শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা
বায়তুল মোকাররমের খুতবা

ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের গুরুত্ব

মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেম পেশ ইমাম

ইসলামে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের গুরুত্ব অনেক, কারণ দেশের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, দেশের মানুষের প্রতি যার মায়ামমতা নেই সে দেশের জন্য উন্নয়নমূলক কাজ করতে পারে না, দেশের জন্য কোনো কিছু ত্যাগ করতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মানসম্মান, স্বাধিকার ও ইমান-আমল রক্ষা করা যায় না। দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ইমান ও আদর্শভিত্তিকই হতে হবে। ইমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। এজন্য নিজের দেশ ও জাতির প্রতি স্বাধীন দেশের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকতে হবে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে স্বদেশপ্রেমের কথা বলা হয়েছে। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে। স্বদেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইমানের দাবি। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদে বলা হয়- ‘স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ’। ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়মনজুড়ে আরবি প্রবাদ বাক্যটি স্বদেশপ্রেমের বিরাট প্রভাব ফেলেছে।

সাহাবায়ে কিরামও স্বদেশকে খুব ভালোবাসতেন। সুদীর্ঘ ১৩ বছর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবিরা মক্কায় ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছেন এবং অন্যায়-অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত তাঁরা মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। হিজরতের পর মদিনায় বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বিলাল (রা.) জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন, অসুস্থ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে স্বদেশ মক্কার স্মৃতিচিহ্ন জেগে উঠেছিল। তাঁরা জন্মভূমি মক্কার দৃশ্যাবলি স্মরণ করে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। এ অবস্থায় রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের মনের দুরবস্থা দেখে প্রাণভরে দোয়া করলেন, ‘হে আল্লাহ! আমরা মক্কাকে যেমন ভালোবাসি তার চেয়েও বেশি মদিনার ভালোবাসা আমাদের অন্তরে দান করুন।’ বুখারি।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বদেশপ্রেমের চেতনার মূলে রয়েছে দেশের প্রিয় ভূখ-কে ভালোবাসা, স্বদেশের তাহজিব-তামাদ্দুন তথা কৃষ্টি-সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মাতৃভাষাকে ভালোবাসা সর্বোপরি স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। একটি দেশের মুমিন মুসলমানের জন্য হিজরতের আবশ্যকতা তখনই দেখা দেয় যখন নিজের দেশে তাদের ইমান নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব না হয়। যেমনভাবে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরামের জন্য মক্কায় ইমান নিয়ে টিকে থাকা সম্ভবপর ছিল না বলেই তাঁদের প্রতি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিকনির্দেশনা আসে। মুসলমানদের জীবনে এ হিজরত বা দেশত্যাগের বিধান একটি মৌলিক ভিত্তি, যা প্রকৃতপক্ষে মুমিন বান্দাকে স্বদেশপ্রেমেই উদ্বুদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার স্বদেশ বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত না হলে তিনি নিজেও আক্রান্ত হবেন না। আক্রান্ত হবে না তার ইমানও। সুতরাং নিজের ইমান, আমল ও দীন ইসলামকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তাকে স্বদেশকে ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা করতেই হবে। তা ছাড়া এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, স্বদেশপ্রেম জান্নাত লাভের উপায়ও, এ কারণেই যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে এবং দেশের সার্বিক তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত থাকবে তাদের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কাছ থেকে বিশেষ পুরস্কারের আশ্বাসবাণী ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তাই আল্লাহর দীনের জন্য, দেশের স্বধীনতা অর্জন ও দেশমাতৃকার সুরক্ষার জন্য জানমাল উৎসর্গ করা ফরজ বা অবশ্যকর্তব্য। এ মর্মে আল কোরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ কিনে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, নিধন করে ও নিহত হয়।’ সূরা তওবা, আয়াত ১১১।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বদেশপ্রেমকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত লাভের উপায় হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘যারা দেশরক্ষার উদ্দেশ্যে সীমান্ত পাহারায় বিনিদ্র রজনী যাপন করে তাদের জন্য জান্নাত।’

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘দুই প্রকারের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। প্রথমত, সেই চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, দ্বিতীয়ত, আল্লাহর পথে সীমান্ত পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয় বা বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ তিরমিজি। এ কথাও স্মরণ রাখতে, হবে স্বদেশপ্রেম ইমানি দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজকাল মানুষের স্বদেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধের নৈতিকতা অনেকটা লোপ পেয়েছে। শুধু দেশের প্রতি কেন, অসহায় মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখাতেও মানুষ আজ কুণ্ঠাবোধ করে অথচ দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা সবার ইমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য। আল্লাহ আমাদের দেশের স্বাধীনতা রক্ষা ও দেশকে ভালোবাসার তাওফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর