী দল জামায়াতের রাজনীতি প্রায় নিঃশেষিত অবস্থায় চলে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে জামায়াতের পুনর্জন্মদাতা, পৃষ্ঠপোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শবিরোধী দলটি এখন অনেকটাই কোণঠাসা এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ও প্রত্যাখ্যাত।

আগামী পাঁচ বছর শেখ হাসিনার বর্তমান নতুন সরকার যদি জনগণের মোটা দাগের প্রত্যাশাগুলোর জায়গায় দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে পারে তাহলে এই সময়ের মধ্যে রাজনীতিতেও বড় ধরনের নতুন মেরুকরণ ও রূপান্তর ঘটে যাবে। এর জন্য সর্বাগ্রে ও সর্বপ্রথম সরকারের টার্গেট হতে হবে দুর্নীতি দমন ও নিয়ন্ত্রণ। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আছে এবং গত ২৫ জানুয়ারি জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্সের কথা পুনরুল্লেখ করেছেন, যা পরদিন প্রায় সব পত্রিকায় হেডলাইন হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে এলে তার ধারাবাহিকতায় সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গতি আসবে। তাহলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে ব্যাপকভাবে। বিনিয়োগ এলে সমানতালে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, যেটা এখন তরুণ প্রজন্মের জন্য সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। তখন রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রোপাগান্ডা, অপপ্রচারে কেউ কর্ণপাত করবে না। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও প্রশাসনের জায়গায় এসব আকাক্সিক্ষত রূপান্তরের সঙ্গে একই সময়ে ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে আসা সব মেগা প্রকল্পও সম্পন্ন হয়ে যাবে। রেললাইনসহ পদ্মা ব্রিজ, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল, জয়দেবপুর থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল ও মাতারবাড়ী মেগা বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন মহাসড়ক, আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়া হয়ে বাইপাস পর্যন্ত উড়ালসড়ক, ঢাকা বাইপাস সড়ক এবং প্রায় ডজনখানেক হাইটেক পার্ক ইত্যাদি অবকাঠামো উন্নয়নের চিত্রটি বাংলাদেশকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেবে।

উপরোক্ত প্রকল্পগুলোর কোনোটাই এখন আর শুধু পরিকল্পনার মধ্যে নয়, সবই বাস্তবে দৃশ্যমান। এই সময়ের মধ্যে শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ পাবে। প্রবৃদ্ধি চলে যাবে প্রায় ২ অঙ্কের কাছাকাছি। এসব যখন একের পর এক আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মানুষের সামনে দৃশ্যমান হবে তখন সেটা হবে এক অন্যরকম বাংলাদেশ। ’৭৫ সালের পর রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে সৃষ্টি হওয়া জঞ্জাল ও আবর্জনামুক্ত নতুনভাবে রূপান্তরিত এক বাংলাদেশ।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর