সোমবার, ৪ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্ষুধামুক্তির সংগ্রামে জয়

অপূর্ব আজাদ

পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। ১৭ কোটি মানুষের এই জাতির লক্ষ্য এখন মধ্য আয় এবং সেখান থেকে উন্নত বিশ্বের সোপানে ওঠা। বাংলাদেশকে একসময় বলা হতো ক্ষুধার দেশ, দুর্ভিক্ষের দেশ। সেই শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় যখন ৮ মণ চাল পাওয়া যেত তখনো এ দেশে দুর্ভিক্ষ ও মঙ্গায় মানুষ প্রাণ হারাত। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলেও এ দুর্ভাগ্য ছিল নিত্যসঙ্গী। এমনকি স্বাধীনতার পর প্রথম তিন যুগ কেটেছে একই দুর্ভাগ্যের মধ্য দিয়ে। খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ওপর দেশের খাদ্য নিরাপত্তাই শুধু নির্ভরশীল নয়, এর সঙ্গে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিষয়ও জড়িত। এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ জাপানে চাল উৎপাদনে যে খরচ হয় তার মাত্র ১০ শতাংশ মূল্যেই বিদেশ থেকে তা আমদানি করা সম্ভব। কিন্তু জাপানিরা নিজেদের প্রধান খাদ্যের ক্ষেত্রে কখনো অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী হতে চায় না। জাপান সম্রাটের প্রধান দায়িত্বই হলো ধান উৎপাদনের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করা।

স্বাধীনতার পর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্রে ১৯৭৪ সালে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কিউবার কাছে বাংলাদেশের পাট বিক্রি করায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা গম বাংলাদেশে জাহাজে করে পাঠানোর সময় জাহাজ সে দেশে ফেরত নেওয়া হয়। খাদ্য ঘাটতির সেই দুঃসময়ে গম বাংলাদেশে না পৌঁছায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এই তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে বঙ্গবন্ধু সরকার খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। ’৭৪-এর খাদ্যাভাবের পরের বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। তবে বঙ্গবন্ধু তার নেওয়া পদক্ষেপের সুফল চোখে দেখে যেতে পারেননি। ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে তিনি নিহত হন। ’৭৫-এর পর ’৯৬ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় এসেছেন তারা খাদ্য উৎপাদনের বদলে বিদেশি শক্তির কাছে হাত পাতাকে লাভজনক মনে করেন। ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলার সংগ্রাম শুরু হয়। রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য উৎপাদিত হয় শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম পাঁচ বছরে। তারপর ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদনে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় দুর্ভাগ্যজনকভাবে। ২০০৯ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পয়মন্ত হাত দেশকে খাদ্যের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার মিশনে সক্রিয় হয়। তারই প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী গত বছর দেশে ৩ কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। এ সময় দেশে গম উৎপাদিত হয়েছে ১১ লাখ ৫৩ হাজার টন, ভুট্টা ৩৮ লাখ ৯৩ হাজার টন, আলু ১ কোটি ৩ লাখ ১৭ হাজার টন, ডাল ১০ লাখ ৩১ হাজার টন, তেলবীজ ৯ লাখ ৭০ হাজার টন ও শাক-সবজি ১ কোটি ৫৯ লাখ ৫৪ হাজার টন। ফসলের উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিকতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্যের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ কোটি ৭ লাখ ১৪ হাজার টন। উৎপাদিত হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ ২৫ হাজার টন। আর এতে দানাদার খাদ্যেও দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০০৬ সালে দেশে দানাদার খাদ্যের উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৬১ লাখ ৩৩ হাজার টন। খাদ্য উৎপাদন সন্তোষজনক হারে বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশের জন্য এক সুখবর। খাদ্য নিরাপত্তা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশে কোনো কারণে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বৃদ্ধিতেও তা মদদ জোগায়। খাদ্য আমদানিতে ব্যয় হয় বাজেটের এক বড় অংশ; যা কোনোভাবেই কাম্য হওয়া উচিত নয়।

বর্তমানে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ স্থানে। লবণাক্ততা, খরা, জলমগ্ন-সহনশীলতা ও জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানসহ ১০৮টি উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে বাংলাদেশে। ২০২১ সালের মধ্যে ধান উৎপাদনে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ধান উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিক সাফল্যের কারিগর এ দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সাধারণ কৃষক। আর কৃষকের নেপথ্যে রয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) আবিষ্কৃত অধিক ফলনশীল নতুন জাতের ধান। উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করে কৃষকের মুখে ফুটেছে হাসি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আবাসিক প্রয়োজন, রাস্তাঘাট, স্থাপনা নির্মাণ ইত্যাদি কারণে চাষাবাদের জমি কমলেও ধান উৎপাদনে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। প্রতি বছর ১২০ টনের বেশি উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্রি থেকে কৃষকের মাঝে সরবরাহ করা হয়। আশা করা হচ্ছে, দেশে ২০২১ সালের মধ্যে ৩৭ মিলিয়ন টন চাল উৎপাদন করা যাবে, এর ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে চাল রপ্তানি করা সম্ভব হবে। ব্রি গবেষকরা অক্লান্ত পরিশ্রমে ৯৪ ধরনের ধানবীজ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ৬টি হাইব্রিড জাত। প্রতি বছর ১২০ টনের বেশি বীজ ব্রি থেকে ১ হাজার লাইসেন্সধারী ডিলারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ডিলাররা যদি সঠিকভাবে প্রান্তিক পর্যায়ে প্রকৃত কৃষকের মধ্যে তা সরবরাহ করেন এবং দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি না হয় তাহলে ২০২১ সালের মধ্যে চাহিদার তুলনায় শতকরা ১০ ভাগ চাল বেশি উৎপাদন হবে।

            লেখক : প্রকৌশলী।

সর্বশেষ খবর