বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইরানের মেয়েদের আন্দোলন

তসলিমা নাসরিন

ইরানের মেয়েদের আন্দোলন

হিজাব নিয়ে আজকাল নতুন করে কথা বলছে মানুষ। বিশেষ করে ইরানি যে মেয়েরা হিজাব না পরার অধিকারের জন্য আন্দোলন করছে, এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্যাতন সইছে, জেল খাটছে। ইরানের এই মেয়েরাই অবাক হয়েছে, কোনও সভ্য দেশে মুসলিমদের সমর্থন করার প্রতীক যদি হয়ে ওঠে হিজাব। নাসরিন সতুদের, ইরানের মানবাধিকার-আইনবিদের, শুধু বাধ্যতামূলক হিজাবের প্রতিবাদ করায় শাস্তি হয়েছে, ৩৮ বছরের জেল আর ১৪৮টা চাবুকের আঘাত। মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বলেছিলেন বলে নাসরিন সতুদের জেল হয়েছিল ২০১০ সালে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট তাকে মুক্তচিন্তার জন্য সাখারভ পুরস্কার দেয়। কিন্তু নাসরিনের ওপর নির্যাতন বন্ধ হয় না। নাসরিনের পক্ষে লড়ার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দাঁড়িয়েছে।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যে আন্তরিকতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে তার দেশের এক ভয়ানক দুঃসময় সামলেছেন, তা পাশ্চাত্যের অন্য কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব হতো বলে আমার মনে হয় না। সারা বিশ্ব তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এত শক্তিশালী দেশ আমেরিকা! সেই আমেরিকায় কদিন পর পর বন্দুকধারী সন্ত্রাসীরা নিরীহ নিরপরাধ মানুষদের মেরে ফেলছে, তারপরও দেশের প্রেসিডেন্ট বন্দুক আইনের কোনও পরিবর্তন করতে পারেননি। অথচ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এক তুড়িতে সেটি করে ফেলেছেন। তাকে কুর্ণিশ করার পরও তার হিজাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে অনেকে। মুসলিমদের সমর্থন করতে চাইলে আরও নানা পদ্ধতি তো আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং চাকরিক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধে দাও, লক্ষ রাখো তারা যেন শুধু শ্বেতাঙ্গ নয় বলে, শুধু খ্রিস্টান নয় বলে, বৈষম্যের শিকার না হয়। সব রকম সন্ত্রাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করো, সন্ত্রাস থেকে দূরে থাকার জন্য, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করো। র‌্যালি করেছে মানুষ আহত এবং নিহত মুসলিমদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। আন্দোলনকারী মেয়েদের পা খোলা থাকলেও মাথা ঢেকে নিয়েছে। সম্ভবত নিউজিল্যান্ডের মেয়েরা জানে না যে, হিজাব না পরেও একটি মেয়ে ইসলামে বিশ্বাস করতে পারে। ইরানের, আফগানিস্তানের, বাংলাদেশের এমন আরও অনেক মুসলিম দেশের মেয়েদের হিজাব পরার সংস্কৃতি ছিল না। হিজাব এসেছে, যখন মোল্লাতন্ত্র এসেছে, যখন মুসলিম মৌলবাদ শক্তিমান হয়েছে। ইরানে কী করে আন্দোলনটা শুরু হয়েছে গত বছর, বলি। ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে ভিদা মভায়েদ নামে ৩১ বছর বয়সী এক তরুণী রাস্তার পাশে ইউটিলিটি বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে একটি লাঠির মাথায় পতাকার মতো উড়িয়ে দেন নিজের মাথা ঢাকার স্কার্ফ। তাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়, কয়েক সপ্তাহ পরে হাজত থেকে মুক্তি পান তিনি। মভায়েদের শান্তিপূর্ণ হিজাব-বিরোধী প্রতিবাদের পর আরও অনেক মেয়েই ইউটিলিটি বাক্সের ওপর বা কোনও উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে লাঠি বা গাছের ডালে বা কঞ্চিতে হিজাব বেঁধে পতাকার মতো উড়িয়েছেন। একজন বৃদ্ধাকেও দেখলাম পার্কের একটি উঁচু জায়গায় উঠে নিজের মাথা থেকে স্কার্ফ খুলে নিয়ে হাঁটার লাঠিটিতে পেঁচিয়ে ওড়ালেন।

চল্লিশ বছর ধরে ইসলামি প্রজাতন্ত্রটিতে মেয়েদের হিজাব বাধ্যতামূলক। তুমি মেয়ে, তুমি ঘর থেকে রাস্তায় বেরোবে ভালো কথা, কিন্তু তোমার মাথা কাপড়ে ঢেকে বেরোতে হবে। তোমার মাথা থেকে পায়ের নখ অবধি এমনভাবে ঢেকে রাখবে যেন কেউ দেখতে না পায়। এ নিয়মটি যখন ইসলামি নেতারা চালু করেছিলেন, তখন ইরানজুড়ে প্রতিবাদ হয়েছিল। প্রতিবাদ বিফলে গিয়েছে। মেয়েরা বাধ্য হয়ে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকেছে। হঠাৎ করেই আজ কিন্তু ইরানি মেয়েরা ভিড়ের রাস্তায় মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে ফেলছে না, প্রতিবাদটা অনেক বছর যাবৎ চলছে।

২০১৪ সালে মাসিহ আলিনেজাদ, নামের একজন ইরানি সাংবাদিক ফেসবুক পেইজ খুলেছিলেন, পেইজের নাম ছিল ‘আমার গোপন স্বাধীনতা’, মেয়েদের আহ্বান জানিয়েছিলেন যেন মেয়েরা রাস্তাঘাটে দোকানপাটে পাবলিকের ভিড়ে দাঁড়িয়ে হিজাব খুলে ফটো তোলে, সেই ফটো ওই পেইজে পোস্ট করে। গত বছর মাসিহ আলিনেজাদ আরেকটি আন্দোলন শুরু করেন, এবারেরটির নাম ‘সাদা বুধবার’। এবার তিনি মেয়েদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বাধ্যতামূলক হিজাব আইনের বিরুদ্ধে সাদা রঙের হিজাব পরে আন্দোলন করার জন্য। সম্ভবত ভিদা মভায়েদ আলিনেজাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ওই সাদা হিজাব পরেছিলেন, দিনটি ছিল বুধবার।

২০০৯ সালে ইরান ত্যাগ করার আগে মাসিহ আলিনেজাদ সাংবাদিকতা করতেন। তিনি ফেসবুকে, গাড়ি চালাচ্ছেন, মাথায় হিজাব নেই এমন একটি ফটো পোস্ট করেছিলেন। তখনও তিনি মেয়েদের আহ্বান জানিয়েছিলেন, তারাও যেন এমন গোপন ফটো তার ফেসবুকে পোস্ট করেন। ওই পেইজের এখন ১০ লাখেরও বেশি ফলোয়ার। এই কাজটা যে মাসিহ খুব পরিকল্পনা করে করেছিলেন তা নয়। জাস্ট এমনি। কিন্তু মেয়েদের এত সাড়া পেয়ে তিনি মুগ্ধ এবং বিস্মিত! ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করতে ইরানের মেয়েরাই তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল বক্তব্য- এ আমার শরীর, এই শরীরে কী পোশাক আমি পরবো বা পরবো না, সেই সিদ্ধান্ত আমি নেব, অন্য কেউ নয়। এরা কিন্তু হিজাব জিনিসটা অর্থহীন এ কথা বলছেন না। এরা কিন্তু কোনও মেয়েরই হিজাব পরা উচিত নয়, এ কথাও বলছেন না। এরা ‘বাধ্যতামূলক’ ব্যাপারটিকে বিদায় করতে বলছেন। যার ইচ্ছে, সে হিজাব পরবে, যার ইচ্ছে নয়, সে পরবে না। এ দাবি নতুন নয়, কিন্তু ইরানি রাজনীতিকরা মেয়েদের পছন্দমতো পোশাক পরার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। ইরানের সম্রাট রেজা শাহ পাহলভি হিজাব নিষিদ্ধ করেছিলেন ১৯৩৬ সালে। এটি যে খুব চমৎকার আইন ছিল তা নয়, কারণ অনেক মহিলাই তখন ছিলেন, যারা হিজাব না পরে লোকের সামনে যেতে অস্বস্তি বোধ করতেন। তারা মনে করতেন, হিজাব পরার অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। অনেকে এ কারণে ঘর থেকেই বের হতেন না। এরপর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর আগের ঠিক উল্টোটা ঘটেছে, হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি ১৯৭৯ সালে হিজাবকে বাধ্যতামূলক করেছেন। অনেক মেয়েই খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে করেন, তাদের হিজাব না-পরার অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে, মাথার চুল নিয়ে পুরুষ-রাজনীতিকরা এত বেশি চিন্তিত যে, প্রশ্ন জাগে, মেয়েদের শরীর কি পুরুষের সম্পত্তি! পুরুষেরা চিরকালই মেয়েদের এক টুকরো সম্পত্তিই ভেবে এসেছে, এই বিজ্ঞানের যুগে এই আশ্চর্য অবিজ্ঞানের চর্চা আজও বন্ধ হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই।

১৯৭৯ সালে হিজাব বাধ্যতামূলক করার বিরুদ্ধে মেয়েরা পথে নেমেছিল। জয়ী হতে পারেনি। হিজাবের পক্ষের লোকেরা তখন স্লোগান দিত, ‘ইয়া রুসারি ইয়া তুসারি, হয় হিজাব পরো, নয় মার খাও’। অগত্যা মেয়েরা যারা হিজাব পরতে চান না, তাদের হিজাব যেহেতু পরতেই হবে, তা না হলে জেলে যেতে হবেÑতারা হিজাবের দৈর্ঘ্যকে যথা সম্ভব ছোট করলেন, জামাকেও ছোট করলেন এবং আঁটো করলেন। হিজাবের কারণে ইরানে অগুনতি মেয়ে গ্রেফতার হয় এবং আজও হচ্ছে। এক ২০১৪ সালেই মেয়েদের বিরুদ্ধে ৩৬ লাখ ‘ভালো করে হিজাব না পরার অভিযোগ’ এসেছে পুলিশের কাছে।

২০০৬ সালে ইরানি নারীবাদিরা তাদের পক্ষে ১০ লাখ সই জোগাড় করেছিলেন, সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন নারীবিরোধী আইনগুলো বাতিল করার জন্য। কিন্তু ওতে কাজ হয়নি। সরকার কোনও আইনই বাতিল করেনি। এই আন্দোলনটি বিফলে যাওয়ায় এটিই প্রমাণ হয়, মেয়েদের স্বাধীনতার পক্ষে এই ধরনের আন্দোলন ইরানে সফল হওয়া সম্ভব নয়। মাসিহ আলিনেজাদ এবং তার বয়সী তরুণীরা নতুন রকম আন্দোলন করতে চাইছেন। তারা মেয়েদের মাথার হিজাবকে, অত্যাচারের প্রতীককে, আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। বলছেন, ‘আমরা এক টুকরো কাপড়ের বিরুদ্ধে লড়ছি না। আমরা আমাদের সম্মানের জন্য লড়াই করছি। আমরা যদি আমাদের মাথার ওপর কী চড়াবো সেই সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, আমাদের মাথার ভেতরে যা আছে, তার দায় দায়িত্ব নিতেও আমাদের দেওয়া হবে না।’

যেদিন ভিদা মভায়েদ রাস্তার ইউটিলিটি বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে হিজাব উড়িয়ে দিলেন, সেদিন পুলিশ প্রধান বলেছেন, ‘হিজাব যারা ঠিকঠাক পরবে না, তাদের শাস্তি দেওয়ার বদলে বরং তাদের শিক্ষিত করতে হবে।’ গোটা ইরানজুড়ে হিজাববিরোধী আন্দোলন চলছে, দেখে দেশের প্রেসিডেন্ট হাসান রোহানী বলেছেন, ‘ঠিকই তো, তুমি তোমার পছন্দ-অপছন্দ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারো না’। একটু কি নরম হচ্ছেন সরকার?

এখনকার তরুণীদের হাতে আছে মোবাইল টেকনোলজি, তারা শুধু মানুষকে জড়ো করতে পারেন তা নয়, নিজেদের বক্তব্যও ছড়িয়ে দিতে পারেন। সরকার নরম হচ্ছে মানে মেয়েদের এই আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখছে। আলিনেজাদ তো বলছেন, ‘আগে সরকারকে ভয় পেত মেয়েরা, এখন, মেয়েদের ভয় পাচ্ছে সরকার’।

 

হয়তো আলিনেজাদ অতি আশাবাদী। এ পর্যন্ত ২৯ জন মেয়েকে কিন্তু হিজাববিরোধী আন্দোলন করার অপরাধে বেঁধে নিয়ে গেছে সরকারের পুলিশ বাহিনী। আমার কিন্তু মনে হয় না, ইরানি মেয়েরা তাদের অধিকার অতি সহজে ফেরত পাবেন। কিন্তু এই যে ইরানের সর্বত্র এক আন্দোলন হলো, মেয়েরা কী পোশাক পরবেন সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার মেয়েদের, সরকারের নয়-এই বলে জনবহুল রাস্তায় মাথার হিজাব খুলে উড়িয়ে দেওয়ার মতো সাহস দেখালেন, এটি কম বড় কাজ নয়। সাহস সাহসের জন্ম দেয়। আরও মেয়েরা অনুপ্রাণিত হচ্ছেন, হিজাব খুলে ফেলছেন। এই আন্দোলন শুধু ইরানে নয়, সারা বিশ্বেই শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, যতদিন না মেয়েরা হিজাব না পরার অধিকার পান। হিজাব পরারও অধিকার চাই, সেটি মেয়েদের আছেই। শুধু না পরার অধিকারের জন্য আন্দোলন। আসল আন্দোলন কিন্তু মেয়েদের সমানাধিকারের জন্য আন্দোলন। ইসলামের মানবিক দিকে বিশ্বাস রেখে, সমাজকে সমতার সমাজ হিসেবে গড়ে তোলা কি সম্ভব নয়, যে সমাজে নারীরা দাসী হিসেবে বা যৌন বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হবে না, চিহ্নিত হবে সম্পূর্ণ এবং সক্ষম মানুষ হিসেবে? রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে আলাদা করে, সমতার আইন বহাল করেÑসভ্য সমাজ গড়ে তোলার জন্য একদিন না একদিন নারী পুরুষ সবাইকে উদ্যোগ নিতেই হবে। চাইলে সবই সম্ভব, এই বিশ্বাসটুকু যেন থাকে। আপাতত আমাদের দাবি, নাসরিন সতুদে-সহ সব হিজাব-না-পরার-অধিকার চেয়ে যারা আন্দোলন করছেন, তাদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হোক।

            লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর