সোমবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

গান গাই গান শিখি

রওশন আরা মুস্তাফিজ

হঠাৎ সেদিন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় আমার লেখা ‘গান গাই গান শিখি’ বইটির শিরোনামসহ এদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাইয়ের সংগীত সংক্রান্ত একটি নিবন্ধের দিকে দৃষ্টি হলো। ‘গান গাই গান শিখি’ সংগীত শিক্ষার্থীদের কথা স্মরণ করে লেখা একটি সংগীত শিক্ষাদানের বই। এ বইটি আমি দেশের অগণিত সংগীতপ্রেমী শিক্ষার্থীর কথা স্মরণ করে লিখেছি যা বিগত ২০১৬-এর  একুশে বইমেলায় বটেশ্বর বর্ণন প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাই তার অমূল্য সময় ব্যয় করে আমার বইটির তত্ত্ব তথ্য সংক্রান্ত যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন সে জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। তার রচনায় বাংলাদেশের সংগীত জগতের সামগ্রিক চিত্রকল্প তিনি তুলে ধরেছেন। সংগীত গ্রন্থ প্রসঙ্গে সেই পঞ্চাশ দশকে ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিনের লেখা ‘ছোটদের সারেগামা’ একটি তথ্যসমৃদ্ধ বই যা এখনো সংগীত শিক্ষার্থীদের প্রিয়। আব্বাসী ভাই লিখেছেন, ওস্তাদজীর ওই বইটির পরে আর এ ধরনের বই চোখে পড়েনি। বহুদিন পর অতি সম্প্রতি রওশন আরা মুস্তাফিজ সংগীত নিয়ে, সংগীতের তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক দিক নিয়ে লিখেছেন। মুস্তাফা জামান আব্বাসী ভাইয়ের মতো এদেশের একজন নামিদামি কণ্ঠ সংগীত শিল্পী এবং সংগীত বিশারদ ব্যক্তিত্বের সংগীত সংক্রান্ত আলোচনা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের সংগীতের সামগ্রিক চিত্রের দিকে অবলোকন করলে দেখা যায়, বিগত নব্বই দশকের পর থেকে সংগীতের ভুবনে এক বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে আকাশ সংস্কৃতির বিস্তৃত বিকাশে সংগীত জগতের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। এখন কীভাবে কত তাড়াতাড়ি একজন শিক্ষার্থী সংগীত শিল্পীরূপে নিজেকে শ্রোতার সম্মুখে তুলে ধরতে পারে সেই প্রচেষ্টায় নিজেকে ব্যস্ত রাখে। ফলে সংগীত শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য তা সফল হয় না। নবীন শিল্পী হিসেবে যদি কেউ চমক দেখাতে পারেন তাও হয় সাময়িক। কিছুদিন যেতে না যেতে তার স্থান দখল করে নেয় অন্য কোনো নবীন শিল্পী। অথচ একটা সময় ছিল যখন নিজেকে সত্যিকার অর্থে একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য দেশের জ্ঞানী ও গুণী ওস্তাদদের তত্ত্বাবধানে শিক্ষার্থীরা সকাল-সন্ধ্যা নিয়মিত রেয়াজের মাধ্যমে প্রকৃত শিল্পীরূপে নিজেকে প্রকাশ করার প্রচেষ্টায় নিমগ্ন থাকতেন। ব্যবহারিক সংগীতের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর সহযোগী বাদ্যযন্ত্র ছিল হারমোনিয়াম, তানপুরা এবং তবলা। সেই সঙ্গে সংগীতের তাত্ত্বিক দিক প্রসঙ্গে জ্ঞান আহরণের প্রতিও শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলা হতো। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে সুরের সাধনা করে একজন শিক্ষার্থী নিজেকে শিল্পীরূপে গড়ে তুলতে পারতেন। সেই সময়ে যখন এদেশে নিজেকে সংস্কৃতি মণ্ডলে প্রকাশ করার মাধ্যম ছিল জাতীয় বেতার কেন্দ্র, জাতীয় টেলিভিশন এবং একমাত্র মঞ্চ, তখন সেসব ক্ষেত্রে সুযোগ পাওয়ার জন্য, নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য একজন শিল্পীকে বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করার যোগ্যতা অর্জনের জন্য ‘অডিশন বোর্ড’-এ পরীক্ষা দিতে হতো। অডিশনে পাস করা শিল্পীরা যখন বেতার, টেলিভিশনে সরাসরি গান গাওয়ার সুযোগ পেতেন তখন তাদের মেধা যাচাই করে তাদের ক, খ, গ, শ্রেণিতে ভাগ করা হতো।

গানের ভুবনের এ পরিচিত চিত্র নব্বই দশকের শুরুতে খুব দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল। বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত নতুন নতুন আবিষ্কারের কল্যাণে সারা বিশ্বে বেতার টেলিভিশনের প্রেক্ষাপট দিন দিন পরিবর্তিত হতে শুরু করল। আকাশ সংস্কৃতির নিত্যনতুন ধারার ছোঁয়া আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের সাংস্কৃতিক আবহ বিমূল পাল্টে দিল। আগে যেখানে একটি মাত্র সরকারি বেতার ও টেলিভিশন দেশব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক মণ্ডল নিয়ন্ত্রণ করত আজ সেখানে অসংখ্য বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলের         বিস্তৃত অঙ্গনে প্রচারিত হয় নানা ধরনের দেশি-বিদেশি অনুষ্ঠান। চ্যানেলগুলোতে যারা অংশগ্রহণ করেন তাদের অনেকের ক্ষেত্রে নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা কতটুকু তা নিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে প্রশ্ন থেকে যায়। সংগীতের ক্ষেত্রে যথাযথ শিক্ষা লাভ না করে যদি সরাসরি নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা হয় তাহলে ত্রুটি বিচ্যুতি সহজেই চোখে পড়ে। শৈশবে সংগীতের হাতেখড়ি নেওয়ার সময় অভিভাবকরা যদি গুণী ওস্তাতদের কাছে ব্যবহারিক শিক্ষা এবং সেই সঙ্গে তাত্ত্বিক দীক্ষা দেওয়ার উদ্যোগ নেন তাহলে একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎকালে নিজেকে নিপুণ শিল্পীরূপে গড়ে তুলতে পারে। আমাদের সময়ে আমরা গুণী ওস্তাদদের কাছে শিক্ষালাভ করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখি একশ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রাথমিক সংগীত শিক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে বেতার টেলিভিশন, মঞ্চে নিজেকে প্রকাশ করার আগ্রহ প্রবল।

সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সংগীত যুগে যুগে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আজ আধুনিক ভাবধারার একটা লক্ষ্যে পৌঁছেছে। এক সময় ধ্রুপদ ছিল নির্দিষ্ট সুরধারার সংগীত। এরপর খেয়াল, ঠুমরী, টপ্পা, সাদ্রা, দাদরা প্রভৃতি সংগীতাঙ্গনকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলল। কী কণ্ঠ, কী যন্ত্র উভয় ক্ষেত্রে সংগীত সাধকরা নির্দিষ্ট রীতিনীতিতে দিনের পর দিন সাধনা করেছেন। ওস্তাদ আলী আকবর খান, সরোদ, ওস্তাদ রবিশঙ্কর সেতার, পাশ্চাত্যে ইহুদি মেনুহিল বেহালা বাজিয়ে জয় করেছেন অসংখ্য শ্রোতার হৃদয়। এসব বাদ্যযন্ত্র যাদের সুরের জাদুতে বাজে, সেই সুরের মাধ্যম উচ্চাঙ্গ সংগীত। সংগীতের মূল সুর, সাত সুরের সাধনাই এ উপমহাদেশীয় সংগীতের মূল ভিত্তি। এ মূল সুরের ভিত্তি যেন যথাযথ সঠিক পথে চর্চিত হয়। আমরা যেন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে রাখতে পারি সে কারণেই আমি ‘গান গাই গান শিখি’র মতো তথ্যসমৃদ্ধ একটি সংগীত গ্রন্থ লেখার প্রয়াস করেছি।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সংগীত শিল্পী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর