শুক্রবার, ৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোগীর সেবা আমার ব্রত ছিল, আছে থাকবে

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

রোগীর সেবা আমার ব্রত ছিল, আছে থাকবে

সম্প্রতি আমি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। প্রত্যেক চাকরিজীবীকে অবসরে যেতে হবে। আমার বয়স হয়েছে। একটা সময় তো অবসরে যেতেই হবে। এমনকি দুনিয়া ছেড়েও চলে যেতে হবে। আমি আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। আমার কোনো কষ্টই হয়নি। আমি সন্তুষ্টি নিয়েই চলে যাচ্ছি। কারণ মনে হয়, আমি আমার প্রতিটি পদক্ষেপেই সফল। আমার অপ্রাপ্তি বলতে কিছু নেই। আমি চিকিৎসক ও শিক্ষক হিসেবে সফল। এ ছাড়া আমি মেডিসিন বিষয়ে ৬টি বই লিখেছি, যা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বের অনেক দেশের ছাত্রছাত্রী ও চিকিৎসকের কাছে সমাদৃত এবং গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। আবার যেহেতু আমি মেডিসিনের প্রফেসর হিসেবে জেনারেল প্র্যাকটিস করি, রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাই রোগীদের সঙ্গে আমার তো তেমন কোনো দূরত্ব তৈরি হচ্ছে না।  তাদের সেবা আমার ব্রত ছিল, আছে এবং থাকবে। আমি অবসরে যাচ্ছি বটে, তবে আমার কাজ তো আর থেমে থাকবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আমার প্রিয় প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে আমি চলে গেলেও কাজের কোনো ঘাটতি হবে না। আমি আরও এক বছর পিআরএলে আছি। এখানকার কাজের সুযোগ যেমন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান, পরীক্ষা নেওয়া ইত্যাদি আমি চালিয়ে যেতে পারব। অন্য প্রফেশনের মানুষ পুরোপুরি অবসরে যেতে পারেন, কিন্তু ডাক্তাররা তা পারেন না। ডাক্তারদের কোনো অবসর নেই। আমি কাজের মধ্যেই ছিলাম, আছি ও থাকব। আমার রোগী দেখা অব্যাহত রাখব, লেখালেখি চালিয়ে যাব। মেডিসিন রিলেটেড আরেকটি বই লেখা শুরু করেছি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখালেখি আগের মতোই চালিয়ে যাব। নতুন কোনো চাকরিতে যোগদান করার ইচ্ছা আমার আপাতত নেই। বরং মাঝে মাঝে নিজ গ্রামে গিয়ে মানুষের সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাব। সবকিছু মিলিয়ে আমি ভালোভাবেই উপভোগ্য সময় কাটাতে চাই।

আমার শিক্ষার্থীরা দেশের প্রায় প্রতিটি মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে সফলতার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব পালন করছে। অনেকেই বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হিসেবে আছে। যারা শুধু প্র্যাকটিসের মধ্যে আছে তারাও সম্মানের সঙ্গে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এটা আমার অনেক বড় অর্জন। নিজ হাতে ভালো কিছু শিক্ষক ও ডাক্তার তৈরি করা আমার লক্ষ্য ছিল। আমি পুরোপুরি এটা করতে না পারলেও অনেকাংশেই সফল। প্রায়ই একটা কথা বলি, আমি আমার যোগ্যতার চেয়েও বেশি পেয়েছি। আমি চাই, আমার শিক্ষার্থীসহ সব চিকিৎসক ভালো কাজ করুক। তারাও বিভিন্নভাবে সম্মানিত ও পুরস্কারে ভূষিত হোক। আরেকটা পরামর্শ হলো, চিকিৎসকদের শুধু ভালো চিকিৎসক নয়, ভালো মানুষও হতে হবে। শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না। বর্তমানে বাংলাদেশে ডাক্তারদের অবস্থা খুব ভালো নয়। মানুষ এখন ডাক্তারদের ব্যাপারে নেতিবাচক চিন্তা করছে। এই নেতিবাচক চিন্তা থেকে ইতিবাচক অবস্থায় নিয়ে আসার দায়িত্ব ভবিষ্যৎ ডাক্তারদের ওপরই বর্তায়। তরুণ ডাক্তারদের এ দায়িত্ব নিতে হবে, সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, রোগীদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে। এটা আমার, আপনার, আমাদের সবার পরিবার ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক।  সবার কাছে এটাই আমার আকুল আবেদন। যদি আগামী প্রজন্মের চিকিৎসকদের মধ্য থেকে কেউ কেউ এই কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যান, নতুন জ্ঞান আর নতুন অভিজ্ঞতাকে এভাবেই ছড়িয়ে দেওয়ার মানসে প্রয়াস চালান, তবে সেটাই হবে আমার এত দিনের সাধনার চূড়ান্ত সাফল্য। মেডিকেল প্রফেশনটা অন্য প্রফেশনের চেয়ে একটু আলাদা। যারা আসতে চান তাদের আমি স্বাগত জানাচ্ছি। তবে আপনাকে অনেক কষ্ট করার মানসিকতা রাখতে হবে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। ভালো মানুষ ও ভালো ডাক্তার উভয়ের গুণাবলি অর্জন করতে হবে। যেমন রোগীর সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলা, রোগীর কথাগুলো ঠিকমতো শোনা, ভালো আচরণ করা, ওষুধ ভেবেচিন্তে দেওয়া, পরীক্ষা-নিরীক্ষা অপ্রয়োজনে না দেওয়া। ভবিষ্যতে যারা এ পেশায় আসতে চান, তাদের চিন্তা-চেতনায় এ বিষয়গুলো থাকতে হবে। তাহলে আপনারা অবশ্যই সফল হবেন, ইনশা আল্লাহ।

তরুণরা অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে মেডিকেলের আঙিনায় পা রাখেন। যারা সবে শুরু করছেন, তারা মনে রাখবেন, এখানে সচেতনতা ও সততার কোনো বিকল্প নেই। আপনাকে প্রথম থেকেই ভালোভাবে পড়াশোনা এবং কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনাকে রোগী দেখতে হবে। আমি যখন মেডিকেল জীবনে প্রথম ওয়ার্ডে ঢুকি তখন এক শিক্ষক-ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীদের দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এরা কারা চেন?’ আমরা উত্তরে বললাম ‘রোগী’। তিনি বললেন, এরা শুধু রোগী নয়, এরাই তোমার প্র্যাকটিকাল লার্নিং মেটেরিয়াল বা হাতে-কলমে শিক্ষার উপকরণ। তাদের দ্বারাই তোমাদের শিক্ষা অর্জন করতে হবে। সুতরাং তাদের সঙ্গে কখনো খারাপ আচরণ করো না। তারা যেন তোমার কাছ থেকে কোনো কষ্ট না পায়। তুমি যত বড় ডাক্তার হও না কেন, তাদের মাধ্যমেই তোমাকে হাতে-কলমে শিখতে হবে।

যারা নবীন তারা মনে রাখবেন, শুধু বই পড়ে ডাক্তার হওয়া যাবে না। যে কেউ বাজার থেকে বই কিনে পড়তে পারে, কিন্তু আপনাকে রোগীদের মাধ্যমেই প্রথিতযশা ডাক্তার হতে হবে। কেউ যদি মনে করে, বই পড়ব আর ভালো ডাক্তার হব, সে কোনো দিনই ভালো ডাক্তার হতে পারবে না। মনে রাখতে হবে, আমি ডাক্তারি পেশায় ঢুকছি, এটাই আমার একমাত্র পেশা, অন্য কোনো পেশায় জড়িয়ে পড়া যাবে না। বিশেষ করে অনেকেই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। এটা কখনো করবেন না। মেডিকেল সায়েন্সে এটা একটা বড় বাধা।  সবার ব্যক্তিস্বাধীনতা আছে এটা ঠিক, কিন্তু তার মানে এই নয়, আপনি অন্য কাজে সময় ব্যয় করে আপনার প্রফেশনের ক্ষতি করবেন, এটা যেন কেউ না করেন। আগে আপনাকে দক্ষ ডাক্তার হিসেবে তৈরি হতে হবে, তাহলে আপনি নিজে গর্বিত হবেন, আপনার বাবা-মা গর্বিত হবেন, দেশ তথা জনগণ উপকৃত হবে।

বর্তমানে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে একটা দূরত্ব ও আস্থাহীনতার ভাব সৃষ্টি হয়েছে। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। উভয়ের মধ্যে সম্পর্কটা বন্ধুভাবাপন্ন ও সহযোগিতামূলক হওয়া উচিত। আমি একটা কথা সবসময় বলি, কোনো এক জায়গায় যদি একজন ডাক্তার থাকেন, তাহলে রোগী তার কাছেই আসবে। যদি দুজন ডাক্তার হয়, তখন রোগী তুলনা করবে তাদের মধ্যে কে ভালো। তিনজন হলে আরও তুলনা করবে। ডিগ্রি ও কোয়ালিটি এক হলেও কিন্তু রোগী সবার কাছে যায় না। আপনারা লক্ষ্য করে দেখবেন, কেউ কেউ রোগী পায় না আবার কারও কারও কাছে লম্বা লাইন, রোগীরা সিরিয়াল পাচ্ছে না। এর কারণ হলো, আস্থা ও বিশ্বাস। মানুষ আল্লাহর পরে ডাক্তারকে বিশ্বাস করে। অনেক রোগীই বলেন, অমুক ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই অর্ধেক রোগী ভালো হয়ে যায়। এই কথাগুলো ডাক্তারদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

আমি নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমি কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি, তা মানুষই বিবেচনা করবে। আমার যোগ্যতা ততটুকু আছে কিনা আমি জানি না। তবে যতটুকু অর্জন করতে পেরেছি তা আল্লাহর রহমত, আমার বাবা-মায়ের দোয়া, সহকর্মীদের সহযোগিতা ও আমার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের অগাধ ভালোবাসার কারণে। আমি মনে করি, আমার দ্বারা রোগীরা উপকৃত হয়েছেন বলে তারা আমার জন্য দোয়া করেছেন। আমার হয়তো কিছু ভুলত্রুটিও হয়েছে, কিন্তু তার কোনোটাই আমি ইচ্ছাকৃতভাবে করিনি।

চিকিৎসাসেবার অন্যতম উপাদান জনসচেতনতা তৈরি, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সহযোগিতা ছাড়া তা বাস্তবায়ন অসম্ভব। চিকিৎসাক্ষেত্রের সাফল্যগুলো উপেক্ষা করে শুধু কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ফলাও করে প্রচার করার চর্চা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রচারমাধ্যম যদি সঠিক বিষয়টা প্রচার না করে, তাহলে ডাক্তার ও রোগী উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায়ই দেখা যায়, মিডিয়াগুলো ডাক্তারদের নেতিবাচক দিকগুলো বেশি প্রচার করে। আমাদের দেশেই অনেক জটিল রোগের চিকিৎসাসহ শত শত অপারেশন সফলভাবে করা হচ্ছে। কিডনি, লিভার এবং বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট, হৃদরোগের বাইপাস, রিং পরানো, নিউরো সার্জারি ইত্যাদি আধুনিক চিকিৎসা উন্নত দেশের মতোই হচ্ছে। আমাদের দেশেও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসক আছেন, চিকিৎসায় সফলতাও আছে। কিন্তু সর্বদা যদি দোষত্রুটিগুলো প্রচার করা হয়, ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তবে অনেকেই উৎসাহ হারিয়ে ভয়ভীতির মধ্যে কাজ চালাতে বাধ্য হবেন। কর্মক্ষেত্রে ডাক্তাররা যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলোও সঠিকভাবে প্রচার করা দরকার। কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটলেই ভুল চিকিৎসা বলে প্রচার করে জনগণের আস্থা নষ্ট করা অনুচিত। এতে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার হবে। অনেক জটিল রোগ যেমন স্ট্রোক, হৃদরোগ, কিডনি বা লিভার নষ্ট, ব্লাড ক্যান্সার বা অন্য অনেক ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিরাময়যোগ্য নয়। মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, সেখানেও মৃত্যুর হার বেশি। মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে কেউই বাঁচাতে পারবে না। ডাক্তাররা তো কাউকে জীবন দিতে পারে না। রোগের উপশম করাতে সাহায্য করেন মাত্র। জীবন-মৃত্যু আল্লাহর হাতে। তাই স্বাভাবিক বা রোগজনিত মৃত্যু হলেই ভুল চিকিৎসা হলো- এভাবে প্রচার করাটা অন্যায়, অযৌক্তিক। শুধু ভুলগুলো যদি সাংবাদিকরা ফলাও করে প্রচার করেন তাহলে রোগীরা যাবেন কোথায়? এতে জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। খারাপের পাশাপাশি অবশ্যই ভালো দিকগুলোও তুলে ধরা দরকার। তা না করলে ডাক্তারদের প্রতি অন্যায় করা হবে। একটা ভুল হলে তা প্রচার করে সারা জীবনের গৌরবময় অর্জনগুলো ধূলিসাৎ করে দেবেন না। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের তথা মিডিয়া হাউসগুলোর আরও সতর্ক হওয়া উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের অভিযোগের সত্যতা যাচাই না করে তৎক্ষণাৎ খবর প্রকাশ করা হয়, জনগণ সেটাই ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে এবং চিকিৎসকের প্রতি অনাস্থা আরও বেড়ে যায়। অভিযোগ তদন্তের পর দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই ডাক্তারের ভুল ছিল না। কিন্তু মিডিয়া তো ভুল হিসেবে প্রচার করেই ফেলেছে। এরপর তো আর করার কিছুই থাকে না। মাঝ থেকে একজন চিকিৎসকের জীবন, ক্যারিয়ার ধ্বংসের মুখোমুখি হয়ে যায়। তাই, অন্তত ডাক্তারের ভুল হয়েছে, কোনো অভিযোগ প্রচারের আগে তার যথাযথ মতামত নিন। পরিপূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত সংবাদ প্রচার করবেন না। এ রকম যদি হয় তাহলে কোনো রোগীর রিস্ক ডাক্তাররা নেবে না। এতে কিন্তু রোগীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কাটাই বেশি।

আমি আজীবন স্বপ্ন দেখি, মানুষের সেবা দেব। নিশ্চয় একদিন দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে। রোগীর সেবা আমার ব্রত ছিল, আছে এবং থাকবে।

লেখক : সাবেক ডিন, মেডিসিন অনুষদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর