মঙ্গলবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

কষ্ট দিবসের একটি প্রস্তাবনা

শামীম আল আমিন

এ পৃথিবীতে এমন কোনো মানুষ কি আছেন, যিনি হলফ করে বলতে পারবেন, তার কোনো কষ্ট নেই; কিংবা তিনি কোনো দিন কষ্টের কোনো অনুভূতি পাননি। আমি মনে করি উত্তরটা হবে ‘না’। কোনো কিছু অর্জন করতে চেয়ে না পারার কষ্ট; কোনো কিছু হারিয়ে ফেলার বেদনা কিংবা ভালোবেসে বিফল হয়ে যাওয়ার মনযন্ত্রণা; একেকজনের কষ্টের আছে রকমফের। অনেকে আবার শারীরিক যাতনাকেও কষ্টের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। সেটাও আরেক ধরনের কষ্ট বটে।

আমি মনোবিজ্ঞানী নই। ফলে কষ্টের আসল সংজ্ঞা কিংবা ব্যাখ্যা হয়তো দিতে পারব না। কিন্তু এটুকু বুঝি, কষ্ট হচ্ছে মানসিক নেতিবাচক অনুভূতি। অনেক সময়ই যার শরীরবৃত্তীয় প্রকাশও ঘটে। আমরা অনেক সময়ই বলি ‘মন খারাপ’। আর এ মন খারাপ হওয়ার পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে বেশি দায়ী, তার নাম ‘কষ্ট’। কষ্ট কীভাবে পায় মানুষ? কেউ কাউকে কষ্ট দেয়। আবার প্রাকৃতিক কারণেও মানুষ কষ্ট পায়। আবার অনেকে হয়তো পারিপার্শ্বিক কোনো কারণে প্রভাবিত হয়ে কষ্ট পায়। ভালোবাসা যেমন একটি অনুভূতি এবং তার প্রকাশের নাম। কষ্টও তেমনি। এটা অনেকটা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মতো। আবার অনেক সময় এটা বলা যায়, প্রদীপের নিচেই যেমন অন্ধকার। আলোর পাশে অন্ধকারের উপস্থিতিই বলে দেয় পৃথিবীর রং রূপ কতটা বিচিত্র। আর এসব বৈচিত্র্যই কিন্তু ধরা দিয়েছে শিল্পে সাহিত্যে। কোনো শিল্প সাহিত্যই জীবনের বাইরে নয়। অর্থাৎ জীবন থেকে নেওয়া অনুভূতির বিস্তারই হচ্ছে এসব মাধ্যমের উৎস। এ কারণেই শিল্প-সাহিত্যে ভালোবাসার কথা যত বেশি উচ্চারিত হয়েছে তেমনি কষ্টের কথাও কিন্তু কম বলা হয়নি। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গানে লিখেছেন,

‘চেয়েছিনু যবে মুখে তোলো নাই আঁখি/

আঁধারে নীরব ব্যথা দিয়েছিল ঢাকি’।

কবিগুরু ‘নীরব ব্যথা’র কথা বলেছেন। সেই ব্যথার নামই কষ্ট। আবার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘তোমারে পড়িছে মনে’ কবিতায় লিখেছেন-

‘আমার বেদনা আজি রূপ ধরি’ শত গীত-সুরে/

নিখিল বিরহী-কণ্ঠে-বিরহিনী-তব তরে ঝুরে!/

এখানেও যে ‘বেদনা’র উপস্থিতি, সেটাও কিন্তু কষ্টই। কষ্টকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আবার অনেক কবি মিনতিও করেছেন। জীবনানন্দ দাশ যেমন কবিতায় লিখেছেন,

‘সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,/

বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;/

ফিরে এসো সুরঞ্জনা/

নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;

সুরঞ্জনার ফিরে আসার ওপর নির্ভর করছে সুখ কিংবা দুঃখ। কষ্ট কিংবা প্রাপ্তি। আবার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় জগজিৎ সিং যখন গেয়ে চলেন ‘বেদনা মধুর হয়ে যায়, তুমি যদি দাও’। তখন এই ‘বেদনা’ বা ‘কষ্ট’ পায় অন্য রূপ। এর মধ্যে প্রাপ্তির উপলক্ষও যেন থাকে। আবার হাল আমলে শিল্পী আইয়ূব বাচ্চুর কণ্ঠে যেমন শুনি,

‘আমার একটা নির্ঘুম রাত/

তোমার হাতে তুলে দিলেই/

বুঝতেই তুমি কষ্ট কাকে বলে’/

এ গানে প্রেয়সীর প্রতি এক ধরনের নিবেদন বোঝায়। কতটা কষ্ট নিয়ে একজন মানুষ তার অপেক্ষায়, এমন ধারণাও দেয়। আবার এ প্রশ্নও করা যায়, ‘কষ্ট’ কি কেবলই ‘বিরহের বেদনা’? না, তা নয়। কষ্ট বহুরূপী। মানুষের একেক সময়ের একেক অবস্থানে, কষ্টের কারণ ও ধরন বদলায়। যে কারণে হেলাল হাফিজের ‘ফেরিওয়ালা’ কবিতায় অন্যভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘কষ্ট’। তিনি লিখেছেন,

‘কষ্ট নেবে কষ্ট/

হরেক রকম কষ্ট আছে/

কষ্ট নেবে কষ্ট!/

লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট/

পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,/

আলোর মাঝে কালোর কষ্ট/

‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে/

কষ্ট নেবে কষ্ট।/

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার একটি লেখায় লিখেছেন, ‘মানুষের কষ্ট দেখাও কষ্টের কাজ’। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ‘কষ্ট’ বিষয়টা বহুমাত্রিক ও বহুরূপী। আমি একবার কিছু একটা লিখতে গিয়ে কয়েকটা লাইন চলে এলো। ছেলেমানুষী ভাবনা থেকে কবিতার চারটি লাইন তুলে ধরছি এখানে।

‘কষ্টের কথা কি বলবো,/

কষ্ট কাকে বলে!/

কষ্ট হলো মনের আগুন/

বুকের ভেতর জ্বলে’।

কষ্টকে তখন ‘মনের আগুন’ বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। আজও তাই মনে হয়। বিষয় যাই হোক, মানুষের মনটাই যে সব এটাও নিশ্চিত করেই বলা চলে। আর ‘মনের অসুখ’ হলে ভালো লাগে না রাজপ্রাসাদও। মন বসে না রাজ্য কাজে। ফলে মানুষের কষ্টের অনুভূতিকে আমি দেখি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে।

উপরের অংশটুকু একটি দীর্ঘ ভূমিকা। আসলে একটি প্রস্তাব রাখার জন্যই এ লেখাটির অবতারণা। কেউ একমত হতেও পারেন, কেউ বলতে পারেন ‘আবোল তাবোল’ ভাবনা। যে ‘কষ্ট’ মানুষের কাক্সিক্ষত নয়, যাকে মানুষ এড়িয়ে যেতে চায়, সেই কষ্ট কিন্তু ভীষণভাবেই মানুষের জীবনে জেঁকে বসে আছে। ভীষণভাবে প্রভাবিত করে চলেছে মানুষের জীবনকে। ফলে এই কষ্টের জন্য আমি একটি দিন চাইছি। বছরের ৩৬৫টি দিনের মধ্যে একটি দিন হোক ‘কষ্ট দিবস’। কষ্টকে সহ্য করার ধৈর্য, সাহস এবং প্রজ্ঞা অর্জন, কষ্ট থেকে মুক্তি আর কষ্টের অনুভূতিকে অনুধাবন করার জন্য একটি বিশেষ দিন দরকার। ভালোবাসার জন্য যদি একটি দিন থাকতে পারে তাহলে কষ্টের জন্য নয় কেন? কষ্টের অনুভূতি ভালোবাসার বিপরীত হলেও সেটিও প্রচণ্ড এবং তীব্র। ফলে এ তীব্র অনুভূতির জন্য একটি দিন রাখা যেতেই পারে। ভ্যালেন্টাইন ডে বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ১৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সবাই কি ভালোবাসার অনুভূতি পান? অনেকে কি তীব্র কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়ান না! বুকে হাত দিয়ে বলুন। তাই আমার প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ভ্যালেন্টাইন ডে’র পরের দিনটাই হতে পারে কষ্ট দিবস। ১৫ ফেব্রুয়ারি, বিশ্বজুড়ে পালিত হোক ‘কষ্ট দিবস’। নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের কষ্ট, বাবা-মা হারা সন্তানের কষ্ট কিংবা প্রেমিক-প্রেমিকা হারানোর বেদনা। হতে পারে অকালেই সন্তান হারানোর তীব্র শোক। আবার কখনো ঘরের কষ্ট, পরের কষ্ট। কারণ যাই হোক, কষ্ট আছে, থাকবেই। অথচ কষ্ট থাকুক, সেটা কেউ চায় না।  কিন্তু কষ্টের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার নয়। চলুন কষ্ট নিয়ে একটি দিন একটু বেশিই না হয় ভাবি।  কষ্ট তাড়ানোর শক্তি অর্জনের পথ খুঁজি। অন্তত ভালো থাকার চেষ্টা করি।

লেখক : সাংবাদিক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর