বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

আজকের জাটকায় আগামী দিনের ইলিশ

মো. সামছুল আলম

ইলিশের ডিম পরিস্ফুটনের মাধ্যমে এর বাচ্চা ‘জাটকা’ তৈরি হয়। ইলিশের পোনাকে (১০ ইঞ্চি/২৫ সেন্টিমিটারের নিচে) জাটকা বলা হয়। আজকের জাটকাই আগামী দিনের ইলিশ। জাটকা নির্বিচারে ধরা হলে ইলিশের উৎপাদন কমে যায়। জাটকা নদ-নদীতে বিচরণ করে। তখন জেলেরা নির্বিচারে জাটকা আহরণ করতে চায়। নির্বিচারে জাটকা ধরা হলে ইলিশ উৎপাদন ও আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা জাটকা ইলিশ মাছের নতুন প্রজন্মের প্রবেশন স্তর।

ইলিশের জীবনচক্র বেশ বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের নোনা পানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেওয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠা পানিতে চলে আসে। ১টি ইলিশ ৩ লাখ থেকে ২১ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেওয়ার ২২ থেকে ২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত পাঁচ-সাত মাস এরা নদীতে থাকে। পরে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ এক-দুই বছর বয়সে (২২ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার আকারের পুরুষ; ২৮ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে গমন করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কমবেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাৎ আশ্বিনের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এজন্য আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগের চার দিন, পূণির্মার দিন ও পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। তাই এ লক্ষ্যে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম অর্থাৎ গত বছরও ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ২২ দিন প্রজনন ক্ষেত্রের ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ ও কেনাবেচা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারের এমন উদ্যোগে বিগত আট বছরের ব্যবধানে দেশে ইলিশ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৬৬ শতাংশ, যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল বিবেচনা করছে। ২০১৬ সালে ইলিশ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশের স্বত্ব এখন বাংলাদেশের।

ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে দেশে ইলিশের ষষ্ঠ অভয়াশ্রম প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রমের জন্য চিহ্নিত এলাকাগুলো হচ্ছে- বরিশালের সদর ও হিজলা উপজেলার কালাবদর নদীর ১৩.১৪ বর্গকিলোমিটার, মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলা উপজেলার গজারিয়া ও মেঘনা নদীর যথাক্রমে ৩০ ও ২৭৪.৮৬ বর্গকিলোমিটার। প্রস্তাবিত ষষ্ঠ অভয়াশ্রম এলাকার নদীসমূহের মোট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৮২ কিমি ও আয়তন ৩১৮ বর্গকিলোমিটার। প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হলে এ এলাকায়ও মার্চ-এপ্রিলে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকবে। ইলিশসম্পদ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বর্তমান সরকারের নানান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু রয়েছে। এসব কর্মসূচির আওতায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জাটকাসমৃদ্ধ ১৭ জেলার ৮৫টি উপজেলায় জাটকা আহরণে বিরত ২ লাখ ৪৮ হাজার ৬৭৪টি জেলে পরিবারকে মাসিক ৪০ কেজি হারে ৪ মাসের জন্য মোট ৩৯ হাজার ৭৮৮ মেট্রিক টন চাল প্রদান করা হয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধকাল ছাড়াও বিগত দুই অর্থবছরে মা ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধকালে ২২ দিনের জন্য পরিবার-প্রতি ২০ কেজি হারে মোট ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৪৬২টি পরিবারকে মোট ১৪ হাজার ৮২৪ মেট্রিক টন ভিজিএফ খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে জেলেদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি চালু রয়েছে। জাটকা আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য মৎস্য অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়িত জাটকা সংরক্ষণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা প্রকল্পের আওতায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে মোট ৩২ হাজার ৫০৯ জন সুফলভোগীকে জাটকা ও পরিপক্ব ইলিশ সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদানসহ ক্ষুদ্র ব্যবসা, হাঁস-মুরগি পালন, গরু-ছাগল পালন, ভ্যান/রিকশা চালানো, সেলাই মেশিন, ইলিশ ধরার জাল প্রদান, খাঁচায় মাছ চাষ ইত্যাদি আয়মূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। তা ছাড়া প্রকৃত মৎস্যজীবী ও জেলেদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে মৎস্য অধিদফতর থেকে ইতিমধ্যে ১৬ লাখ ২০ হাজার মৎস্যজীবী ও জেলের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে এবং ১৪ লাখ ২০ হাজার জেলের মাঝে পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশে মোট মাছ উৎপাদনেও বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মাছ উৎপাদিত হয়েছে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন, ইলিশ উৎপাদন ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। দেশে মাছ উৎপাদনে ইলিশের অবদান ১২%; যার বর্তমান বাজার মূল্য ২০ হাজার কোটি টাকার ঊর্ধ্বে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান বর্তমানে ১%। দেশের মোট উৎপাদনে মাছের অবদান ৫৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত ১০ বছরে মাছ খাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এভাবে উৎপাদন হলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী ২০২২ সালে মাছে বাংলাদেশ বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে যাবে বলে জানিয়েছেন পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক ড. কৃষ্ণা গায়েন। সূত্র ওয়েবসাইট।

লেখক : কৃষিবিদ।

ইমেইল : alam4162@ gmail.com

সর্বশেষ খবর