শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

‘ফসলি’ জানাচ্ছে নতুন বার্তা

শাইখ সিরাজ

‘ফসলি’ জানাচ্ছে নতুন বার্তা

প্রকৃতির সঙ্গে কৃষকেরই সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি। পরম্পরায় বহু বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করে প্রকৃতির মেজাজ। আর সে অনুযায়ী আয়োজন করে চাষবাসের। ভুল যে হয় না, তা নয়। কখনো কখনো প্রকৃতির বৈরিতায় হারাতে হয় সর্বস্ব। কৃষককেই জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তার পরও সৃষ্টির উন্মাদনায়, বাঁচার তাগিদে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে, মাঠের বুক চিরে ফসল ফলায় কৃষক। একসময় বলা হতো Knowledge is Power- অর্থাৎ জ্ঞানই শক্তি। আর এখন বলা হয় Information is Power- মানে তথ্যই আপনাকে সমৃদ্ধ করবে। কৃষির ক্ষেত্রেও তাই। উন্নত বিশ্বের কৃষির দিকে তাকালে দেখতে পাই ভিন্নরকম এক চিত্র। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে কৃষির ধরন, সমৃদ্ধ হয়েছে কৃষির ক্ষেত্র। প্রযুক্তি ও নতুন নতুন কৌশল কৃষিকে যেমন করেছে সহজ, তেমন ফলন বাড়িয়েছে বহুগুণে। আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংস) ও এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রযুক্তি পাল্টে দিচ্ছে সারা বিশ্বের কৃষিকে। এর সুবাতাস লেগেছে বাংলাদেশের কৃষিতেও। অ্যাপভিত্তিক কৃষিচর্চার বিষয়টি এর আগেও ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’-এর বহু প্রতিবেদনে তুলে ধরেছি। উন্নত বিশ্বে বহু আগে থেকেই অ্যাপভিত্তিক স্মার্টকৃষির মাধ্যমে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত কৃষক ডিজিটাল প্ল্যাটফরমের সুবিধা পাচ্ছে। আমাদের দেশেও অ্যাপভিত্তিক কৃষিসেবার সুবিধাদি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকার বেশকিছু অ্যাপ তৈরি করেছে। তবে তার বেশির ভাগই শুধু তথ্যসেবা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মাঠপর্যায়ের কৃষকের সেই অ্যাপগুলো সম্পর্কে তেমন জানা-বোঝাও নেই। তবে অ্যাপভিত্তিক স্মার্টকৃষি যাকে বলে তার যাত্রাও হয়েছে আমাদের দেশে। সবশেষে ডিজিকাউ নামে গরুর খামারিদের জন্য একটা অ্যাপ নিয়ে প্রতিবেদনের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে। 

২০১৭ সালের আগস্টের কোনো একদিন এসিআই অ্যাগ্রিবিজনেসের ব্যবস্থাপন পরিচালক এফ এইচ আনসারি সাহেব তার দফতরে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তাদের স্মার্টকৃষির অ্যাপ নিয়ে কাজের বিষয়টি দেখানোর জন্য। অত্যাধুনিক উপগ্রহ চিত্র, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও আবহাওয়াবিষয়ক তথ্যাদির সমন্বয় এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে এ অ্যাপটি কৃষককে সার্বিকভাবে তথ্য দিয়ে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। ২০১৫ সালের নভেম্বর থেকে শুরু করে তিন বছরে তৈরি করেছেন ডিজিটাল এ প্ল্যাটফরম।

গত ডিসেম্বরে আনসারি সাহেব জানালেন, অ্যাপটি তারা গুগুল প্লে স্টোরে অবমুক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অ্যাপটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তাও শেখানো হচ্ছে। অ্যাপ সম্পর্কিত বিষয়াশয় জানতে পুনরায় তার দফতরে হাজির হই। সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে দেশের কৃষক, কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী ও কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী তথ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এ নতুন অ্যাপটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফসলি’। অ্যাপটি কীভাবে কাজ করবে তা আমাদের বিস্তারিত দেখালেন ফসলি প্ল্যাটফরমের টিম লিডার শামীম মুরাদ। তিনি জানালেন, দেশের কৃষক ও কৃষি খাতের সঙ্গে জড়িত সবার কাছে তথ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার এই অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যবহার করা যাবে। আমার প্রশ্ন ছিল, যে কৃষকের স্মার্টফোন নেই তিনি কি এই সেবার বাইরে থাকবেন? আনসারি সাহেব জানালেন, ‘ফসলি’ শুধু অ্যাপ নয়, এটি একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফরম। যাদের স্মার্টফোন নেই, তারা যে কোনো মোবাইল ফোনে এসএমএস ও ফোনকলের মাধ্যমে ফসলির কিছু সেবা পাবেন। ক্রাউড সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নানা তথ্য ও প্রযুক্তি কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য।

দেশের ১২ জেলায় ‘ফসলি’ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কৃষককে। প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি সত্যি প্রশংসনীয়। প্রতি বছরই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এ কৃষককে তথ্যসেবা বিষয়ে প্রশ্ন করি। ২০১৮ সালের কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেটের পরিসংখ্যানে পেয়েছি শতকরা পাঁচজন কৃষক ডিজিটাল সেন্টারে কৃষি তথ্যসেবা নিতে যান। অ্যাপভিত্তিক সেবা সম্পর্কে অবহিত আছেন শতকরা দুজন কৃষক। হতাশার বিষয় হচ্ছে, শতকরা একজন কৃষকও অ্যাপ ব্যবহার করে তথ্যসেবা নেন না। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের বিষয়টি খুব কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি কৃষকও সচেতন হয়ে উঠবেন। ‘ফসলি’র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম দেখার জন্য যশোরের কৃষকের কাছেও গিয়েছিলাম। এমনিতে ওই অঞ্চলের কৃষক বেশ সচেতন, প্রশিক্ষণে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছেন। উঠান বৈঠকে কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তারা রীতিমতো আমাকে ‘ফসলি’ অ্যাপ কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দিলেন। দেখেও ভালো লেগেছে। তথ্যই কৃষককে ক্ষমতায়িত করবে বলে আমার বিশ্বাস।

মাঠের কৃষকের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা বেশ উচ্ছ্বসিত। কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কী কী উপকার পাচ্ছেন এ অ্যাপ ব্যবহার করে। তারা জানালেন, এখন অ্যাপের সাহায্যেই জানতে পারছেন কোন মাটিতে কী ফসল ভালো হবে, কোন ফসল কীভাবে চাষ করতে হবে। ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে কৃষকের বড় সংকট হচ্ছে রোগবালাই। কৃষক সবসময় খোঁজেন একজন ফসলের ডাক্তার। যিনি কিনা তার সংকট মুহূর্তে দেবেন প্রয়োজনীয় পরামর্শ। এ অ্যাপটি সেই সংকটও দূর করছে বলে জানালেন কৃষক।

কৃষি মানেই রোদ-বৃষ্টির সম্পর্ক। কখন বৃষ্টি হবে, আবহাওয়ার কী খবরাখবর তা আগে থেকেই জানা থাকলে কৃষকের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়ে যায়। এ অ্যাপটি কৃষককে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিয়ে সহায়তা করছে- বললেন তরুণ কৃষক ইলিয়াস। জানালেন, এ অ্যাপ ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমেছে। বৃষ্টি হবে আগে থেকে জানতে পারলে সেচের পরিমাণ কম দিয়ে যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়, তেমন ফসলের ক্ষতিও কমানো যায়।

আরেক কৃষক বাবুর সঙ্গে কথা হলো। তিনি জানালেন, এই অ্যাপের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে ফসল লাগানোর পর থেকে কাটার আগ পর্যন্ত কী করতে হবে তার একটা দৈনিক পরামর্শ তিনি পাচ্ছেন। এ সুবিধাটি অ্যাপে আছে ‘আমার ফসল’ নামে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ব্রি-২৮ ধান যদি ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে বপন করা হয় তবে সেদিন থেকে ফসল কাটার আগ পর্যন্ত প্রতিদিনের কী করণীয় তা ছোট তথ্য আকারে পেতে থাকবেন। কোন দিন সেচ দিতে হবে, কখন কী সার দিতে হবে সব তথ্যই কৃষক পাবেন।

শুধু কৃষকই নন, কৃষি বিভাগের কর্মীরাও এ অ্যাপের সহযোগিতা নিচ্ছেন। কথা হয় স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, তার কর্ম এলাকায় প্রায় ১ হাজার ২০০ কৃষক। সবার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখাটা কঠিন হয়ে যায়। এ অ্যাপের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখাটা সহজ। তবে এ ধরনের বিষয়গুলোয় কৃষককে আরও সচেতন করতে হবে।

কৃষকের চিন্তা কৃষি ঘিরেই। তার উৎপাদিত ফলফসল নিয়ে গভীর ভাবনা থেকেই মনে জেগে ওঠে নানান প্রশ্ন। তিনি সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন। কৃষকের অনেকেই বললেন তারা উন্মুক্ত অনলাইন বাজার চান। যেখানে তার উৎপাদিত ফলফসল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে একটা নির্দিষ্ট দামে বিক্রি করতে পারবেন। পাঠক, চীনের কৃষিবাজারের উন্নয়নের বিস্ফোরণের অন্যতম উপাদান হচ্ছে উন্মুক্ত অনলাইন প্ল্যাটফরম। তারা অনলাইনেই বিক্রি করতে পারছেন উৎপাদিত ফলফসল। এতে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য থেকে কৃষক যেমন রক্ষা পাচ্ছেন, তেমন পাচ্ছেন ফসলের ভালো দাম। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, বাংলাদেশের দুটি জেলায় ইতিমধ্যে দুটি কৃষকবাজার চালু হয়েছে। যার নাম ভিএসএম। নেদারল্যান্ডসের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিডার সহায়তায় যশোর ও খুলনায় এ বাজার দুটি চালু হয়েছে। সেখানে কৃষক সরাসরি তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য বিক্রি করছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাচ্ছে সবকিছু, পাল্টাচ্ছে কৃষি। কৃষি আধুনিক থেকে আধুনিকতম হয়ে উঠছে প্রযুক্তির বিকাশে। উন্নয়নের স্রোতে যুক্ত হতে নতুন সব প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশের কৃষককে। আধুনিক কৃষকই নির্মাণ করবেন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্যের ভান্ডার। এর জন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলেকে এগিয়ে আসতে হবে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ দেশের কৃষককে দক্ষ করে তোলার ক্ষেত্রে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে টেকসই উন্নয়নের পথে।                                             

► মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

[email protected]

 

 

সর্বশেষ খবর