রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
আইন-আদালত

ধর্ষিতার বিচারে আইনি জটিলতা

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

ধর্ষিতার বিচারে আইনি জটিলতা

একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়ে আদালতে বিচার চাইতে গেলেই বিরুদ্ধপক্ষ তার চরিত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তোলে। ধর্ষিতাকে মানসিকভাবে হেনস্তা করতেই মূলত প্রতিপক্ষ এমনটা করে। আমাদের দেশের প্রচলিত আইনও ওই নারীকে ‘দুশ্চরিত্রা’ আখ্যায়িত করতে নানা আইনি প্রক্রিয়াকে সমর্থন করেছে। আদালতে এভাবে মান-ইজ্জত নিয়ে ‘টানাহেঁচড়া’ দেখে ধর্ষিতা বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে অনেক ভুক্তভোগী আদালতবিমুখ হয়ে পড়েন। আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষণের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যদি যৌনসঙ্গম করেন তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় এবং অন্য একটি মামলায়, যা ১৭ বিএলটিএর ২৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে তাতে আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তাহলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না। আমাদের সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায় যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনোরূপ বাধা না দেয় অথবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে। এবার আসল কথায় আসি। আমার এ লেখাটি মূলত ধর্ষণের শিকার একজন নারী বিচার চাইতে গিয়ে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই আবারও যে জনসমক্ষে ধর্ষণের শিকার হন, সে বিষয়টি তুলে ধরা। আমাদের সাক্ষ্য আইনে ১৫৫ ধারার ৪ উপধারার সুযোগে ধর্ষক সাধারণত ধর্ষিতাকে ‘কুচরিত্রা’ প্রমাণের চেষ্টা করে। এর কারণ হচ্ছে, ওইরূপ প্রমাণ করতে পারলেই ধর্ষক ধর্ষণের অভিযোগ থেকে বেঁচে যেতে পারে। এ ধারায় বলা আছে যে, কোনো ব্যক্তি যখন ধর্ষণ বা বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা। এ সুযোগে ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্রহনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। এ দিকটির নেতিবাচক বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। State of Punjab v. Gurmit Singh; (1996) 2 SCC 384 মামলায় অভিযুক্ত পক্ষ কর্তৃক ধর্ষিতাকে জেরা করার সময় আদালতের দায়িত্ব সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে তা নিম্নরূপ : ‘অভিযোগকারীর সত্যনিষ্ঠা এবং তার সাক্ষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা জেরা করার মাধ্যমে যাচাই করার জন্য অভিযুক্তকে যেমন স্বাধীনতা দেওয়া উচিত, তেমনিভাবে আদালতকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে ধর্ষিতাকে হয়রানি বা অপমানিত করার জন্য জেরা করা হচ্ছে কিনা। স্মরণ রাখতে হবে, ধর্ষণের শিকার নারী ইতিমধ্যে দুঃখজনক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন এবং তাকে যদি ওই অপরিচিত ঘটনার শিকার হওয়া নিয়ে পুনরাবৃত্তি করতে হয় তাহলে সে লজ্জায় নির্বাক হয়ে থাকতে পারেন এবং তার নীরবতাকে ভুল করে সাক্ষ্যের ‘অমিল এবং স্ববিরোধ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকতে পারে।’ সাক্ষ্য আইনে ইন্ডিয়া যেরূপ সংশোধন এনেছে, সেরূপ আমাদের দেশের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫-এর উপধারা ৪ বাদ দেওয়া যুক্তিযুক্ত। এ ধারাটি আদালতের কাজে এলেও বর্তমানে ধর্ষিতার ন্যায়বিচারপ্রাপ্তিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনাকীর্ণ আদালতে ধর্ষিতাকে হেনস্তা করার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এ আইনকে। একজন ধর্ষিতা আদালতে বিচার চাইতে এসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আবারও ধর্ষণের শিকার হন। কারণ এ ধারা প্রয়োগ করলে ধর্ষিতার অতীত যৌনজীবন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়; যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় একটি বিষয়। প্রতিপক্ষের আইনজীবী বার বার প্রমাণের চেষ্টা করেন আসলে ধর্ষিতা এ রকমের যৌন সম্পর্কে অভ্যস্ত। খোদ একটি আইনের ধারাই যেখানে ধর্ষিতাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই ধর্ষিতাকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনোভাবেই রক্ষা করতে পারবে না। এ ধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এ ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এ দেশে আছে। অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সচ্চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান  যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫) মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজপড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’ পৃথিবীতে এমন কোনো সভ্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে আইনের বিকাশ হয়নি। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ‘আইন’ ধারণাটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে আইন তার কার্যকারিতা হারায়। প্রয়োজন হয় সে আইনকে সময়োপযোগী করে তোলা। গঠনমূলক সমালোচনার মধ্যেই আইন তার অস্তিত্বের সন্ধান পায়। কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২-এর ধারা ১৫৫-এর উপধারা ৪-এর বিধান বাদ দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।

 

সর্বশেষ খবর