মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

হে মহান স্বাধীনতা তুমি সবার হও

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

হে মহান স্বাধীনতা তুমি সবার হও

এখনো আমরা কিছু মানুষ কালের সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি। স্বাধীনতা এক অমূল্য সম্পদ। সবার ভাগ্যে এমন দুর্লভ সম্পদ জোটে না। সব দেশ ও জাতি সবসময় স্বাধীন থাকে না। আমরাও কখনো স্বাধীন ছিলাম না। আমাদের পূর্বপুরুষরা শত শত বছর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বুকে নিয়ে রাতদিন কষ্ট করেছেন, রক্ত দিয়েছেন, জীবন পাত করেছেন। কিন্তু তারা স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি। আমরা সেই সৌভাগ্যবান যারা দর্শকের ভূমিকায় নয়, স্বাধীনতা অর্জনে শরিক হয়েছি, বাহুবলে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। ২৬ মার্চ, ১৯৭১-এ স্বাধীনতা এলেও এর প্রচেষ্টা বহুদিনের। বাঙালি জাতির হৃদয়ে তিলে তিলে অঙ্কুরিত হয়েছে স্বাধীনতার বীজ। আমরা ফুলে ফলে ফসলে ভরে দিয়েছি।

ভাবতেও অবাক লাগে, মনে হয় এই তো সেদিন উত্তাল মার্চে ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। হঠাৎই কী মনে করে পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। জ্বলে ওঠে জাতি, রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে মানুষ। আজ কত সময় দেখি কত জাতীয় সমস্যা সামনে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু কারও কোনো খেয়াল নেই। শিক্ষকরা রাস্তায়, ছাত্ররা আন্দোলনে, শ্রমিকরা তাদের দাবিতে কত কষ্ট করছে। কারও কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই। কিন্তু সেদিন ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্টেডিয়াম ছেড়ে জনতার সঙ্গে খেলোয়াড়রা রাস্তায় নেমে এসেছিল। মতিঝিলের হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভা হচ্ছিল। মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ হোটেলের সামনে সমবেত হয়। তারা নেতার কাছে জানতে চায় কী করতে হবে। হুকুম চাই। শুরু হয় আরেক পর্যায়। আন্দোলন  হয়েছে ভোট হয়েছে দেশবাসী তার আস্থা উজাড় করে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছে। তার পরও ইয়াহিয়ার খামখেয়ালি মানুষ ভালোভাবে নিতে পারেনি। দেশের সর্বত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। যারা তখনো রাজনীতি বুঝত না অতটা আগ্রহী ছিল না তারাও আগ্রহী হয়। এ কি অন্যায়। আমরা ভোট দিয়েছি আওয়ামী লীগকে, আমরা ভোট দিয়েছি বঙ্গবন্ধুকে। ইয়াহিয়া বাধা হয়ে দাঁড়াবেন কেন? এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। পল্টনে ডাক দেয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতার পতাকা তোলেন ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব, ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ। জাতীয় সংগীত, রাষ্ট্রপতি, রাষ্ট্রপিতা ঠিক করা হয়। পতাকা তো আগেই ঠিক করা ছিল। একটা দেশের জন্য যা যা চাওয়া পাওয়া, যা বলার তার কিছুই বাকি ছিল না। পল্টনে আসেন বঙ্গবন্ধু জাতির নেতা ও পিতা। তিনি ঘোষণা করেন, ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে তার যা বলার বলবেন। দেশে অসহযোগের ডাক দেওয়া হয়। সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা সরকারি আইন অমান্য করে জনতার আইন পুনর্বহাল। ব্রিটিশবিরোধী কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন ঘিরে অসহযোগের ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতায় যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের পর বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে পূর্ব বাংলায় যে অসহযোগ হয়েছিল তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও মেলে না। সে সময় ভারতের গান্ধীবাদী যারা বেঁচেছিলেন তারা তাদের অসহযোগের চাইতে আমাদের অসহযোগকে শক্তিশালী, গুরুত্বপূর্ণ ও সবদিক থেকে পরিপূর্ণ একটি অসহযোগ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এলেন। অমন জনসমাগম বাংলার কোথাও কেউ দেখেনি। বঙ্গবন্ধু মুক্তকণ্ঠে বললেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব- এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ কি তেজ, কি দিকনির্দেশনা। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান হানাদাররা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন আমরা যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম তারা মরমে মরমে উপলব্ধি করেছি আমাদের যখন যা দরকার তাই ছিল ভাষণে। কোনো দিকনির্দেশনার অভাব ছিল না। এখন আমরা নির্বোধেরা মাইক বেঁধে সভা-সমাবেশে লোক জড়ো করতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বাজাই। একটুও ভাবি না যে এটা ওষুধ বিক্রির ক্যানভাসের জন্য নয়। তবু আমরা বাজাই। আমরা কখনো কখনো সবকিছু ত্যাগ করতে পারি আবার কখনো কানাকড়িও ছাড়তে চাই না। হঠাৎই কেউ কিছু কুড়িয়ে পেলে তার ভারসাম্য থাকে না। কষ্ট করে অর্জনের যে মূল্য হঠাৎ ভিক্ষের মতো পাওয়া কোনো কিছুর তেমন মূল্য হয় না, মূল্যায়নও হয় না। আমাদের স্বাধীনতা অনেকটা তাই। আমরা সবাই মিলেমিশে একাকার হয়ে স্বাধীনতা এনেছিলাম। আর আজ কোনো কিছুতেই আমরা এক নই। আমরা এত পণ্ডিত, সবকিছুতেই ভিন্নতা সবকিছুতেই বিভেদ। নেতাতে বিভেদ, নেতৃত্বে বিভেদ, আমাদের মানবতায় বিভেদ, মমতায় বিভেদ। আমাদের মনুষ্যত্ব বিভক্ত। যাদের হাতে কর্তৃত্ব-নেতৃত্ব এসব নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা নেই। এ যেন কুরুক্ষেত্রের একদিকে পঞ্চপাণ্ডব যুধিষ্ঠির-ভীম-অর্জুন-নকুল-সহদেব, অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্র দুর্যোধন-দুঃশাসন। কেউ ভালোমন্দ তলিয়ে দেখে না। ভীষ্ম নীরব, মহামতি দ্রোণ নীরব। আমাদের অনেকটা তেমন হয়েছে। কত অন্যায়-অবিচার সত্যের যেন লেশমাত্র নেই। তবু আমরা ঢেঁকুর তুলছি, ভালো আছি। কত সাফল্য কত অগ্রগতি। প্রতিদিন রাস্তায় মানুষ মরে বিশেষ করে শিশু-ছাত্ররা। কুচ পরোয়া নেহি। সত্যিই কি এভাবে চলে, সত্যিই কি এজন্য আমাদের স্বাধীনতা? পাকিস্তানি ২২ পরিবারের হাত থেকে মুক্তির আশায় আমরা জীবন পাত করেছি। এখন তো ২২ হাজারের হাতে বন্দী। আগে রাষ্ট্র, রাজনীতি ছিল গরিবের, শোষিতের। এখন রাষ্ট্র-রাজনীতি সবই শোষকের করায়ত্ত। রাষ্ট্র-রাজনীতি সবই আজ ধনিক-বণিকের আজ্ঞাবহ। গরিবের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। কখনো কখনো ভাবি, নেতা পিতা ৫৫ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন, আমরা কেন এখনো বেঁচে আছি। কত কথা মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করলেই ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতের স্মৃতি ভেসে ওঠে। আজ ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ আর ’৭১ সালের ২৬ মার্চ এক ছিল না।

ঢাকার উত্তরে টাঙ্গাইলের মানুষ আমরা। ’৭০-এর নির্বাচন থেকে আমাদের রাতদিনের কাজই ছিল পাকিস্তানের বিরোধিতা। সেজন্য যখন যা করার আদাজল খেয়ে করেছি। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করতে ’৬৭-৬৮-৬৯ শেষ পর্যন্ত এক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জেল থেকে ছিনিয়ে এনে আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়েছিল এ দেশের ছাত্র, এ দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতা। প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান আইয়ুব খানকে তাড়িয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার রাজনীতির ইচ্ছা নেই, ক্ষমতার লোভ নেই। দুই বছরের মধ্যে শাসনভার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে দিয়ে আমি ব্যারাকে ফিরে যাব।’ আমরা কেউ সরকারের কথা বিশ্বাস করতাম না। এখন যেমন ধীরে ধীরে চারদিকে অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। তখনো তেমনি ছিল। তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে এক সাধারণ নির্বাচন হয়। সরকারের এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেম ওয়ার্ক)-এর আওতায় কত রকমের বিধিনিষেধ! এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। যদি বলি কোনটা করব, সেটাও করা যাবে না। তার পরও বঙ্গবন্ধু বার বার বলতেন, ‘বাংলাদেশে জনে জনে নেতা। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগে নেতা ঠিক হোক।’ তাই হয়েছিল। সব মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী জনতার রায় মানেনি। শেষ পর্যন্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ করতে হয়েছে।

২৫ মার্চ গভীর রাতে ওভাবে নরপশুরা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর কামান-বন্দুক-মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে এটা ছিল সবার কাছে অকল্পনীয়। গ্রেফতার করা হতে পারে, দু-এক জায়গায় সংঘর্ষ বা গোলাগুলি হতে পারে। কিন্তু এমন নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তছনছ করে দিয়ে শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীদের হত্যা করা- এ ছিল আমাদের কাছে অকল্পনীয়। আমরা রাতদিন সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছিলাম। ২৫ মার্চ সারা দিন তেমন কোনো ভয়াবহতা ছিল না। ঘটনা ঘটেছিল রাতে। তাই এর প্রভাব পড়ে ২৬ মার্চ। অন্যদিনের মতো স্বাভাবিকভাবে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। পরিবেশ-পরিস্থিতি জাগিয়ে তুলেছে। যে যেভাবে পেরেছিলাম রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তার পরও বহু কষ্টে ঢাকার দিক থেকে একের পর এক গাড়ি আসছিল। সব হতবিহ্বল মানুষ, নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু। তাদের সে কি আহাজারি। অনেকের চোখ কোটরাগত। কিয়ামতের আলামত দেখে এসেছে তারা। তারা যে বেঁচে আছে এটাই অনেক সময় ধরে বিশ্বাস করতে চাচ্ছিল না। আমরা যে যেভাবে পারছিলাম সাধারণ মানুষকে সান্ত্বনা দিতে, সাহায্য করতে, খাবার জোগাতে কাজ করছিলাম। যারা একমুহূর্ত অপেক্ষা করতে চাচ্ছিল না তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে সে ছিল এক মহাযুদ্ধ। ২৬ মার্চ, ’৭১ আমাদের জীবনে এক ভয়াবহ নতুন অভিজ্ঞতা। এমন অভিজ্ঞতা আমরা কল্পনায়ও আনিনি। তাই কিছুটা হতভম্ভ, স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের কিছু নেতা ওইদিন শহর ছেড়ে গ্রামে পালালেও যাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল তারা তা ঠিকই নিয়েছিলেন। আদালতপাড়ায় অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলামের বাড়িতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে কী করণীয় তার ওপর এক সভা বসে। বদিউজ্জামান খান চেয়ারম্যান, লতিফ সিদ্দিকীকে আহ্বায়ক করে টাঙ্গাইল জেলা গণমুক্তি পরিষদ গঠিত হয়। লতিফ সিদ্দিকীকে করা হয় সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান। টাঙ্গাইলের ফৌজদারি কোর্টকে সদর দফতর করে তারা তাদের তৎপরতা চালাতে থাকেন। ঢাকা থেকে আসা উদ্বাস্তুদের জন্য খাবার-দাবার, গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া, টাঙ্গাইলকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার কোনো কিছুই বাদ যায়নি। সুচারুরূপে আমাদের নেতারা এসব করেছিলেন এবং সঠিকভাবে করেছিলেন বলেই আমরা জয়ী হয়েছিলাম। প্রথম অবস্থায় আমরা পারি বা না পারি, সফল হই বা না হই। কিন্তু যখন যা করা প্রয়োজন আমাদের নেতারা তা করেছিলেন। সে ক্ষেত্রে তাদের কোনো ত্রুটি ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আমরা এঁটে উঠতে পারিনি সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডে নেতাদের নেতৃত্বে কোনো ত্রুটি ছিল না। টাঙ্গাইলে ইতিহাস খ্যাত কাদেরিয়া বাহিনীর সৃষ্টি ও সফলতা তা অনেকটাই ২৬ মার্চ টাঙ্গাইলে সফলভাবে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ফল।

বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সফলতা যেমন দুর্বলতাও কম নয়। আমরা অনেক কিছুকেই সময়মতো সঠিকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করি না এবং যার যেটুকু পাওনা অনেক সময় অনেককে বেশি দিই, আবার কখনোসখনো কাউকে কাউকে কিছুই দিতে চাই না। কিছু দিতে গেলেও কৃপণতা করি। কত কিছু হলো, আজ যদি ’৭১-৭২-এ যাদের ভূমিকার জন্য আমরা দাঁড়িয়ে আছি তাদের কথা বিচার করি বিশ্লেষণ করি প্রকৃত অর্থে আমরা তাদের অনেককে খুঁজেই পাব না। আমাদের মনে নেই। সাহিত্যিক-সাংবাদিক-লেখক কারও স্মৃতিতে নেই, আলোচনায় নেই। তাই নতুন প্রজন্ম বর্তমান নিয়েই ব্যস্ত। অতীতের মহামূল্যবান সম্পদ ভুলে বসে আছে। বরং যারা স্বাধীনতা চায়নি, চরম বিরোধিতা করেছে তারা মূল্যায়িত হয়েছে। কিন্তু যারা স্বাধীনতা এনেছে তারা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত। এই কদিন আগে মন্ত্রিত্ব গেছে জনাব রাশেদ খান মেনন; মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমবঙ্গে গিয়েছিলেন। কদিন পরই ফিরে এসেছিলেন। তখন বাংলাদেশে থাকা এবং শহরে ঘোরাফেরা সে এক অভাবিত ব্যাপার। পাকিস্তানকে সমর্থন না করে থাকার পথ ছিল না। কী বলা যাবে, স্বাধীনতার পরপরই সব পাকিস্তানি কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে গেল বাঙালি, হয়ে গেল স্বাধীনতার পক্ষের। আর যারা দীর্ঘ নয় মাস অনিশ্চিত জীবন বয়ে বেড়াল তারা হয়ে গেল অবহেলিত অনাদৃত। এটা এখন নয়, স্বাধীনতার পরপরই শুরু হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে কোনো দুর্বলতা যদি থেকে থাকে তা হলো যারা পাকিস্তানে আটকা ছিল তাদের দেশে আনার জন্য রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেননি। অনেক কিছুই ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানে আটকা পড়া বাঙালিদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। পাকিস্তানে আটকে থাকা সবাই বাঙালি ছিল না। তারা অনেকেই মনেপ্রাণে পাকিস্তানিও ছিল। জনাব হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তানে আটকা ছিলেন না। আটকা থাকলে কী করে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দুবার পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে তার রংপুরের বাড়িতে যান। এসব কোনো কথাই বলতে চাই না। কিন্তু কেন যেন মনের অজান্তেই হামাগুড়ি দিয়ে সব বেরিয়ে আসে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আজও সবার কাছে এক হলেন না। সবাই মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারল না। সন্তান যদি পিতাকে স্বীকার না করে বা স্বীকার করতে না চায় তাহলে তার পরিচয় কোথায়? আর পিতৃপরিচয়হীন মানব-সন্তানের গর্ব করার কী থাকে। কিন্তু আমরা বুঝতে চাই না। একসময় ‘জয় বাংলা’ ছিল বাংলার আকাশে-বাতাসে-সাগরে-নদীতে। কিন্তু আজ ‘জয় বাংলা’র করুণ দশা দেখে মাঝেমধ্যে ভাবি, স্বাধীনতার রণধ্বনি তার এমন নিদারুণ বিপর্যয়! মুক্তিযুদ্ধের অনেক সময় একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে হিন্দুদের আদাব, মুসলমানের সালামের পরিবর্তে ‘জয় বাংলা’ বলা হতো। এটা কেউ বলে কয়ে দিত না, এ ছিল এক স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি। কিন্তু আজ তা হয়ে গেছে এক দলীয় স্লোগান। জাতীয় ভাবধারার ছিটেফোঁটাও নেই। এটা আমাদের পতন না উত্থান- সময় থাকতে বিচার করা দরকার। যে যাই বলুন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ প্রধান কারণ ’৭০-এর গণরায় পাকিস্তানিদের মেনে না নেওয়া। ’৭০-এর ভোটের রায় যদি তারা মেনে নিত কলাকৌশল করে আরও কিছু বছর পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে পারত। যে গণতন্ত্রের জন্য আমাদের দেশের জন্ম যে গণতন্ত্রকে আমরা পৃথিবীর দরবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেই গণতন্ত্রের আজ কি করুণ দশা! উপজেলা নির্বাচন শেষ পর্যায়ে। মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। সেদিন আবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, ‘ভোটারের অংশগ্রহণ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই।’ কারও মাথা থাকলে তো ব্যথা থাকবে। তার মাথা-মনন কিছুই নেই। মানুষ এমন লাজলেহাজহীন হয়! দেশের যে কত বড় ক্ষতি হচ্ছে কেউ ভেবে দেখছে না। দেশের মানুষ হতাশ হলে নাগরিকরা হতাশ হয়ে পড়লে তাদের উৎসাহী করা বড় কঠিন কাজ। জাতীয় সমস্যা জাতীয়ভাবে সবাই মিলেমিশে মোকাবিলা বা সমাধান করা উচিত। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো বেঁচে আছি বলে সবার কাছে সেই দাবিই করি, দেশ কারও একার নয়। দেশ সবার। সাধারণ মানুষ বড় কষ্ট স্বীকার করে, মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। আজ যারা যত বড় তারা তাদের কাছে তত বেশি ঋণী। কথাটা ভুলে গেলে বড়রাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বেশি। তাই এই মহান দিনে সব দেশবাসীকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অভিবাদন-অভিনন্দন জানাই। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবারসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদের আত্মার শান্তি কামনা করি।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর