বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

কালজয়ী সেই ভাষণ

হারুন হাবীব

কালজয়ী সেই ভাষণ

বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে, সেই আদিকাল থেকে, সম্রাট-রাজা, ধর্মবেত্তা, রাষ্ট্র ও সমরনায়কদের প্রভূত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় ভাষণের কথা আমাদের জানা আছে, যা যুগে যুগে সেই জনপদের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে, সামনে এগোবার পথ দেখিয়েছে। সেই সব কালজয়ী ভাষণ সভ্যতা বিনির্মাণে সহায়ক হয়েছে, মানুষকে অগ্রসরতার দিকে ধাবিত করেছে। এমন কিছু ভাষণও আছে যা কোনো কোনো জনপদ, ভূখণ্ডের বন্দিত্ব এবং পরাধীনতা ঘুচিয়েছে, মানুষের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, স্বাধীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ করেছে। এর কারণ এই যে, ঐতিহাসিক সেসব সম্মোহনী ভাষণের শক্তি মানুষকে আত্মমর্যাদা পুনরুদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়তে, বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে শক্তিমান করে তুলেছিল। অবশ্য কিছু কিছু ভাষণ আবার বিস্তর প্রলয়েরও কারণ হয়েছে, যা সংঘাত ও রক্তপাত ঘটিয়েছে। ১০৯৫ সালে পোপ উরবান ২ এর ক্লারমাউন্টে দেওয়া বহুলালোচিত ভাষণের কথা আমরা জানি- ‘all who die... Shall have immediate remission of sins’ এবং এটিও জানি যে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ ক্রুসেডে নেমে পড়েছিল, যা প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলেছে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’ ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন। বর্তমান পাঞ্জাবের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রাজা পুরুকে এক বিপদসংকুল যুদ্ধে পরাজিত করার পর আলেকজান্ডার আর পুবের দিকে অগ্রসর হননি, কিংবা হতে পারেননি- বড় ধরনের প্রতিরোধ চিন্তা করে পিছিয়ে গেছেন। সেই সংকটে তার বাহিনীর মনোবল বৃদ্ধিতে আলেকজান্ডার যে ভাষণটি রেখেছিলেন- সেটি স্মরণীয় হয়ে আছে ইতিহাসে। ৩৯৯ সালে এথেন্সে দেওয়া সক্রেটিসের ‘Apology’ ভাষণটিও ইতিহাসখ্যাত।

দাশপ্রথা বিলোপ এবং আমেরিকার সমাজে শান্তি পুনরুদ্ধারে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে ১৮৬৩ এবং ১৮৮৫ সালে আব্রাহাম লিংকনের দুটি ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে অমর স্থান অধিকার করে আছে। বিশেষ করে ১৯ নভেম্বর ১৮৬৩ সালে পেনসিলভেনিয়াতে তার The Gettysburg Address অনন্যসাধারণ। নিউইয়র্কের বাফেলোতে ১৮৮৩ সালের ২৬ জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিয়ডর রুজভেল্টের “Duties of American Citizenship” ভাষণটি ইতিহাসখ্যাত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সময়ে লন্ডনের হাউস অব কমন্সে ১৯৪০ সালের ৪ জুন উইন্সস্টন চার্চিলের We Shall Fight on the Beaches ভাষণটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৪২ সালে মহাত্মা গান্ধীর Quit India ভাষণ ভারতের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছে। ১৯৬১ সালে জন এফ কেনেডির ভাষণের ঐতিহাসিক তাৎপর্যের কথা সবার জানা। ১৯৬৩ সালে মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই অমর ভাষণ- I have a dream -এর কথা জানি আমরা। ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জেনারেল অগাস্টো পিনোসেটের সামরিক বাহিনী যখন সমাজতন্ত্রী সালভেদর আলেন্দেকে ঘিরে ফেলে এবং প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের ওপর ক্রমাগত গোলাবর্ষণ করতে থাকে, ঠিক সে সময়েই আলেন্দে রেডিওতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি দেন, সেটি অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে চিলির গণমানুষের জন্য।

তবে বলাই বাহুল্য, সব ঐতিহাসিক ভাষণ সমান গুরুত্ব বহন করে না, করেওনি। দেশ-কাল ভেদে তাদের গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া বিবেচিত হয়। সেদিনকার পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাংলা ও বাঙালি জীবনের একটি অমর মহাকাব্য- যার রচয়িতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাই নয়, এ ভাষণ একই সঙ্গে পাকিস্তানের নব্য ঔপনিবেশবাদীদের হাতে তৈরি বাঙালি নিপীড়নের নির্মোহ ইতিহাস। বিশ্বসংস্থা ইউনেস্কো ঐতিহাসিক ভাষণটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে স্থান দিয়েছে। এই স্বীকৃতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের বিশ্ব স্বীকৃতি।

জাতির পিতার সেই ভাষণ বিশ্ব ঐতিহ্য দলিলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম আরেক দফা বিশ্ব স্বীকৃত হয়েছে। এই স্বীকৃতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক ও সামরিক সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে, ১৯৭১ সালে যে রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, কেবল তারই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নয়; এই স্বীকৃতি পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নিপীড়ন-উৎপীড়ন থেকে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে বাঙালি জাতি যে সংগ্রাম পরিচালিত করেছিল, তারও। অন্যদিকে এই স্বীকৃতি সেই বাঙালি মহাপুরুষের- যিনি জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন মাটি ও মানুষের জন্য। আমরা বিশ্ব সংস্থা ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য। আরও এ কারণে যে, সংস্থাটি বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইতিমধ্যে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন। ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণটি কেন অমর মহাকাব্য, কেন তা বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, সংক্ষিপ্তাকারে সে আলোচনায় যেতে পারি আমরা।

প্রথমত, ভাষণটি খুবই সংক্ষিপ্ত, মাত্র ১৯ মিনিটের এবং ১,১০৭ শব্দের। প্রায় সব অর্থেই এই ভাষণ একটি ক্লাসিক সাহিত্যের মর্যাদাসম্পন্ন। এর শব্দচয়ন, আবেগ, ইতিহাসনির্ভরতা এবং অন্তর-বাইরের সংযত ভাষা ও তার বিন্যাস একদিকে যেমন পাকিস্তানের ২৩ বছরের অগণতান্ত্রিকতা ও বাঙালি নিপীড়নের নির্মোহ ইতিহাস গ্রন্থনা, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও মানবিক সভ্যতার প্রতি এর রচয়িতার অবিচল আস্থা ও দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ।  মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু যখন রমনা রেসকোর্সে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণটি রাখছিলেন তখন মাত্র কয়েক মাইল দূরে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান বাহিনী কামান তাক করে বসেছিল, নির্দেশ পাওয়া মাত্র জনসভাতে আক্রমণ পরিচালনার উদ্দেশে। অন্যদিকে জনসভার ওপর দিয়ে টহল দিচ্ছিল পাকিস্তানি বিমান । দ্বিতীয়ত, এই ভাষণ চরম উত্তেজক পরিস্থিতিতেও শান্তি ও নিয়মতান্ত্রিকতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর অবিচল আস্থার বহিঃপ্রকাশ; অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক, যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছে। আমরা যারা ঐতিহাসিক রেসকোর্সে উপস্থিত থেকে সেদিনের ভাষণটি শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছি, তারা সবাই জানি, একটি ভাষণে বঙ্গবন্ধু কীভাবে গোটা জাতিকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিবাহিনীতে পরিণত করেছিলেন।

তৃতীয়ত, এই ভাষণটি হয়ে উঠেছিল ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের মূল চালিকাশক্তি, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের মূল প্রেরণাশক্তি এবং একই সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বিক্রম ও ত্যাগের মূল উৎসভূমি।

চতুর্থত, আমরা স্পষ্টই দেখতে পাই যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কেবল সময়ের চাহিদা পূরণ করেছে তাই নয়, একই সঙ্গে তা ভবিষ্যতের চাহিদাকেও পূরণ করে চলেছে। আজও যখন বাঙালিকে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, আজও যখন জাতিকে স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ আমাদের পথ-নির্দেশ করে, বলীয়ান করে আজও । লেখাটির সমাপ্তি টানার আগে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করি। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন চার দশকেরও বেশি সময় আগে। আমরা সবাই জানি অনেক প্রতিরোধ-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে পরিচালিত রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। স্বাভাবিক কারণেই প্রত্যাশা যে, নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ গভীরভাবে প্রথিত হবে। আর এ কাজটি কেবল স্রোগান দিয়েই হওয়ার নয়। এর জন্য প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে আত্মায় ধারণ করা, আদর্শের প্রকৃত সৈনিক হওয়া।

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু, তার কর্মময় জীবন, জয়বাংলা এবং ৭ মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সময়ের আঙ্গিকে ধারণ ও লালন করতে হবে; জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিকে টেকসই করতে এই চর্চা খুব বেশি জরুরি। কারণ এগুলো সবই জীবন্ত, ইতিহাসের পুরনো সম্পদ নয় কেবল।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর