রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

উপহার

অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত

উপহার

‘উপহার’ বাঙালি সংস্কৃতি শুধু নয়, সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সব সমাজব্যবস্থার উৎসব বা পার্বণে একটা প্রচলিত রীতি। উৎসব, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও আজকাল একে অন্যকে কিছু উপহার দেওয়া হয়, যার অধিকাংশ শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ। শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ যে প্রদেয় উপহার, তা বেশির ভাগই চিকিৎসক বা শিক্ষকদের বেলায় ঘটে। আমার শিক্ষক যারা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন তাদের আমি শুধু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, তা নয়, লেখনীতে, বক্তব্যে তা তুলে ধরার চেষ্ট করি। শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ক্ষেত্রে শুধু ‘ধন্যবাদ’ বা ‘আন্তরিক ধন্যবাদ’ দিলেই শ্রদ্ধা প্রদর্শন হয়।

আমি, আমার একজন ব্রিটিশ শিক্ষক অধ্যাপক ভেলেরি ই. নিউটনকে এ প্রশ্নটা করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, উপঢৌকন দেওয়া বা নেওয়া ঠিক কিনা? জবাব ছিল- শিক্ষক ও চিকিৎসক তা নিতে পারেন, ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থায় তা গ্রহণযোগ্য।

তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্দরনগরী ‘অদেসা’র রিজিওনাল হাসপাতালে আমি ডক্টরেট ডিগ্রি করার সময় যা দেখলাম, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে রোগীরা হাসপাতাল ত্যাগের সময় চিকিৎসদের কিছু না কিছু উপহারসামগ্রী দিয়ে যান, যা তাদের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। দাতা ও গ্রহীতা তা সানন্দে করে থাকেন। আমি যেখানে কাজ করেছি, আমার গাইড ভøাদিমির দিমিত্রিয়েভিচ দ্রাগমিরেস্কি ইউকরাইন স্টেটের একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী ছিলেন। তার D.Sc থিসিসি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক নতুন নতুন তথ্যসংবলিত। সেখানে কোনো রোগী চিকিৎসা শেষে ভালো হয়ে হাসপাতাল ত্যাগের সময়, সোভিয়েত প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এক বোতল ভদকা ও তিনটি ফুলের একটা গুচ্ছ উপহার দিয়ে যেতেন। এই দেওয়া-নেওয়ার আনন্দটাও ছিল অতি সৌন্দর্যমণ্ডিত। দুই পক্ষের হাসিতে থাকত হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, যেন সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছেন। এও দেখেছি- কোনো রোগী মারা গেলে তার আত্মীয়স্বজন এসে ডাক্তারকে তার পরিশ্রমের জন্য এক এক করে সবাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যান। অনুভূতিটা হলো- এ ক্ষেত্রে ডাক্তারের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না, স্বয়ং বিধাতার সঙ্গে ডাক্তার রোগী নিয়ে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারেননি। কখনো দেখিনি ডাক্তারের গায়ে হাত ওঠাতে। হাসপাতাল ভাঙচুর করতে। অবশ্যই সেখানে ডাক্তারের অবহেলা থাকত না বললেই চলে। রাশিয়ান চিকিৎসকদের আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, হাসপাতাল ত্যাগের সময় রোগীরা চিকিৎসকদের কোনো উপঢৌকন দিলে এতে কোনো অপরাধ আছে কিনা? অথবা তা ঘুষ বলে বিবেচিত হয় কিনা? তারাও বলেছিলেন, ‘না’।

কিন্তু কোনো জটিল রোগের চিকিৎসা নয়, শুধু সামান্য মতামতের জন্য যখন কোনো বড় ধরনের মূল্যবান উপহার দেওয়া হয়, তখন তা নেওয়ার আগে গভীরভাবে বিবেচনা করা উচিত, বিবেকের সঙ্গে বিতর্ক করা উচিত, ন্যায়ের সঙ্গে তার কোনো অসংগতি আছে কিনা? উপহারটি গ্রহণ করলে বিবেক দংশন করবে কিনা? মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের এই সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করেই তা গ্রহণ অথবা বর্জন করা উচিত। অতি মূল্যবান উপহার যা আপনার যোগ্যতার সঙ্গে মেশে না এবং যা রাখার মতো সুমূল্যবান কোনো যোগ্যতা আপনার আছে কিনা? অথবা রাখার স্থান যদি আপনার ঘরে না থাকে, তা অবশ্যই বর্জনীয়।

ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এ পি জে আবদুল কালাম তার Turning points বইতে ‘অন্য সবার কাছ থেকে শিক্ষা’ অধ্যায়ে উপহার সম্পর্কে যা লিখেছেন, তা শুধু আমার কাছে প্রণিধানযোগ্য নয়, মানুষমাত্র সবারই তা গ্রহণ করা উচিত। তার ভাষায়Ñ ‘আমি অনেকবার এই ঘটনাটি বলেছি, তাই এখন খুব সংক্ষেপে বলব। আমি যখন ছোট তখন আমার বাবা জনাব আবুল পাকির জয়নুলাবেদিন আমায় এক শিক্ষা দিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা লাভের ঠিক পরবর্তী সময়ে। রামেশ্বরম দ্বীপে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়েছিল এবং আমার বাবা গ্রামপরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাকে এজন্য নির্বাচন করা হয়নি যে তিনি কোনো বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ভুক্ত অথবা বিশেষ কোনো অর্থনৈতিক স্তরের মানুষ ছিলেন। তাকে তার চারিত্র্য-মাহাত্ম্যে ও একজন মহৎ মানুষ হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল।

যেদিন বাবাকে সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছিল সেদিন এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়ি আসেন। আমি তখনো স্কুলে পড়ি, সে সময় জোরে জোরে আমার পড়া তৈরি করছিলাম, এমন সময় শুনলাম দরজায় কেউ করাঘাত করছে। রামেশ্বরমে তখন কেউ বাড়ির দরজা বন্ধ করত না। এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করে বাবার খোঁজ করলেন। বাবা তখন সান্ধ্য নামাজ পড়তে গেছেন শুনে তিনি বললেন, বাবার জন্য তিনি কিছু নিয়ে এসেছেন, শুধালেন সেগুলো রেখে যাওয়া যাবে কিনা। আমি তাকে সেগুলো খাটিয়ার ওপর রাখতে বলে আবার পড়ায় মন দিলাম।

বাবা নামাজ সেরে ফিরে খাটিয়ার ওপর একটা রুপোর প্লেট এবং উপহারসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন। আমি তাকে জানালাম যে এক ভদ্রলোক এসে ওসব তোমার জন্য রেখে গেছেন। মোড়ক খুলে দেখা গেল দামি প্লেটের সঙ্গে কয়েকটা রুপোর কাপ, কিছু ফল এবং মিষ্টি রয়েছে। সেসব জিনিসপত্র দেখে বাবা দারুণ বিরক্ত হলেন ও রেগে গেলেন। সবচেয়ে ছোট সন্তান হিসেবে আমি বাবার খুব আদরের ছিলাম। বাবাকেও আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। সেদিন প্রথম আমি বাবাকে অত রেগে যেতে দেখলাম এবং সেবার প্রথম বাবার হাতে আচ্ছামতো পিটুনি খেলাম। আমি ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলাম। পরে বাবা আমায় বুঝিয়েছিলেন কেন তিনি অত রেগে গেলেন এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন কখনো কোনো উপহার তার অনুমতি ছাড়া যেন গ্রহণ না করি। তিনি হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিলেন, “পরমেশ্বর যখন মানুষকে কোনো কাজে নিযুক্ত করেন তিনি তার প্রয়োজনের প্রতি খেয়াল রাখেন, এর বাইরে যদি কেউ কিছু গ্রহণ করে সেটা অবৈধ।”

তিনি আমায় বলেছিলেন, উপহার নেওয়া ভালো অভ্যাস নয়। উপহারের সঙ্গে কোনো উদ্দেশ্য জড়িত থাকে যা খুব বিপজ্জনক। ঠিক যেমন বিষধর সাপকে স্পর্শ করার পরিবর্তে বিষদংশন সহ্য করা। আশি বছর বয়সেও এই শিক্ষা আজও আমার মনে দাগ কেটে রেখেছে। ঘটনাটা গভীরভাবে আমার মনে মুদ্রিত হয়ে আমার মূল্যবোধ গঠনে সাহায্য করেছিল। এখনো কেউ যদি আমায় কোনো উপহার দিতে চায় আমার শরীর আর মন শিউরে ওঠে।

পরবর্র্তীকালে আমি মনুস্মৃতি বা মনুর বিধান পড়েছি যাকে হিন্দু ধর্মভাবনায় মূলসূত্র হিসেবে মান্য করা হয়। সেখানেও বলা হয়েছে উপহার গ্রহণ করলে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ঐশ্বরিক শক্তি নির্বাপিত হয়ে যায়। মনু প্রতিটি ব্যক্তিকে উপহার গ্রহণের বিরুদ্ধে সতর্ক করেছেন। কারণ উপহার গ্রহণ করলে গ্রহীতা দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ হন। পরিবর্তে তিনি কোনো অনৈতিক বা অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হন।’

আন্তপারিবারিক উপহার যেমন সন্তান বাবা-মাকে, স্বামী স্ত্রীকে, ভাই বোনকে বা উল্টো এমনকি আন্তসামাজিক উপহারের মধ্যে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য লুক্কায়িত থাকে না। সেটা শুধু ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ অথবা দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধ। সৎ-নিষ্ঠাবান মানুষ, তার নিজের অভিব্যক্তি দিয়েই কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান, যা আমাদের সমাজে বিরল। মনে হচ্ছে, মানুষ যেন হাসতে জানে না। সৎ ও শিক্ষিত মানুষগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না। সৎ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ এক শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব লোকের সাক্ষাৎলাভ মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

আমি সৌভাগ্যবান কারণ আমি বাবা-দাদু ছাড়াও জীবনে অনেক শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করেছি দেশে এবং বিদেশে যা আমাকে অনেক নৈতিক শিক্ষা দিয়েছে। আমার গ্রামের স্কুল, চান্দিনা পাইলট স্কুল, ভিক্টোরিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ সব জায়গায়ই আমি অনেক মহান ও আদর্শ শিক্ষকের সন্ধান ও সান্নিধ্য পেয়েছি। তা ছাড়া ম্যানচেস্টারে Prof Newan, জার্মানিতে Prof. Zenner এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে Prof. Dragamireskii  আমার জীবনের আদর্শ হিসেবে আমার মনের মন্দিরে স্থান করে নিয়েছেন। সব সময় চেষ্টা করি তাদের কারও মতো হওয়া যায় কিনা। কিন্তু বড় কঠিন! তবু তো চেষ্টা করতে মানা নেই। পৃথিবীতে বা উপমহাদেশে দ্বিতীয় ডা. বিধান রায় কেউ হবে না, তবে হওয়ার স্বপ্ন দেখতে অসুবিধা কোথায়?

লেখক :   সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর