বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

মেয়েরা যখন লিডার

তসলিমা নাসরিন

মেয়েরা যখন লিডার

বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী নারী, তাই বলে কিন্তু এই নয় যে বাংলাদেশের সব নারীই তাদের স্বাধীনতা এবং প্রাপ্য অধিকার উপভোগ করছে। এখনও দেশের অধিকাংশ নারী, শুধু নারী বলেই, অবহেলিত, অসম্মানিত, অত্যাচারিত, প্রতারিত, নির্যাতিত। নারীকে মূলত অবলা, অসহায়, অক্ষম, অশক্ত প্রাণী হিসেবে বিচার করা হয়। পুরুষতন্ত্র দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।  এমন সময় শুনছি মিরোনা খাতুন নামে বাংলাদেশ নেভির এক জাতীয় দলের খেলোয়াড় ঢাকা সিটি ফুটবল ক্লাবের কোচ হতে যাচ্ছেন। এই ফুটবল ক্লাবটি পুরুষদের। না, মিরোনার চেহারা দেখে কেউ তাকে কোচ বানায়নি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কোচিং কোর্সগুলো রীতিমতো সম্পূর্ণ করে, নিজের যোগ্যতা বার বার প্রমাণ করে তবেই মিরোনা কোচিংয়ের লাইসেন্স পেয়েছেন, যে লাইসেন্স ফুটবল ক্লাবটির আগের পুরুষ কোচটিরও ছিল না। মিরোনা বেজায় খুশি। ইতিহাস সৃষ্টি করলেন পুরুষ ফুটবল দলের প্রথম নারী-কোচ হয়ে। সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘এখন ওরা আমাকে মেনে নিলেই হয়’। ওরা মানে পুরুষেরা। পুরুষদের তো নারীকে গুরু মানার, দলপ্রধান মানার, শিক্ষক মানার, প্রভু মানার অভ্যেস নেই।

বাংলাদেশ একা নয়, বেশ কিছু দেশেই পুরুষ-ফুটবল অথবা বাস্কেটবল এবং অন্যান্য আরও কিছু খেলার দলের কোচ নারী। নারীরা আর্মির জেনারেল, এডমিরাল, প্লাটুন কমান্ডার, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, রাজ্যের গভর্নর, রাষ্ট্রের মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারেন, আর ছেলেদের ফুটবল দলের কোচ হতে পারবেন না? নারী নিয়ে সবারই অনীহা, আপত্তি। তাই পুরুষের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয় নারীকে, পুরুষের চেয়ে নারীকে যোগ্যতার প্রমাণ বেশি দিতে হয়। অনেক দেশে, এমনকি আমেরিকাতেও নারীকে ফুটবল দলের কোচ হিসেবে অনেক পুরুষই পছন্দ করে না। নারীরা ভালো কোচ হতে পারলেও, যেনতেন খেলোয়াড়দেরও খুব ভালো খেলোয়াড় বানাতে পারলেও, কোথাও যেন অসন্তোষ থেকে যায়। পুরুষ-খেলোয়াড়দের মধ্যে অনেকেই শুধু খেলার কায়দা কানুন জানলেই সুখী নয়, আমি পুরুষ-আমি শ্রেষ্ঠ এই পুরুষালি অনুভবকেও অন্তরে ধারণ করতে চায়। এর জন্য একজন নারী-কোচের চেয়ে একজন পুরুষ-কোচের বেশি দরকার তাদের। এই সংখ্যাটা, দুঃখজনক এই, যে, অতিরিক্ত। নারীকে এই সমাজ সবার আগে শরীর হিসেবে ভাবতে শিখেছে। নারী-কোচের শরীর নিয়ে বদভ্যেসবশত মাঠে কথা হয়। রূপসী হলে পুরুষ- খেলোয়াড়রা তাকে কামনা করে, কুৎসিত হলে ছ্যা ছ্যা করে। তাহলে কি নারীকে রূপসী হওয়াও চলবে না, কুৎসিত হওয়াও চলবে না? এত কিছুর চাপ তো পুরুষ-কোচের ওপর নেই। কিন্তু পুরুষের চেয়ে নারী যদি কোচ হিসেবে ভালো হয়? তাহলে কি নারীকে শুধু নারী হওয়ার কারণে বঞ্চিত করা হবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের সমাজ কট্টর পুরুষতান্ত্রিক। এই সমাজ নারীকে পুরুষের অধীন হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। নারী যৌনবস্তু, নারী দাসী, ক্রীতদাসী, নারী পতিতা, নারী অধঃস্তন কর্মচারী, নারী শিক্ষিকা হলেও বালিকাদের শিক্ষিকা, নারী ডাক্তার হলেও মহিলা রোগীদের ডাক্তার, নারী নিরীহ মা, বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা, নারী কন্যা। নারী ধর্ষণের শিকার, ভায়োলেন্সের শিকার। নারী সম্পর্কে ধারণা অধিকাংশ পুরুষের এমনই। নারী যে সক্ষম, সমর্থ, নারী যে সফল, শক্তিময়ী, পুরুষ যে যে কাজ করতে পারে, তার সবই যে নারীও পারে, নারী যে একাই একশ- এ সম্পর্কে ধারণা মানুষের কম, অথবা ধারণা ঠিকই আছে, কিন্তু এ নিয়ে অনেকের ভাবতে ভালো লাগে না। পুরুষকে প্রভুর আসনে বসিয়ে এক কৃত্রিম আমোদ পেতে ভালোবাসে। জন্মের পর থেকে ছেলেমেয়ে উভয়কেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এমনই শিক্ষা দেয় যে মেয়েদের আদেশ দাও, উপদেশ দাও। কিন্তু মেয়েরা তোমাদের আদেশ উপদেশ দেওয়ার যোগ্য নয়। কারণ মেয়েরা জানে কম, বোঝে কম, মেয়েদের জ্ঞান কম, মেয়েদের বুদ্ধি কম, মেয়েদের আত্মবিশ্বাস নেই, মেয়েরা ভীতু, ভীরু, হীনমন্য। অমন কুশিক্ষা দিয়ে মগজধোলাই হওয়ার পর কী করে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা কোচ হিসেবে মেয়েদের মেনে নেবে? অন্যান্য দেশে সমস্যা হলেও বাংলাদেশে, আশা করছি, নারী-কোচ নিয়ে খুব সমস্যা হবে না। এই জন্য সমস্যা হবে না, যে, মানুষ ইতিমধ্যে নারীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছে। শুধু মেনেই নেয়নি, প্রধানমন্ত্রীকে রীতিমতো ভয় পায়। ভয়ে তার সম্পর্কে কোনও কটু কথা উচ্চারণ করে না। সমীহ করে চলে, শ্রদ্ধা করে, তার সামনে মুহুর্মুহু মাথা নোয়ায়। নারীকে নিয়ে হাসাহাসি করতে হবে, কুৎসিৎ ইঙ্গিত করতে হবে, রসের আলাপ করতে হবে, নারীকে ঠেলা গুঁতো দিতে হবে, নারীকে গালি দিতে হবে- এই যে কতগুলো বদভ্যেস পুরুষেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তুলেছিল, সেসব প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে কিছুটা তো দূর হয়েছে। আশা করি, তিনি শুধু নিজের নয়, গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল নারীদের ওপর হওয়া যাবতীয় পৌরুষিক নোংরামি বন্ধ করার চেষ্টা করবেন। যে নারী আজ ফুটবল ক্লাবের কোচ হলেন, সেই মিরোনা খাতুনকে যেন শুধু নারী হওয়ার কারণে অপদস্ত হতে না হয়। প্রথম নারী যদি কোচ হিসেবে বহাল থাকতে না পারেন, তাহলে হয়তো পুরুষ খেলোয়াড়দের কোচ হিসেবে আর কখনোই নারীর কথা কেউ ভাববে না। নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ নষ্ট হবে, নারীর সমানাধিকার অর্জন সম্ভব হবে না।

এই বৈষম্যের সমাজে পুরুষকে যেহেতু অভ্যেস করানো হয়েছে, মগজধোলাই করানো হয়েছে, নারীকে নিচু জাতের শ্রেণির প্রাণী হিসেবে দেখতে, তাই একটি সমতার সুস্থ সভ্য সমাজ তৈরির জন্য নারী-পুরুষ উভয়কেই নারীকে পুরুষের দলনেত্রী পদে রাখতে হবে। এভাবেই যদি পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন হয়। নারী শুধু মা বোন স্ত্রী কন্যা নয়, নারী শুধু হুকুমের দাসী নয়, নারীর কাজ শুধু রান্নাবান্না আর সন্তান উৎপাদন নয়, সন্তান লালন পালন নয়, নারী নেত্রী, নারী শিক্ষিকা, নারী কোচ, নারী বিজ্ঞানী, নারী বৈমানিক, নারী গুরু, নারী উপদেষ্টা, নারীর আদেশ মেনে চলতে হবে। নারী-বিরোধী থিউরি যা মুখস্থ করেছে লোকে, তা প্র্যাক্টিক্যাল দিয়ে ভুল প্রমাণ করতে হবে।

সমাজের সর্বস্তরে নারীর বিচরণ চাই। নারীকে শুধু শ্রমিক নয়, মালিকও বানাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শুধু নিজের, নিজের পরিবার পরিজন আর কাছের লোকদের ক্ষমতায়নের কথা ভাবলে তিনি শুধু এদের কাছেই অমর হবেন। কিন্তু গোটা দেশের কাছে নিজেকে অমর করতে হলে গোটা দেশের অবহেলিত অসম্মানিত অত্যাচারিত নারীর কথা ভাবতে হবে, সব নারীকে শিক্ষিত এবং সফল করে তোলার পক্ষে, যোগ্য নারীদের যোগ্য সম্মান দেওয়ার পক্ষে, কর্মস্থলকে নারী-বিদ্বেষমুক্ত রাখতে সরকার যদি উদ্যোগ না নেয়, তবে ব্যক্তির উদ্যোগে অসম্ভবকে সম্ভব করা যাবে না। মিরোনাকে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হলো।  এরকম শত শত মিরোনাকে দেখতে চাই, যারা শুধু খেলোয়াড়দের দক্ষ খেলোয়াড় বানাবে না, যারা পুরুষের নারী-বিদ্বেষও দূর করবে,  পুরুষকে মানুষ বানাবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর