বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিষাদ ছুঁয়েছে মন রাজনীতি আজ বন্ধ্যা নদীর মতোন

পীর হাবিবুর রহমান

বিষাদ ছুঁয়েছে মন রাজনীতি আজ বন্ধ্যা নদীর মতোন

শীত চলে গেছে। বসন্তের বাতাস বইছে। কোকিলের প্রাণ আকুল করা ডাক থামছে না। কখনো শিলাবৃষ্টি কখনোবা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ঢাকা উত্তরের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলামের একতরফা নিষ্প্রাণ প্রচারণা চলছে। বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় যেমন নেই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন নেই ভোটযুদ্ধের উত্তাপ। একটা প্রাণহীন পরিবেশ।

সারা দেশে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের প্রচারণা চলছে। সেটিও যেন আনন্দহীন, উত্তেজনাহীন। এর মধ্যে চকবাজার ট্র্যাজেডিসহ সবকিছু মিলিয়ে কোথাও যেন কোনো আনন্দ নেই। প্রাণ নেই। যেন বিষাদ ছুঁয়েছে দেশ। বিষাদ ছুঁয়েছে মন। কারও আজ মন ভালো নেই। কোথাও কারও মন ভালো নেই। দায়িত্বশীলদের অতিকথনে মুখর বাংলাদেশ। সংসদ আছে। সেখানে বিরোধী দল চকবাজার ট্র্যাজেডি নিয়ে তুমুল বিতর্কের ঝড় তোলে না। শোকপ্রস্তাবেই সব সুখ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকলেও মন্ত্রীদের কাছে প্রশ্ন উত্থাপনকারী সরকারি দলের এমপিরাও উপস্থিত হন না।

নিমতলীর চুড়িহাট্টায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া ভয়ঙ্কর অগ্নিকান্ডে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। স্বজনরা আগুনে পোড়া কয়লা হয়ে যাওয়া মানবকঙ্কাল পেয়েছেন। এই শোকাবহ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়েছে। বাতাসে এখনো আগুনে পুড়ে মরা মানুষের গন্ধ। এখনো মাতম থামেনি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাটেনি। এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপ থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার জন্য কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার দাবি যেমন উঠেছে, কাজও শুরু হয়েছে। ঘিঞ্জি সরু গলির পুরান ঢাকার চিত্র। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর মৃত্যুকূপ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পুরান ঢাকার একেকটি ভবন মানেই একেকটি কেমিক্যালের গোডাউন। নিরাপদ সুন্দর ঢাকা গড়ার কোনো পরিকল্পনা, উদ্যোগ নেই।

২০০৯ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডির পর ১০ বছরে এই বিপজ্জনক কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা দায়িত্বশীলরা করতে পারেননি। করতে পারেননি বলে নিমতলী ট্র্যাজেডির সেই ভয়াবহ আগুনে পুড়ে মানুষ হত্যার হৃদয়বিদারক দৃশ্য ভুলে যেতে না যেতেই এবার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আবার আগুনে পুড়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণার বীভৎস চিত্র দেখতে হয়েছে। মুনাফালোভী ব্যবসায়ী, অসচেতন সেখানকার মানুষ ও দায়িত্বহীন কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা তাই আজ সমালোচনার তীরে ক্ষতবিক্ষত। হাই কোর্ট যথাযথই বলেছে, এ ঘটনার দায় কাউকে না কাউকে নিতেই হবে।

নিমতলীর ঘটনার পর গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ কিছুটা বাস্তবায়িত হলে চকবাজারের ঘটনা ঘটত না। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ হুমায়ূন ও প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছেন, সরকারি সংস্থাগুলো ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না। নিমতলীর ট্র্যাজেডিতে ১২৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। সে সময় টেকনোক্র্যাট কোটায় শিল্পমন্ত্রী ছিলেন সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া। নিমতলীর পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে কিছুদিন সময় চাওয়ায় সেসব গোডাউন সরানোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দিলীপ বড়ুয়া পুরো মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সেই কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর কাজ যেমন আর শুরু হয়নি, তেমনি বিকল্প ব্যবস্থাও করা হয়নি।

চকবাজার ট্র্যাজেডির পর ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, সদ্য সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু যদি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন, তাহলে হয় তো এত দিনে পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরানো সহজ হতো। ব্যর্থতার আঙ্গুল তিনি নিজের দিক থেকে সরিয়ে আমির হোসেন আমুর দিকে তুলেছেন। এর জবাবে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জে সরানোর বিষয়ে দিলীপ বড়ুয়া কিছু করেননি। এসব প্রশ্নের সম্মুখীন যাতে না হতে হয়, সেজন্য তিনি এসব বলে অগ্রিম এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি আরও বলেন, নিমতলীর অগ্নিকান্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সভাপতিত্বে এক সভায় কেমিক্যাল পল্লীর জায়গা নির্ধারণের জন্য বিসিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। তখন শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দিলীপ বড়ুয়া কী করেছেন? যেহেতু শিল্পমন্ত্রী হিসেবে তিনি অদক্ষ, নির্লিপ্ত ও অযোগ্য ছিলেন তাই অন্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকে বিসিকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে কমিটি করতে হয়েছিল। দিলীপ বড়ুয়া পুরান ঢাকার রাসায়নিক গুদাম কেরানীগঞ্জে সরানোর জন্য কিছু করেননি বলে আমির হোসেন আমু দাবি করে বলেন, আমি মন্ত্রী হওয়ার পর রাসায়নিক গুদাম সরানোর জন্য প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করি। গত বছরের অক্টোবরে ২০১ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে ৫০ একর জমিতে ৯৩৬টি প্লট নির্মাণের জন্য প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। কেমিক্যাল পল্লীর জন্য ৫০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণ জানতে চাইলে সাবেক এই শিল্পমন্ত্রী বলেন, কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা গুদাম সরাতে চান না। বার বার তাগাদা দেওয়ার পরও ব্যবসায়ীরা আমাদের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেননি। ব্যবসায়ীরা আগ্রহ না দেখানোর কারণে রাসায়নিক গুদাম সরানো যায়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় কেউ বাড়ির বারান্দায় কিংবা একটি ঘরে কেমিক্যাল রেখে ছোট আকারে ব্যবসা করেও মুনাফা করেন। প্লট কিনে ব্যবসা করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই। সেজন্য তারা জায়গাটি ছাড়তে চান না।

যে যাই বলুন না কেন, যে যাকে দোষারোপ করুন না কেন, অপ্রিয় সত্য হচ্ছে- ১০ বছরে দায়িত্বশীলরা পুরান ঢাকাকে এই মরণকূপ থেকে বের করে আনতে পারেননি। সরাতে পারেননি কেমিক্যাল গোডাউন। আর সরাতে পারেননি বলে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর মানুষের কলজে কাঁপানো চকবাজারের ভয়াবহ আগুনে পোড়া লাশের মিছিল দেখতে হয়েছে। এদিকে জাতীয় টাস্কফোর্স ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা ও গুদাম সরিয়ে না নিলে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে অভিযান পরিচালনা করবে। এ অভিযানে কোনো ভবনে কেমিক্যালের কারখানা বা গুদাম পাওয়া গেলে সব সেবা সংযোগ বন্ধ করার পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসলে মানুষ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা চায়। এভাবে একের পর এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় আগুনে পুড়ে কয়লা হতে চায় না। এই বীভৎস মৃত্যুর চিত্র দেশ দেখতে চায় না। সরকার ও দায়িত্বশীল মহল এবং স্থানীয় মানুষরা যেমন নির্বিকার থাকতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্র ঘুমিয়ে থাকতে পারে না।

চকবাজার ট্র্যাজেডির পর রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক দিবস পালনের আগের দিন বিকালে আচমকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ঢাকা থেকে দুবাইগামী বিমান ছিনতাই-চেষ্টার খবরে গোটা দেশ অস্থির, শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। পাইলটের দক্ষতায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে সেটি অবতরণ করে এবং ক্রুদের দক্ষতায় যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের একটি চৌকস দল বিমানবন্দরে অবস্থান নেয় এবং মাত্র ৮ মিনিটের কমান্ডো অভিযানে বিমান ছিনতাই ঘটনার সফল সমাপ্তি ঘটে। এতে বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী পলাশ আহমেদ প্রথমে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত ও পরে মৃত্যুবরণ করেন। প্রথমে তাঁর নাম নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলেও পরে আসল নাম, পরিচয় ও ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়। একই সঙ্গে আরও জানা যায়, চিত্রনায়িকা সিমলা ছিলেন তার দ্বিতীয় স্ত্রী। যিনি তাকে মানসিক প্রতিবন্ধিতার অভিযোগ তুলে চার মাস আগেই ডিভোর্স দিয়েছিলেন। একজন সিনেমা প্রযোজক হিসেবে মাহাদী নামে তাকে চিনলেও পরে বিয়ে করতে গিয়ে তার নাম জানেন পলাশ আহমেদ। পলাশের পরিবারও জানিয়েছে, বখে যাওয়া ছেলেটি আগে থেকেই বাড়ির অবাধ্য। এ দেশে কেউ মানসিক চিকিৎসকের শরণাপন্ন যেমন হতে চান না, তেমনি কাউন্সেলিং করাতে রাজি নন। মনোগত সমস্যা থেকে কত ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারে ব্যক্তিজীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনেÑ আমরা ভাবি না।

বিচ্ছেদের পরও চিত্রনায়িকা সিমলাকে পলাশ ফোন করতেন। সিমলা জানিয়েছেন, সেই ফোন তিনি রিসিভ করতেন না। সিমলা আরও বলেছেন, বিয়ে হলেও প্রচলিত ধারণার সংসার তাদের করা হয়ে ওঠেনি এবং পলাশ যখন টেলিফোনে কথা বলতেন, তখন তাকে যতটা পরিপক্ব মনে হতো সামনে এলে তার চেয়ে বেশি অপরিপক্ব মনে হতো। তবে তাদের রোমান্স-মুহূর্তের অনেক ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সিমলাকে ফিরে পাওয়ার জন্য পলাশ বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন নাকি অন্য কোনো কারণে এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি কি এ নিয়েই কথা বলতে চেয়েছেন? সেই প্রশ্ন ও রহস্যের সমাধি ঘটেছে কমান্ডো অভিযানে তার নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে সবার জন্য, দেশবাসীর জন্য স্বস্তির বিষয় এই যে, দুনিয়াজুড়ে বিমান ছিনতাই-চেষ্টার খবর এবং বিমানে অস্ত্রধারী ব্যক্তির আরোহণ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধই করেনি, অতিশয় দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করলেও কোনো যাত্রী বা কারও প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, সেটিই বড় প্রাপ্তি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার এই দুর্বলতা চিহ্নিত করে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব এখন সরকারের।

এদিকে এ ঘটনা ঘিরেও অতিকথন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও যাত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে রহস্যময় বিভ্রান্তি পুরো বিষয়টিকে ঘিরে তৈরি করেছে। নিহত ছিনতাইকারী পলাশের হাতের অস্ত্রটিকে পুলিশ খেলনা পিস্তল বললেও সংসদে দেওয়া বিবৃতিতে বিমান প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ মাহবুব আলী ও সংসদ সদস্য মঈনুদ্দীন খান বাদল তাকে অস্ত্রধারী বলেছেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ পতেঙ্গা মডেল থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে পলাশের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীর হাতে বোমা ও অস্ত্রসদৃশ বস্তু দেখা গেছে। সে দুটি ফটকাজাতীয় বস্তুর বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এজাহারে আরও বলা হয়, উড়োজাহাজে থাকা এক তরুণ বোমাসদৃশ বস্তু ও অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে তার কিছু দাবি-দাওয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে শোনানোর জন্য উড়োজাহাজের ক্রুদের বলেন। নইলে উড়োজাহাজটিকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ঘটনার সময় উপস্থিত মঈনুদ্দীন খান বাদল গণমাধ্যমকে বলেছেন, তিনি বিমানের পাইলটের সঙ্গে কথা বলেছেন। পাইলট যুবকটির হাতে পিস্তল দেখেছেন। এখন যদি পিস্তলই না থাকে, তাহলে তাকে মারল কেন? বিমান সচিব মহিবুল হক বিমানবন্দর পরিদর্শনে গিয়ে বলেছেন, সেটা অস্ত্র কিনা তারা ওয়াকিবহাল নন। তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর জানা যাবে সেটি অস্ত্র না খেলনা অস্ত্র। আর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসানের বক্তব্য ছিল, বিমান থেকে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ‘সো কলড হাইজ্যাকার’ বিমানে একাই ছিল। বাড়ি থেকে পলাশ দুবাই যাচ্ছেন বলে এলেও তার টিকিট থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যাত্রী ছিলেন। তার সিট নম্বর ছিল ১৭-এ। রবিবার রাতে চট্টগ্রামের ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের জানান, ‘ছিনতাইকারী যুবককে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন প্যারাকমান্ডোরা। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে আক্রমণাত্মক হওয়ার চেষ্টা করেন। উড়োজাহাজেই তার সঙ্গে গোলাগুলি হয়। এতে তিনি আহত হন। পরে জানতে পারি, তিনি মারা গেছেন।’ ঘটনার পর রবিবার রাতে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মাহবুবুল আলম বলেন, ওই যুবকের কাছে পাওয়া বস্তুটি খেলনা পিস্তল। তার কাছে কোনো বিস্ফোরকও ছিল না। রবিবারের ঘটনা সম্পর্কে জানাতে বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, বিমানবন্দরের যে তল্লাশি ব্যবস্থা তাতে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে যাওয়া সম্ভব নয়। বিমানবন্দরের তল্লাশি ব্যবস্থায় অস্ত্র নিয়ে গেলে তা দৃশ্যমান হয়। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে বিমানটি জরুরি অবতরণ করেনি। রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে যাত্রাবিরতি করেছে। সেটা ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং ছিল না। অথচ গোটা দেশ বিভিন্ন টেলিভিশনে দেখেছে বিমান ইমারজেন্সি ল্যান্ডিং করেছে ও যাত্রীরা বেরিয়ে আসছেন। বিমান প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছেন, সিসি ক্যামেরার রিপোর্টটি আমরা দেখেছি। আর দশজন যাত্রীকে যেভাবে তল্লাশি করা হয়, স্ক্যানিং হয়, সেভাবেই হয়েছে। তার ঘাড়ে ব্যাগ ছিল। সেটি স্ক্যানিং মেশিনের ভিতর দিয়ে গেলেও কিছু ধরা পড়েনি। পরে সন্ধ্যায় তিনি সংসদে বলেন, বিমানে যাত্রীবেশে এক অস্ত্রধারী আকস্মিক যাত্রীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিমান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি ও চিৎকার করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতির সামাল দেন।

সব ঘটনা এমনকি স্পর্শকাতর ঘটনা নিয়েও দায়িত্বশীল মহলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এমনকি অতিকথন দেশের মানুষকে বিভ্রান্তই করেনি, হতাশ ও প্রাণহীন করে দেয়; কখনো-সখনো ক্ষোভেরও সঞ্চয় হয়। দায়িত্বশীলদেরও মনে হয় দায়িত্বহীন। সেটি চকবাজার ট্র্যাজেডিই হোক আর শ্বাসরুদ্ধকর বিমান ছিনতাই-চেষ্টার ব্যর্থ প্রয়াস নিয়েই হোক।

এদিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের একচ্ছত্র বিজয় ও কার্যকর বিরোধী দল বিএনপির ছিটকে পড়া এবং সংসদে যোগদান না করার ঘোষণা। অন্যদিকে জাতীয় পার্টিকে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে ঢাকা উত্তরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন এবং দেশজুড়ে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ভোটের ময়দান কার্যত একতরফা প্রাণহীন নির্বাচনে পরিণত হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বনাম আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী। কোথাও কোথাওবা দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের প্রার্থী হয়ে ভোট ময়দানে নামলেও প্রচার-প্রচারণায় মানুষের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে না। শান্ত ও নীরব বোবা পরিবেশে যেন নির্বাচন হচ্ছে।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন হচ্ছে। সেখানে ছাত্রলীগ শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হলেও দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসছাড়া ছাত্রদল অংশগ্রহণ করায় এবং বামপন্থি ছাত্র সংগঠন থেকে কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলনকারী প্যানেল দেওয়ায় কিছুটা আগ্রহ ও কৌতূহল বাড়িয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, উৎসবমুখর, প্রতিযোগিতামূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ডাকসু নির্বাচন সব মহলের চাওয়া। এই ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দুয়ার খুলে রাজনীতিতে যদি কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার ঘটে। নতুন নেতৃত্ব তৈরি হওয়ার পথ খোলে সেটা হবে অনেক বড় পাওয়া। যদিও একসময় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রসমাজের অবস্থান সরকারবিরোধী শিবিরেই উত্তাল হতো। সেখানে প্রায় তিন দশক ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়া এবং ছাত্রসমাজের মধ্যেও সরকারি দল সমর্থক ছাত্র সংগঠনের প্রতি দীর্ঘদিনের তৈরি হওয়া আগ্রহ এবং বিরোধী দল সমর্থক ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে আসা অথবা প্রতিকূল পরিবেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পেরে হয় তো এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তবে ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সব ছাত্র সংগঠনের পারস্পরিক সহাবস্থান এবং সুস্থধারার রাজনীতির কর্মকা-ে দীর্ঘদিনের বন্ধ্যত্ব কাটিয়ে উঠতেও পারে। এ সুযোগ সব ছাত্র সংগঠনকেই সমানভাবে নিতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে দিতেও হবে।

দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। এটা মানুষ বিশ্বাস করে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচন ঘিরে গণশুনানির নামে কার্যত বিএনপি প্রার্থীদের নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে ঝাঁঝালো বক্তৃতার পাঠ সমাপ্ত হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে সেটিও যেন মানুষই নয়, তাঁর দলের নেতা-কর্মীরাও ভুলতে বসেছেন। দল পুনর্গঠন নিয়ে বিএনপি আলোচনামুখর। তাদের শরিক জামায়াতের অভ্যন্তরেও পদত্যাগ, দল বিলুপ্ত করে নতুন দল গঠনের জোর আলোচনা। তবু রাজনীতি যেন আজ স্রোতহারা। একসময় দেশের নদীগুলো পানিতে ভরা যৌবনা ছিল। একটা সময় রাজনীতিও নেতা-কর্মী, আন্দোলন-সংগ্রাম ও সাংগঠনিক তৎপরতায় ভরা যৌবনা ছিল। আজ নদীগুলো বন্ধ্যাই হয়নি, একেকটি শুকিয়ে মাঠ হয়ে যাচ্ছে। যৌবন হারিয়ে বার্ধক্যে পীড়িত হচ্ছে। দেশের রাজনীতিও আজ প্রায় বন্ধ্যা নদীর মতো প্রাণহীন। গোটা দেশ যেন হঠাৎ ১০ বছরে আওয়ামী লীগ হয়ে গেছে। বিএনপিসহ অন্য দল যেন রিক্ত-নিঃস্ব। এই প্রাণহীন, কোলাহলহীন, আনন্দহীন স্তব্ধ পরিবেশ রাজনীতির জন্য কতটা কল্যাণ ও মঙ্গলময় গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার মানুষই নয়, সরকারি দল ও বিরোধী দল সবাইকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার বিষয়।

            লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর