শনিবার, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

দুর্নীতি প্রতিরোধে ইসলামের শিক্ষা

মুফতি মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহিল বাকী : পেশ ইমাম ও ভারপ্রাপ্ত খতিব

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহতায়ালার জন্য, সালাত ও সালাম তাঁর প্রিয় রসুলের ওপর। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রসুল। দীন ইসলাম আল্লাহ-প্রদত্ত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনবিধান, মানবজীবনের সমস্ত দিক ও বিভাগে তা পরিব্যাপ্ত। জীবনের ক্ষুদ্র-বৃহৎ প্রতিটি বিষয়ে তার বক্তব্য সুস্পষ্ট, বাস্তবভিত্তিক এবং স্থান-কাল-পাত্র ভেদে তা প্রতিপালনযোগ্য। মানবজাতিকে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টির সেরা জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০)। কিন্তু এদের মানবিক চেতনার মধ্যে পাপ-পুণ্যের দুই বিপরীতমুখী উপাদানও রেখে দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘অতঃপর তিনি তাকে তার অসৎ কর্মের ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন।’ (৯৮:৮)। তাই মানুষ অপরাধকর্মে লিপ্ত হতে পারে এবং হয়েও থাকে। ইসলাম মানুষকে একটি উন্নত নৈতিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে এবং মৌলিক মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধন ও মানবকল্যাণে উদ্বুদ্ধ করে। উন্নত নৈতিক চেতনা ও আখেরাতের জবাবদিহি মানুষকে অপরাধ ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত রাখে। ইসলাম শান্তি ও সুবিচারের ধর্ম। প্রতারণা, ধোঁকাবাজি বা ঠকবাজি, অনিয়ম, দুর্নীতি ইসলামের কাক্সিক্ষত শান্তিকে ব্যাহত করে। এসব প্রতিরোধে ইসলামে শাস্তির বিধান ও আইন রয়েছে। শুধু আইন ও বিধান দিয়ে দুর্নীতি, অপরাধ দমন করা যায় না। যেহেতু আইন প্রয়োগে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। অন্যদিকে আইনকে বিভিন্নভাবে ফাঁকিও দেওয়া যায়। সেহেতু ইসলাম দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে, যা বাস্তবসম্মত ও পরীক্ষিত মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। এ কর্মকৌশলের প্রথমটি হলো অন্তরের পরিশুদ্ধি। মানুষের কর্মের উৎস তার অন্তঃকরণ বা কলব। স্বচ্ছ ও নির্মল অন্তর কোনো নীতি-নৈতিকতাবিরোধী কর্মে সমর্থন দেবে না। যে ব্যক্তির অন্তর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সে ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শত চেষ্টা করেও দুর্নীতি করতে পারবে না, পারে না, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্তরের অবস্থান সবচেয়ে শক্ত অবস্থান, তাই ইসলাম প্রথমে অন্তঃকরণ বা কলবকে দুর্নীতিমুক্ত মানসিকতার বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘মানবদেহে রয়েছে একটি মাংসপিণ্ড, সেটি সুস্থ থাকলে পুরো দেহ সুস্থ থাকে। আর সেটি বিনষ্ট হলে পুরো দেহ বিনষ্ট হয়। সেটি হলো কলব বা অন্তঃকরণ।’ এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘সফলকাম হয়েছে সেই ব্যক্তি যে তার অন্তরকে শুদ্ধ করেছে এবং ব্যর্থ হয়েছে সে যে তা অকার্যকর করেছে।’ (আল কোরআন, ৯১:৯-১০)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘ওই ব্যক্তি সফলকাম হয়েছে যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে।’ (আল-কোরআন, ৮৭:১৪)। ইসলাম কলব বা অন্তঃকরণের পরিশুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা চায় যাতে তার মাধ্যমে ব্যক্তিসত্তার পরিচ্ছন্নতা ও পরিশুদ্ধতা অর্জিত হয়। 

দ্বিতীয় কর্মকৌশল হলো প্রত্যেক ব্যক্তির অন্তরে আখেরাতের জবাবদিহির দায়িত্ববোধ সৃষ্টি। ইসলাম মানুষকে শিক্ষা দেয়, তুমি দুর্নীতি করে অপরাধ করে আইনকে ফাঁকি দিয়ে শাস্তি থেকে মুক্তি পাচ্ছ বলে মনে করো না, কারণ আল্লাহ যেদিন বিচারকের আসনে আসীন হবেন সেদিন তাঁর আদালতে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে। অপরাধ গোপন করার জন্য যত সব ব্যবস্থা দুনিয়ায় করে শাস্তি থেকে মুক্তি পেয়েছিলে সেই কৌশল সেখানে কোনো কাজে আসবে না, যেহেতু সেদিন তোমার হাত-পা, অপরাধ করার স্থান সব সত্য সাক্ষ্য দেবে। আল্লাহ তো প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য, গোপনীয়-অগোপনীয় সবকিছু জানেন। তাঁর সামনে কোনো কৌশল চলবে না। আল্লাহর সামনে প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহির সম্মুখীন হতে হবে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে অণুপরিমাণ সৎ কাজ করবে তা দেখবে, অন্যদিকে যে অণুপরিমাণ অসৎকর্ম করবে তাও দেখবে।’ (সূরা জিলজাল, আয়াত ৭-৮)। আল্লাহ সবকিছুর বিচার করবেন। তাঁর সামনে আমার অপরাধ, দুর্নীতি গোপন করার কোনো ব্যবস্থা থাকবে না। অতএব, দুর্নীতি ও অপরাধের কারণে প্রাপ্য শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না- এ আকিদা, বিশ্বাস, মানসিকতা মানুষকে দুর্নীতি ও অপরাধমুক্ত করতে পারে। সেজন্য রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর সামনে হিসাব দেওয়ার সময়ের আগেই নিজের হিসাব নিজে কর।’ আল্লাহর সামনে সঠিকভাবে হিসাব দিতেই হবেÑ এই মানসিকতা সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি পোষণ করলে সেই সমাজে দুর্নীতি ও অপরাধ হবে না।

তৃতীয় কর্মকৌশল হলো সৎকাজে উৎসাহ প্রদান। সুন্দর শান্তিময় জীবন গঠন ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে নীতিসিদ্ধ ও সৎকর্ম সম্পাদনের কোনো বিকল্প নেই। সবাই যখন সৎকাজ করায় উদ্যোগী হবেন, অপরাধীরা নিজে থেকেই নিস্তেজ হয়ে যাবে এবং অপরাধ, দুর্নীতি করতে উৎসাহ পাবে না, এতে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হবে। আল্লাহ মানুষকে সৎ কাজের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেন, ‘মুমিন পুরুষ কিংবা নারী যে কেউ সৎকর্ম করবে আমি তাকে নিশ্চয় পবিত্র জীবন দেব এবং তাদের তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।’ (আল কোরআন, ১৬:৯৭)। এভাবে অসংখ্য আয়াত ও হাদিস রয়েছে যা মানুষকে সৎকাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করে, যাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই দুর্নীতি করার প্রতি মানুষের উৎসাহ কমে যায়। এভাবে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর