মঙ্গলবার, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ-বেদনা এই নিয়ে সাধের দুনিয়া

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

জন্ম-মৃত্যু, আনন্দ-বেদনা এই নিয়ে সাধের দুনিয়া

হঠাৎই ইডেনের সাবেক অধ্যক্ষ মাহমুদা পারভীনের খুনের খবরে যারপরনাই বিস্মিত হয়েছি। জন্ম-মৃত্যুর কোনো নিশ্চয়তা নেই। জন্মের তো তবু কিছু আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু মৃত্যুর কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। ইসমত কাদির গামাকে বিয়ের পর থেকেই পারভীন আমাদের সবার প্রিয়। সুখে-দুঃখে আমরা কাছাকাছি ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পর পারভীন বেশ কিছুদিন ভারতে অমানুষিক কষ্ট সহ্য করেছে। দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা মানুষকে যে কতখানি বিহ্বল করে ফেলে তা আমি দেখেছি। যখন যেভাবে পেরেছি সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। কলকাতা থেকে একবার মেঘালয়ে আমার শিবিরে যেতে ইসমত কাদির গামা দারুণ কষ্ট করেছিলেন। আমার শিবিরে যাওয়ার আগে বেশ কদিন বড় বেশি অন্নকষ্টে ছিলেন। খাবার যে কী অমূল্য নিয়ামক যার খাবার জোটে না এক দিন না খেয়ে থাকলে তিনি বোঝেন। ইসমত কাদির গামার যখন যার সঙ্গেই দেখা হয় তখনই বলার চেষ্টা করেন সাত দিন না খেয়ে থাকার পর কাদের সিদ্দিকী আমায় খাইয়েছিলেন। সাত দিন না হোক এক-দুই দিন সত্যিই গামা না খেয়েছিলেন; যে মানুষটার স্বাধীনতার আগে গণআন্দোলনে ভূমিকা আছে, যার স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা আছে। এখন কেউ কারও কথা ভাবে না, শোনে না। সেই ইসমত কাদিরের স্ত্রী হঠাৎই ঘাতকের হাতে নিহত শুনতেই কেমন লাগে। এমন যদি সামাজিক অবস্থা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হয় তাহলে আমরা দাঁড়াব কোথায়? পরম করুণাময় আল্লাহ পারভীনকে বেহেশতবাসী করুন। ইসমত কাদির গামাসহ তার স্বজনদের এই শোক সইবার শক্তি দিন।

মানুষ তো আল্লাহর বাগানের ফুল। শুকিয়ে গেলে শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ে। আয়ু ফুরালে মানুষও ঝরে যায়। যাওয়া আসার এই দুনিয়ায় সবাইকে যেতে হবে। কেউ অমর নয়, কেউ আল্লাহর ঘর বেঁধে আসেনি। দোষে গুণে মানুষ। আমার এক মুক্তিযোদ্ধা মুসা চৌধুরী সেদিন মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। আমাদের পরিবারের মতো মুসার পরিবারও মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। মুসার ভাই ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে স্কুলে লেখাপড়া করতেন। তাদের সম্পর্ক ছিল খুবই গভীর। সেই হিসেবে আমার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের ছোট ভাইয়ের মতো আচরণ পাওয়ার কথা। মুক্তিযুদ্ধের আগে তেমনটাই পেয়েছি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমাকে অন্যরকম একটি অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় সব অদলবদল হয়ে যায়। মুসা একেবারে সূচনায় সার্কিট হাউস অভিযানে শরিক হতে পারেননি বা হননি। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান হয়েছিলেন। ঝড়ের গতিতে এসে সার্কিট হাউস থেকে গুলি চলায় তুফানের বেগে চলে গিয়েছিলেন।

৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলের প্রতিরোধ ভেঙে যায়। আমরা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যাই। এরপর কালিহাতী যুদ্ধ হয়। তারপর চর-ভর-পাহাড় উল্কার মতো ছোটাছুটি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করি। এক বিকালে কালিয়ান প্রাইমারি স্কুল মাঠে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি আবার আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আস্তে আস্তে দল সুসংগঠিত হতে থাকে। কবে মুসা কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দেন, কার কাছে দেন, কীভাবে দেন সেসব মনে নেই। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান একবার বিদ্রোহ করেছিলেন। তখন তাকে আমরা ক্যাপ্টেন বলে ডাকতাম। বল্লা যুদ্ধের পরাজয়ে কিছুটা বেসামাল হয়ে আমাকেসহ হেডকোয়ার্টার উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। খবর পেয়ে বহেরাতলী গেলে মুহূর্তে তার বিদ্রোহ মাটিচাপা পড়ে যায়। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলে তাকে সুযোগ দেওয়া হয়। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর বন্ধু। বড় ভাইকে লতিফ বলে ডাকেন। আর সেই ফজলুর রহমান আমাকে সম্বোধন করেন ‘স্যার’। মুক্তিযুদ্ধে সেই যে স্যার বলা শুরু করেছিলেন আমৃত্যু তা বহাল ছিল। লতিফ ভাইকে তুই বলে পায়ের ওপর পা তুলে সিগারেট ফুঁকেন। কিন্তু আমার সামনে কখনো সিগারেট ধরেননি, আমার আগে চেয়ারে বসেননি। কাদেরিয়া বাহিনীর শৃঙ্খলতার সিংহভাগ ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের অবদান। অত নিয়মানুবর্তী মানুষ আমি কখনো দেখিনি। মুসা চৌধুরী বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সদ্ভাবের অভাব ছিল না। আজও মনে পড়ে, ’৭০-এর ১ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইল পার্কে বঙ্গবন্ধুর সভা ছিল। সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এখনকার মতো তখন গিজগিজে লোক ছিল না। তবু টাঙ্গাইল শহর লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। পার্কের পশ্চিম দিকে তখনকার ক্রীড়া ভবনের দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেছিলেন। সন্দ্বীপের আহম্মদ শাহ বাঙালি ডুগি-তবলা ছাড়া খালি গলায় গান গেয়েছিলেন। সে এক অসাধারণ জারির মতো গান। তার গানের তালে সারা মাঠ দুলছিল। খালি গলায় অমন অসাধারণ গান ওর আগে পরে কখনো শুনিনি। সভা ছিল সকালে। ১২টার মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর জামালপুর। মুসা চৌধুরী, ফারুক আর আমি ১০০ সিসি হোন্ডায় জামালপুর গিয়েছিলাম। জামালপুর স্টেডিয়ামেও অসম্ভব লোকসমাগম হয়েছিল। খেয়েছিলাম অ্যাডভোকেট সোবহান ভাইর বাড়িতে। সন্ধ্যার পর ফেরার পথে গুবরে পোকার আঘাতে মুসা আহত হয়েছিল। দিকপাইতের কাছে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির বহর আমাদের পাছ করতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, ‘কী রে, তোরা জামালপুর গেছিলি? মোটরসাইকেলে তিনজন কেন, অসুবিধা হচ্ছে না?’ না, কী অসুবিধা হবে। তবু মুসাকে বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। টাঙ্গাইল পর্যন্ত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছিলাম। ২-৪ মিনিট আগ-পিছ আর কি। সেই ছিল মুসার বঙ্গবন্ধুর গাড়িতে চড়া।

হুজুর মওলানা ভাসানীর দল করত বলে মাঝেসাঝে খিটিমিটি যে লাগত না তা নয়। তবে কখনো অসহনীয় হয়নি। আমরাও সহনশীল ছিলাম। নেতাদের তো কথাই নেই। হুজুরের কাছে গেলে অনেক বড় বড় ঘটনাও পানি হয়ে যেত। তা ছাড়া মান্নান ভাই, শামসুর রহমান খান শাজাহান সত্যিই বড় মাপের নেতা ছিলেন। লতিফ সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আল মুজাহিদী, ফজলুর রহমান খান ফারুক; সবার নেতা আবদুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাজাহান, মীর্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, বদিউজ্জামান খান। তাই এখনকার মতো শকুনির কামড়া-কামড়ি ছিল না। ভদ্রতা ছিল, শালীনতা ছিল, ছিল আন্তরিকতা। কোথায় গেল সেসব দিন ভাবলে কেমন হয়ে যাই। এমন রাজনৈতিক সহনশীলতার অভাব থাকলে আমরা স্বাধীনতা পেতাম না। তখন মোবাইল ছিল না, ফেসবুক ছিল না, ছিল না ইন্টারনেট। কিন্তু মানুষে মানুষে একটা প্রাণের যোগাযোগ। মর্যাদার জন্য জীবন দিত। এখন সেসব কোথায় মিলিয়ে গেছে। মুসা নেই তাই কথাগুলো বলছি। কোনো মানুষকেই একেবারে ষোল আনা নিখুঁত ভাবতে নেই। ত্রুটি থাকবেই। তার মাঝে যদি ভালো কিছু বের করে আনা যায় সে-ই তো নেতার সার্থকতা, নেতৃত্বের সার্থকতা, সংগঠনের সফলতা।

মানকারচর-বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়িঘাট-জগন্নাথগঞ্জ হয়ে কয়েক জায়গায় দারুণভাবে আক্রান্ত ও আক্রমণ করে যমুনা দিয়ে যখন ভাটিপথে ফিরছিলাম তখন খবর পাই মুসা চৌধুরী সীমান্তের দিকে যাচ্ছেন। চার-পাঁচ দিন পর যখন কেদারপুরে তখন খবর আসে নানা অভিযোগ থাকার কারণে মুসা ভারত সীমান্ত অতিক্রমের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন। এরপর অনেকদিন আর মুসাকে নিয়ে কোনো আলোচনা ছিল না। মুসার বড় ভাই ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান কাদেরিয়া বাহিনীর এক অসাধারণ সংগঠক। ১৮ হাজার প্রত্যক্ষ যোদ্ধা ও ৭২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক যেন এক সুতোয় বাঁধা। কোম্পানিতে কোম্পানিতে ভাগ কাদেরিয়া বাহিনীর যোদ্ধারা নিয়মিত বাহিনীকেও যেন তাক লাগিয়ে দিতে পারে। শীতের মধ্যে গায়ে কাপড় নেই, পায়ে জুতো নেই। কিন্তু যুদ্ধের তেজ তাদের হানাদারদের চাইতেও শত গুণ বেশি। আগস্টে গুলি লেগেছিল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাই। ২০-২২ সেপ্টেম্বর থেকে যে কটি যুদ্ধ হয় একটিতেও হানাদাররা আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। পিছু হটাই ছিল যেন তাদের প্রধান কাজ। অক্টোবরের ১৪-১৫ তারিখ রমজান শুরু হয়েছিল। আমরা আক্রমণ কিছুটা কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা মোটেই কমেনি। যখন যেখানেই আক্রান্ত হয়েছি সেখানেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে বরং আল্লাহর দয়ায় লাভবান হয়েছি। ঈদের দিন কালিয়াকৈর থেকে টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল থেকে মধুপুর মহাসড়ক দখল এবং বাসাইল, সখীপুর, ভালুকা, ত্রিশাল, গোপালপুর, ভূঞাপুর, চৌহালী, বেতিল, দৌলতপুর, ঘিওর থানা আমাদের দখলে এসে গিয়েছিল। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে ছিল আমাদের প্রাধান্য। অন্য জায়গায় পাকিস্তানিরা কোনো সফলকাম হয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু ঢাকার উত্তরে কোনো যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। যে কারণে যৌথ বাহিনীর কোনো পরিকল্পনা কাজে লাগেনি। আমরা আমাদের পরিকল্পনামতো ঢাকা দখল করে বাঘ বন্দী করেছিলাম।

যুদ্ধের শুরুতেই হানাদাররা আমাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল। তাই আমার থাকার জায়গা ছিল না। আমি থাকতাম ওয়াপদা ভবনে। হঠাৎ এক সন্ধ্যায় ব্রিগেডিয়ারের মা এসে হাজির। তিনি লেখাপড়া জানতেন না। অথচ আমার মায়ের মতো ছিলেন প্রকৃত মা। তাকে মায়ের মতোই সম্মান করতাম। তিনি সম্মান পাওয়ার মতো মানুষ ছিলেন। তার বিদ্যা ছিল না কিন্তু অপরিসীম জ্ঞান ছিল। যখনই তার কাছে গেছি বা তিনি এসেছেন তার জ্ঞানে অভিভূত হয়েছি। তিনি এসেই বললেন, ‘বাবা, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার মুসা ভারতে বন্দী। ও যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তুমি বিচার কর। কিন্তু ভারতের জেলে থাকবে কেন! আমার ছেলেকে আমার কাছে এনে দাও।’ আসলে মুসার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। মুসার মাকে খালাম্মা বলে ডাকতাম। মুসা চৌধুরীর ছোট ভাই বাবুল চৌধুরীকে জুলাই-আগস্টের দিকে হানাদাররা বাড়ি থেকে ধরে নিয়েছিল। তখন তার ১৩-১৪ বছর বয়স। সোজা কর্নেলের কাছে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বড় বড় দুই ছেলে মুক্তিবাহিনীতে। পারলে তাদের ধর। আমার দুধের বাচ্চা এনেছ কেন!’ পাঠান কর্নেল মুসার মায়ের রাগান্বিত কথা বুঝতে পারেনি। এক বাঙালি অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তার মর্ম বুঝিয়ে দেন। কর্নেলের মনে হয় সত্যিই তো যারা যুদ্ধ করছে তাদের ধরে না এনে ছোট্ট বাচ্চাকে কেন? সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেন। একসময় বিএনপির প্রতিমন্ত্রী ঘাটাইলের লুৎফর রহমান খান আজাদের ব্যাপারটাও অনেকটা সেরকম। তারও তখন ১৩-১৪ বছর বয়স বাবুল চৌধুরীর মতো। লুৎফরের বাবা শ্রমিক নেতা হবিবুর রহমান খান। তাকে হেডকোয়ার্টারে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ছেলেটাকে রাখেন। না হলে কখন পাকিস্তানি হানাদাররা ধরে নিয়ে যায়।’ তাকে রাখা হয়েছিল। এমনি কত ঘটনা। স্বাধীনতার পর আমরা ভালো থাকতে পারিনি। বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে কাদেরিয়া বাহিনীর সব অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েও ভালো থাকতে পারিনি। স্বাধীনতার পর টাঙ্গাইলে প্রথম গ্রেফতার হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রবাদপুরুষ আবদুস সবুর বীরবিক্রম ও আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান। সে এক অদ্ভুত রাষ্ট্রদ্রোহিতা! ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমানের বাড়ির ওপর দিয়ে পুরনো শহর থেকে জেলা শহরে টেলিফোনের তার গেছে। শ্রমিকরা ছাদে কাজ করতে সব তার একত্রে বেঁধে রেখেছিল যাতে অসুবিধা না হয়। কনসিল করা ছিল না তাই তারে তারে লেগে সব এলোমেলো হয়েছিল। জেলা সদরের সব টেলিফোন বন্ধ। খুঁজে দেখা গেল ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির ছাদে একত্রে বাঁধা। আর যায় কোথায়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা এবং ব্রিগেডিয়ার গ্রেফতার। ফজলুর রহমানের মা ঢাকায় এসে মাকে বললেন, ‘আপা, আমার ছেলেকে বের করে দেন। না হলে আমি যাব না।’ বঙ্গবন্ধুকে গিয়ে বললাম। তিনি বললেন, ‘বলবেই তো। তোর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে সে জেলে। তুই আমাকে বললে আমি শুনব না এটা কি ব্রিগেডিয়ারের মা বিশ্বাস করবেন। ঠিক আছে তাকে নিয়ে আয়।’ ফজলুর রহমানের মাকে নিয়ে গণভবনে গেলাম। বঙ্গবন্ধু বাগানে ঘুরছিলেন। আমি যেতেই, ‘কী রে, ফজলুর মাকে নিয়ে এসেছিস?’ হ্যাঁ, আপনি অফিসে বসলে তাকে নিয়ে আসি। বললেন, ‘না না, আমার ঘরে আনতে হবে না। চল তিনি যেখানে আছেন সেখানেই যাই।’ আমরা গেলাম। ফজলুর মাকে দেখলেন, কথা হলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘চিন্তা করবেন না। তিন-চার দিনের মধ্যে আপনার ছেলে আপনার কাছে চলে যাবে।’ আমরা ফিরে এলাম মোহাম্মদপুরের বাড়ি। এসেই মাকে বললেন, ‘আপা জানেন, বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে দেখা করেছে।’ মা তো অবাক। তিনি গেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এখন বঙ্গবন্ধুই তার সঙ্গে দেখা করেছেন! পরে বোঝা গেল গণভবনে গিয়ে তিনি যে ঘরে বসেছিলেন সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘরে গিয়ে দেখা না করে বরং বঙ্গবন্ধুই তার ঘরে এসে দেখা করায় তিনি অমনটা বলছেন। আমরাও বুঝলাম তিনি ভুল বলেননি। যে ঘরে বসেছিলেন সেখান থেকে উঠে গিয়ে দেখা করতে হয়নি বরং বঙ্গবন্ধুই তার ঘরে এসে দেখা করেছেন। বড় ক্ষুরধার দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ফজলু, মুসা আর বাবুল চৌধুরীর মা।

মনে হয় সেটা ডিসেম্বরের ২৯-৩০ তারিখ হবে জেনারেল বি এম সরকারকে ব্যাপারটা জানালাম। তিনি বললেন, ঠিক আছে। পরদিন জানাবেন। পরদিন বললেন, ‘তোরা সীমান্তে গাড়ি পাঠিয়ে দাও। তোমার লোককে ওই পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হবে।’ গেল গাড়ি, নিয়ে এলো মুসাকে। মুসার মা মুসাকে নিয়ে এসে কৃতজ্ঞতা জানালেন। কী করতে হবে, মুসা কোথায় থাকবে জেলে না বাড়িতে জানতে চাইলেন। বলেছিলাম, না, আপাতত বাড়িতেই থাক।

ভারতীয় কর্তুপক্ষ কিছু না বললে আমাদের তো কোনো অভিযোগ নেই। সেই মুসা ৯ ফেব্রুয়ারি সব চাওয়া-পাওয়া, সব অভিযোগের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন। আবার ওইদিনই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রখ্যাত কমান্ডার ইদ্রিস কমান্ডারের ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার ছেলে শাওনের শুভ পরিণয়। আর গতকাল ছিল আমার আদরের ধন কুঁড়ি সিদ্দিকীর শুভ জন্মদিন। এই হলো আল্লাহর দুনিয়া। আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্নায় ভরা তার সৃষ্টি। মহাপ্রভুর সৃষ্টির কৌশল বোঝা মানবের ভার। দয়াময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন মুসা চৌধুরীকে বেহেশতবাসী এবং তার পরিবার-পরিজনকে তার অভাব সইবার শক্তি দেন।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর