বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আসল বনাম নকল মুক্তিযোদ্ধা

সুমন পালিত

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা তৈরি হয়, তার মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে অমুক্তিযোদ্ধাদেরও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি রাজাকারদেরও মুক্তিযোদ্ধা বানানোর কারসাজি চলে। মুক্তিযুদ্ধের ভুয়া সার্টিফিকেট সম্বল করে ’৭১-এর ঘাতকদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনও আত্মপ্রকাশ করে। সন্দেহ নেই, স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির নামে চলেছে প্রহসন। ’৭১-এ প্রায় পুরো জাতি ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা নয়, রাজাকার-আলবদর ঘাতকদের তালিকা তৈরি করাই ছিল বেশি জরুরি। তাহলে পরবর্তীতে যারা কাক হয়ে ময়ূরপুচ্ছ ধারণ করার চেষ্টা চালিয়েছেন তাদের প্রতিহত করা সহজ হতো।

কারও কারও মতে, ’৭১-এর সার্টিফিকেট থাকলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়। এ ধারণার মধ্যেও রয়েছে মারাত্মক ভ্রান্তি। এ ভ্রান্তির কারণেই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে জনমনে ভুল ধারণা গড়ে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মর্যাদা সমুন্নত রাখার স্বার্থেই বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। ’৭১-এ পাকিস্তানি হানাদাররা বাঙালি জাতির ওপর চড়াও হয়! নির্বিবাদে তারা গণহত্যা চালায়। এ দেশে এই দস্যুদের হাতে যারা প্রাণ হারায়, তাদের সবাই যে বাঙালিত্বের চেতনায় বিশ্বাসী ছিল- এ কথা ঠিক নয়। বরং বহু ক্ষেত্রে সেমসাইডের ঘটনাও ঘটেছে। মনেপ্রাণে পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাভাষী হওয়ার কারণে অনেককে প্রাণ হারাতে হয়েছে। বাঙালিত্বে বিশ্বাসী নন, এমন অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাধ্য হয়ে নাম লিখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বাঙালিত্বের প্রতি তাদের কোনো মমত্ববোধ ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল মুজিবনগর সরকার। এ সরকারের মধ্যেও বিভীষণদের স্থান পেতে কষ্ট হয়নি। স্মরণ করা যেতে পারে খন্দকার মোশতাকের কথা। মাহবুবু আলম চাষীর নামও উল্লেখ করা যেতে পারে। এদের একজন ছিলেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আরেকজন শীর্ষ কর্মকর্তা। কিন্তু কতটা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তারা? মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী সরকারের মন্ত্রী হয়েও মোশতাক গোপনে পাকিস্তান রক্ষায় কাজ করেছেন। যোগাযোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের সঙ্গে। ষড়যন্ত্র ধরা না পড়লে ’৭১ সালের ইতিহাস অন্যরকম হওয়ারও আশঙ্কা ছিল।

দুই. বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বল্পস্থায়ী। ভিয়েতনাম, চীন, কিউবা, কোরিয়ার মতো বছরের পর বছর কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে কে সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা, আর কে পঞ্চমবাহিনী তা চিহ্নিত করার সুযোগ হয়নি। এর ফলে সংখ্যায় অল্প হলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অঙ্গীকার নেই এমন অনেক হাফ রাজাকারের পক্ষেও সার্টিফিকেট লাভের সুযোগ মিলেছে। এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার পর কোথাও কোথাও লুটপাটের আশ্রয় নিয়েছে। মগবাজারের এক তথাকথিত নেতাকে জানি, দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যার হাঁকডাক কারও চেয়ে কম নয়। এই তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার পারিবারিক অবস্থান কখনো নুন আনতে পান্তা ফুরানোর চেয়ে ভালো ছিল না। কিন্তু ‘মুক্তিযোদ্ধা’ এই সার্টিফিকেট ছিল তার কাছে। আলাদিনের চেরাগ। স্বাধীনতার পর এই পরিচয়ের জোরে তিনি দখল করেন অসহায় হিন্দু রমণীর কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি; যা দখলে রাখতে তিনি যখন যেমন তখন তেমন নীতিরও আশ্রয় নেন। আওয়ামী লীগ আমলে ছিলেন সেই দলের ক্যাডার। পরবর্তীতে মহাজাতীয়তাবাদী। এরশাদের আমলে ডিগবাজি দিয়ে সেই দলের কেন্দ্রীয় নেতা বনে যান। সে সময় কখনো কখনো এই মদ্যপ ব্যক্তিটিকে বেসামাল অবস্থায় ড্রেনের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যেত। এরশাদের পতনের পর তৎক্ষণাৎ দল না পাল্টালেও ভোল পাল্টান। শুরু করেন দুনিয়ার সবচেয়ে আদিম ব্যবসা। মগবাজারের একটি গলির মধ্যে অবস্থিত তার হোটেলটি রাজধানীর অন্যতম পতিতালয় হিসেবে পরিচিত ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট থাকলেই যে মুক্তিযোদ্ধা হয় না, তার প্রমাণ আরেক তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা নেতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পর এই বর্ণচোরা ব্যক্তিটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের মহাসচিব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরে তাকে দেখা গেছে জামায়াতিদের আসরে। মাওলানা সাঈদীর মাহফিলে তাকে সভাপতিত্ব করতে দেখা গেছে। মাহফিলের প্রচারপত্রে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি। মাওলানা সাঈদী এমপি হওয়ার পর দাবি করেন তার নির্বাচনে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কাজ করেছেন। অগ্রজ সাংবাদিক আবেদ খান তার এক লেখায় এ দাবিটি চ্যালেঞ্জ করেন। বলেন, কোনো মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার-আলবদরের নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহৃত হতে পারে না। আবেদ খানের এ বক্তব্যটি তাত্ত্বিক দিক থেকে সত্যি। কিন্তু সার্টিফিকেট-সর্বস্ব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সত্যি নয়। মাওলানা সাঈদীর নির্বাচনী নাটক সম্পর্কে যারা অবহিত তারা জানেন এই জামায়াত নেতাকে জেতাতে কোনো কোনো তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠককে, যিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তাকে হারাতে তারা একজন ‘রাজাকার’কে সমর্থন করাকেই যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন। নির্বাচনী নাট্যমঞ্চে হাজির হয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের সার্টিফিকেট নিয়েই। মুক্তিযুদ্ধের মহান চেতনাকে জবাই করতে সেই দুর্বৃত্তদের বুক এতটুকু কাঁপেনি।

’৭১-এর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানি এজেন্টদের হাতে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জাতির জনক হত্যায় জড়িত ফারুক-রশীদ-হুদা-শাহরিয়ার-ডলিম চক্রের প্রায় সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারী। জিয়াউর রহমান ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী। বীরউত্তম পদকের অধিকারী। কিন্তু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিনাশ সাধনে তিনিই অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সংবিধান থেকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতির তিনটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বিসর্জন দেন। ’৭১-এ জাতিসংঘে যে ব্যক্তিটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছেন সেই শাহ আজিজকে তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আবদুল আলীম, আবদুর রহমান বিশ্বাস, মাওলানা মান্নানের মতো রাজাকারদের মন্ত্রী বানিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। কারাগারে প্রতিদিনই মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তিনি যে আনন্দ পেয়েছেন, কোনো রাজাকারের ভাগ্যে তেমন সুযোগ জোটেনি। তিন. মুক্তিযুদ্ধ এক চেতনার নাম। এই চেতনাকে বাদ দিলে তা আর মুক্তিযুদ্ধ থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিশ্বাস নেই, এমন কাউকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ’৭১-এ অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সত্ত্বেও অনেকেই পরে ব্যক্তিস্বার্থে নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছেন। অপশক্তির স্বার্থে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতিকে ব্যবহার করেছেন ’৭১-এর চেতনাকে প্রতিহত করার কাজে। এমন বিভীষণরা যত বড় পরিচয়ধারীই হোন না কেন, মুক্তিযোদ্ধা নন। ’৭১-এ বাঙালিরা অস্ত্র ধরেছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। সেই লক্ষ্য ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ার। শোষণহীন সমাজের অঙ্গীকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রতিশ্রুতি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। ’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদারদের গণহত্যার কারণে এ যুদ্ধ তুঙ্গে উঠলেও তার সূত্রপাত ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই। বাঙালির ভাষাকে কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ হিসেবেই ’৫২ সালে তা রক্তাক্ত রূপ নেয়। ’৬২, ’৬৬, ’৬৯ সালের আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও ’৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ছিল মুক্তিযুদ্ধেরই অংশ। বাঙালির অর্জিত বিজয় মেনে না নেওয়ার কারণেই ’৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সশস্ত্র রূপ ধারণ করে। ’৪৮ থেকে ’৭১ পর্যন্ত বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম প্রতিটি পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। এ বিকাশের পেছনে কাজ করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণা। কাজ করেছে শোষণহীন সমাজের অঙ্গীকার। কাজ করেছে সামরিকতন্ত্রের প্রতি ঘৃণা ও গণতান্ত্রিক সিভিল সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। এর কোনোটিকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ভাবা অস্বীকার করার শামিল।

চার. মুক্তিযুদ্ধ এক মহতী চেতনার নাম। বিশ্বাসের নাম। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের প্রতি যাদের অঙ্গীকার নেই তারা ’৭১-এ বাধ্য হয়ে যে ভূমিকাই পালন করুন না কেন, মুক্তিযোদ্ধা নন। যারা ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে পরে শত্রুপক্ষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ের দাবিদার হতে পারেন না। যারা মুক্তিযুদ্ধের সুফল পৌঁছে দেওয়ার বদলে লুটপাটে লিপ্ত হয়েছেন, তারা যে পরিচয়েরই হোন, রাজাকারদেরই দোসর। পক্ষ ত্যাগ করে যারা গোলাম আযম, মাওলানা সাঈদীদের দোসর সেজেছেন, তাদের আসল পরিচয় যে রাজাকার, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। মুক্তিযোদ্ধা কে আর রাজাকার কে- এ মূল্যায়নে সার্টিফিকেটের কোনো মূল্য নেই। কারণ ’৭১-এ সনদপত্রের জন্য বাঙালিরা লড়েনি। লড়েছে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। আত্মগর্ব জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। বিদেশি দখলদারদের সৃষ্ট সাম্প্রদায়িকতাকে চিরতরে কবর দেওয়ার জন্য। মুক্তিযোদ্ধা নামধারী হয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের পুনর্বাসিত করেছেন তাদের একটাই পরিচয়- তারা পক্ষত্যাগকারী। যারা মুক্তিযোদ্ধার জোব্বার নিচে রাজাকারদের প্রশ্রয় দিয়েছেন, তারা রাজাকারদের দোসর। যারা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্যক্তিস্বার্থের কাছে আদর্শ বিসর্জন দিয়েছেন তারা বিপথগামী। পক্ষত্যাগী মোনাফেক। তাদের পরিচয় মুক্তিযোদ্ধা নয়। কোনো মুক্তিযোদ্ধা তাদের অপরাধের দায়িত্ব নিতে পারে না।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

ইমেইল :[email protected]

সর্বশেষ খবর