মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিউইয়র্ক হারাল যে সদাস্মার্ট যুবককে

সালেম সুলেরী

নিউইয়র্ক হারাল যে সদাস্মার্ট যুবককে

প্রিয় শহর নিউইয়র্ক থেকে অনেক দূরে। কিন্তু ফিরলেও সেই হাসিমুখটি আর মিলবে না। সে ছিল কমিউনিটির অত্যন্ত পরিচিতজন। কারও সঙ্গে তেমন বিরোধ দেখিনি। একদা সাংবাদিকতায় নিবেদিত ছিল। কিন্তু কমিউনিটির বাংলা মিডিয়া ততটা স্বনির্ভর নয়। এজন্য মুঠোভরা সম্মানি দিতে পারে না। অধিকাংশেরই ‘আয় দিয়ে দায়’ মেটানোর অবস্থা। ফলে এই প্রিয়মুখটি ট্যাক্সিতে মনোযোগ দিয়েছিল। বিচিন্তা সম্পাদক মিনার মাহমুদও ট্যাক্সি চালাত। তসলিমা নাসরিনের এক পর্বের স্বামী। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি বন্ধু, এখন প্রয়াত। নিউইয়র্কে পুনঃসাক্ষাতের পর একটি প্রশ্ন করেছিলাম। কাজকর্ম কোথায়, কেমন চলছে। উত্তর করেছিল- সড়ক পরিবহন সেক্টরে।

মিনারের মতোই পিছুটানহীন জীবন ছিল বন্ধুটির। প্রবাসে পোশাকি নাম গোলাম মল্লিক। বাংলাদেশ থেকেই জানাশোনা। আমরা চিনতাম ‘গোলাম হোসেন বেচু’ নামে। চলচ্চিত্রবিষয়ক সাংবাদিকতা করেছে দীর্ঘদিন। পৈতৃকবাস মধু-মৎস্য খ্যাত বৃহত্তর খুলনায়। মফস্বল সাংবাদিকতা দিয়ে জীবনের শুরু। হঠাৎ আলোচনায় এলো এক চিত্রনায়িকাকে বিয়ে করে। ‘নীপা মোনালিসা’র প্রথম স্বামী মল্লিক। বিয়েটা অবশ্য টেকানো যায়নি। পরে ঘরনি করেছে একজন বিমানকন্যাকে। প্রবাসিত সে ঘরে সন্তান-সুখও মিলেছিল। তার পরও বোহেমিয়ান ছিল জীবনযাপন। নিউইয়র্কে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হতো। ফেসবুক পোস্টে নানামুখী নারীর সঙ্গ। মূলধারার বিনোদনজগৎই যেন তার আরাধ্য। ২০০৮-এর এক পরিষ্কার দুপুর। আমি তখন সাউথ জ্যামাইকার ন্যাডাল প্লেসে। দুজন বিখ্যাত বন্ধুকে নিয়ে মল্লিক হাজির। সাংবাদিক মাহমুদ তাসের ও নাজমুল আহসান। প্রথমজন তখন ইত্তেফাকের নিউইয়র্ক প্রতিনিধি। দ্বিতীয়জন ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আমার অফিস কাম বাড়িটি হৈ হৈ করে উঠল। মল্লিক বলল, আজ শুধুই আড্ডা। সোমরসে-সিক্ত দুপুরটা কাটাব স্মৃতিচারণা দিয়ে। আজ চার মহারথীর প্রথম জীবনের গল্প। একজন করে বক্তা, তিনজন শ্রোতা। সময়সীমা- এক গ্লাস জলের চুমুকসীমা। এক রাউন্ড গ্লাস-জল শেষ, বক্তব্য শেষ। এরপর আরেকজন, এভাবে চলবে।

মল্লিক একদা কবিতাও লিখেছে। আড্ডাসূত্রে বেরিয়ে এলো তথ্যটি। নাজমুল বললেন, দু-একটি কবিতা শুনি। মল্লিক জানাল, স্মৃতিতে কিছুই নেই। প্রেমের দেবীরা হাওয়া, কবিতাও হাওয়া। তবে মাহমুদ তাসেরও কবিতা লিখত। এখন ‘অলমোস্ট রিটায়ার্ড’ অবসরপ্রাপ্ত। সেই অঙ্কে- সুলেরী আমাদের কবিতামন্ত্রী। যা চালাচ্ছে সবি চলছে। রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, ওয়াও...।

ওই দিন মল্লিক খুলনা-জীবনকে খুলে দিয়েছিল। মাহমুদ তাসেরের পৈতৃকবাস বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ। কিন্তু বেড়ে উঠেছেন খুলনাতেই। ফলে দুজনের গল্প যেন অনেকটা এক। তার পরও গোলাম মল্লিক পুরোদস্তুর খুলনার পোলা। নানা বিবরণে এঁকে গেল নানা চিত্র। আমরা বললাম, স্থানীয়রা খুলনাকে ‘খুলনে’ বলে। মল্লিকের রসসিক্ত সংলাপেও তা প্রকাশ পেল। সেদিন থেকে আমরা মল্লিককে ‘খুলনে’ নামে ডাকি। দেখা হলেই- হ্যালো মি. খুলনে!

না, এতে তেমন অভিযোগ করত না। তবে অনুযোগের সুরে বলত, প্লিজ আর না। আমরাও যেন নাছোড়বান্দা। বলতাম, তাহলে আসল নামেই ডাকি- ‘বেচু’। সেটাই তো বাবা-মা আর এলাকাবাসীর প্রিয়। প্রতি উত্তরে বলত- সর্বনাশ। এটা তো প্রবাসীদের প্রিয় নাম নয়। কেন ‘মল্লিক’ নামে ডাকতে কি গলায় কাঁটা বাঁধে।

সব বাধা ছিন্ন করে চলে গেল বন্ধুটি। পৃথিবীতে দোষে-গুণেই মানুষ। আমি সবার গুণপনাকে আগে বিবেচনা করি। মল্লিককে শুরু থেকেই আমার ভীষণ পছন্দ। আশির দশকে ঢাকায় পরিচয়পর্ব থেকেই। স্ত্রী নীপা মোনালিসাকে হারানোর পর কী বিপর্যস্ত! আকস্মিকভাবে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। এরপর জীবনের চর ঠেলে স্রোত এনেছিল। আটলান্টিকের পাড়ে- নিউইয়র্কে কত ঝড়। কত উথাল-পাতাল ঢেউয়ের মুখোমুখি। কিন্তু সমাজে পরাজিত হতে চায়নি। আজীবন একটি স্বর্ণবৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছিল। আর তা হলো- ‘অলটাইম স্মার্টনেস’।

নিজেকে চমৎকারভাবে উপস্থাপনের প্রোজ্জ্বল ক্ষমতা। জীবনে অনেক বিত্তশালী, প্রতিভাধর দেখেছি। এমন স্বাগতিক বা স্মার্ট মানুষ তেমন দেখিনি। গোলাম মল্লিকের তিরোধান- এক সুবিশাল অভিশাপ। বিশেষত আমরা যারা বন্ধুনির্ভর প্রবাস পরিজন। বুকে জড়িয়ে ধরার মানুষগুলো দ্রুত সরে যাচ্ছে। খ্রিস্ট্রীয় বর্ষের সূচনা মাস জানুয়ারি। এ মাসেই খরচের খাতায় গেল মল্লিক। রূপসা নদী-ছোঁয়া সাঁতার-শৈশব। আটলান্টিক মহাসাগরের উপকণ্ঠে বিলীন। মাঝখানে ৬০ বছরের উদ্যম আয়ু। মল্লিকবিহীনতায় এখন আচার-অনুষ্ঠানাদি। নিউইয়র্কের বাঙালি ঘরানা যেন অনেকটাই ম্লান। বিদেহী আত্মার স্বর্গীয় সুখ কামনা। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে রাখি বিনীত অনুরোধ। স্বর্গেও যেন সে চিরস্মার্টই থাকতে পারে। সেই সক্ষমতার পক্ষে আমাদের ইহলৌকিক আবেদন।

                লেখক : কবি

 

সর্বশেষ খবর