রবিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

লন্ডন-৭১ : ডাউনিং স্ট্রিটে তিন রাত

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

লন্ডন-৭১ : ডাউনিং স্ট্রিটে তিন রাত

প্রতিদিনের মতো ২৫ মার্চও আমরা সারা দিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে লবিং করছিলাম, এমপি এবং লর্ডদের কাছে দাবি জানাচ্ছিলাম বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তাব পাস করার জন্য। পাকিস্তানে সাহায্য বন্ধের জন্য, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ইত্যাদি। লবিং করছিলাম যুক্তরাজ্য ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে।

লন্ডনে যখন সন্ধ্যা নামি নামি করছে ঠিক তখনই সে সময়ের জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা সুলতান মাহমুদ শরিফ (বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি) ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উপস্থিত সদস্যদের বললেন, দেশে গণহত্যা শুরু হয়ে গেছে। এখন আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। এখনই আমাদের অন্তত দুজনকে প্রধানমন্ত্রীর দোরগোড়ায় অনশন ধর্মঘট শুরু করতে হবে।

উপস্থিত সবাই বলল আমি (মানিক) যেন অনশন শুরু করি। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আর এক সদস্য আফরোজ আফগান চৌধুরীও আগ্রহ প্রকাশ করলে আমরা দুজন অনির্দিষ্টকালের জন্য অনশন ধর্মঘটে বসে গেলাম ঠিক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িঘেঁষা ফুটপাথে। এরই মধ্যে দুটি স্লিপিং বেগের ব্যবস্থা করা হলো।

সে সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির চারপাশে এত নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না, ছিল না লোহার গ্রিলগুলো।

আমরা অনশনে বসার পরপরই ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সবাই মিলে কয়েকটি পোস্টার তৈরি করে ফেলল যাতে লেখা ছিল Stop Genocide, Recognize Bangladesh  ইত্যাদি। এরই মধ্যে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলোয় খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দলে দলে বাঙালির ঢল নামল অনশন ধর্মঘট এলাকায়। অনেকেই এসেছিলেন আমাদের দেখতে। আজ ৪৮ বছর পর সবার কথা মনে নেই। তবে সে সময়ের ছবি দেখে যাদের কথা মনে করতে পারছি তার মধ্যে ছিলেন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১ নম্বর আহ্বায়ক মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, ২ নম্বর আহ্বায়ক খন্দকার মোশাররফ (পরে বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ), ৩ নম্বর আহ্বায়ক বুলবুল (পরে ব্যারিস্টার বুলবুল মাহমুদ), এ বি এম খায়রুল হক (পরে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি), ছাত্রনেতা আবদুল মজিদ চৌধুরী মঞ্জু, মুজিবুল হক, সুরাইয়া বেগম (পরে অধ্যাপক ড. সুরাইয়া খানম), নৃত্যশিল্পী ফাহমিদা মঞ্জু মজিদ (কবি গোলাম মোস্তফার দৌহিত্রী), আলো চৌধুরী, ব্যারিস্টার শামসুল মোর্শেদ (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইন কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রদূত), ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান শাহজাহান (প্রয়াত), মুন্নি রহমান, বাম নেতা নিখিলেশ চক্রবর্তী, সাইদুর রহমান মিঞা (পরে ব্যারিস্টার সাইদুর রহমান মিঞা), আরশ আলী (পরে ব্যারিস্টার আরশ আলী), শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ (পরে কলকাতায় আইন পেশারত ব্যারিস্টার শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ), হাবিবুর রহমান (পরে জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্র্যান্টসের প্রধান কর্মকর্তা), মাহমুদ এ রৌফ (বর্তমানে লন্ডনে অ্যাকাউন্ট্যান্সি পেশায় নিয়োজিত এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদ নেতা), ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন, ব্যারিস্টার জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম (পরে বিচারপতি সৈয়দ আমির), জাকির আহমেদ, আবুল হাসান চৌধুরী কায়সার (পরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী), আমিনুল হক (পরে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার আমিনুল হক), বিবিসি বাংলার শ্যামল লোধ, কমল বোস, হাবিব ভূঞা, মুজিব, মতিউর রহমান, মিনহাজ উদ্দিন, বি এইচ তালুকদার, আহমদ হোসেন জোয়ারদার, রমজান আলী, শেখ আবদুল মান্নান, আকতার ইমাম (পরে ব্যারিস্টার আকতার ইমাম)।

.পরদিন গার্ডিয়ান, মর্নিং স্টার, ওয়ার্কার্স ডেইলি প্রভৃতি পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় আমাদের অনশনের ছবিসহ খবর ছাপা হলে, ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিনে সচিত্র খবর ছাপা হওয়ায় এবং বিবিসি টেলিভিশনে প্রচারের পর জায়গাটি লোকারণ্য হয়ে যায়। শুধু বাঙালি নয়, প্রচুর ব্রিটিশ ও বিদেশি পর্যটকও আসতে শুরু করলেন, জানতে চাইলেন সব কথা। দেশ-বিদেশের অনেক সাংবাদিক আমাদের সাক্ষাৎকার নিলেন। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের জন্য কোনো দফতর খোলা হয়নি বলে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে অনশন ধর্মঘটের সে জায়গাটিই হয়ে উঠল আন্দোলনের মূল এলাকা। ড. খন্দকার মোশাররফ তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান’ গ্রন্থে সঠিকভাবেই লিখেছেন, ‘১৯৭১-এর ৩১ মার্চ পর্যন্ত লন্ডনে প্রতিবাদ প্রতিরোধের সকল কর্মতৎপরতার কেন্দ্র ছিল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অনশন ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রচারণার জন্য তখনো তেমন কোনো সংগঠন গড়ে ওঠেনি।’ (৩৭ পৃষ্ঠা)।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এডওয়ার্ড হিথ। বাড়ি থেকে সকালবেলা হেঁটেই পার্লামেন্টে যেতেন এবং বিকালে ফিরতেন। যাওয়ার সময় আমাদের গুড মর্নিং বলে যেতেন আবার ফেরার পথে বলে যেতেন গুড আফটার নুন। দ্বিতীয় দিন থেকেই বেশকিছু পার্লামেন্ট সদস্য এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন পিটার শ্যোন, ব্রুস ডগলাস মেন, জন স্ট্রোন হাউস, মাইকেল বার্নস, স্যার আর্থার বটমলি, ঢবি জেসেল, মাইকেল ফুট, লর্ড ব্রুকওয়ে প্রমুখ। এসেছিলেন জন এনালস, মার্টিন এনালস, পিটার হেইন, ডেভিড ফ্রস্ট, ভেনেসা রেড গ্রেভের মতো রাজনৈতিক ও সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব। প্রতিদিনই একজন ডাক্তার এসে আমাদের রক্তচাপ পরীক্ষা করে যেতেন। এ ছাড়া কিছু সাদা পোশাকের পুলিশও আমাদের পাহারায় নিয়োজিত ছিল বলে পরে জেনেছি।

দিনের যে কোনো সময় কমপক্ষে ৫০০ জন ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত থাকতেন এবং মুহুর্মুহ ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘রিকগনাইজ বাংলাদেশ’ ধ্বনিতে মুখরিত করে তুলতেন পুরো এলাকা। পুলিশ ছিল অত্যন্ত সহনশীল, তাদের মূল নজর ছিল সড়কে প্রতিবন্ধকতা রোধ করা।

২৬ তারিখে সন্ধ্যায় অনশনস্থলে এসেছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের সিরাজুর রহমান, প্রখ্যাত গ্রন্থকার প্রয়াত আবদুল মতিন যিনি তখন ব্রিটিশ সরকারের রেস রিলেশন্স কমিশনে উঁচু পদে চাকরিরত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব উপাচার্য বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মতিন চৌধুরীর শ্যালক ও বঙ্গবন্ধু গবেষক। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস মতিন ভাই ও সিরাজুর রহমান সাহেব ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ সদস্যদের তথ্য-উপাত্ত এবং লেখা দিয়ে সাহায্যে করতেন। ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় তারা দুজন এসে খবর দিলেন সেদিনই বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। এ সংবাদ আমাদের আরও উদ্দীপ্ত করলÑ সবাইকে বলতে শুরু করলাম আমরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। এত দিন আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে অনুসরণ করেছি কেননা সে ভাষণে তিনি কোনো কিছু বলার বাকি রাখেননি। পরিষ্কার ভাষায় বলেছেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সিরাজুর রহমান সাহেবের বদৌলতে বিবিসি স্টুডিওতে গিয়ে আমাদের সুযোগ হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক ও মাইলফলক ভাষণ সরাসরি শোনার। সেদিন অনশনস্থলে এসেছিলেন বিবিসির দুজন খণ্ডকালীন অংশগ্রহণকারী রাজিউল হাসান রঞ্জু (পরে রাষ্ট্রদূত) ও ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসান (পরে ড. ফজলে রাব্বি মাহমুদ), এসেছিলেন রোকন উদ্দিন মাহমুদ (বর্তমানে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ)। এসেছিলেন ইন্ডিয়া উইকলির তারাপদ মুখার্জি, তোসাদ্দেক আহম্মেদও। আরও এসেছিলেন নোবেল লরিয়েট শ্যোন ম্যাকব্রাইট। অনশনকালে পাকিস্তান হাইকমিশনে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে কর্মরত মহিউদ্দিন আহমেদ (পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব), ডিরেক্টর অব অ্যাকাউন্টস লুৎফল মতিন ও শিক্ষা অফিসার প্রয়াত হাবিবুর রহমান সাহেব আমাদের সাফল্য কামনা করে এবং মুক্তিযুদ্ধে জয়ের আশা ব্যক্ত করে জয় বাংলা বাণী পাঠিয়েছিলেন।

উল্লেখযোগ্য যে, মহিউদ্দিন সাহেব, লুৎফল মতিন সাহেব ও হাবিবুর রহমান জানুয়ারি থেকেই আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছেন পাকিস্তান হাইকমিশনের ভিতর থেকেই। ২৬ তারিখের একটি ঘটনা মনে রাখার মতো। সেদিন বিকালে প্রধানমন্ত্রী ডেকেছিলেন পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলীকে। তাদের বৈঠক শেষ হওয়ার পর হাইকমিশনার যখন তার বেন্টলি গাড়িতে চড়তে উদ্যত ঠিক তখন অনশন এলাকায় দণ্ডায়মান ব্যারিস্টার শামসুল মোর্শেদ লাভলু তার হাতে থাকা একটি পত্রিকা ছুড়ে মেরেছিলেন সালমান আলীকে। ঠিক তখনই দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ লাভলু ভাইকে ধরে নিয়ে গেল। সে এলাকায় যে সাদা পোশাকে পুলিশ ছিল এটা তখনই জানলাম। বাংলাদেশ আন্দোলনকালে আমাদের সবার নিরাপত্তার দায়িত্বে যে অফিসার ছিলেন তার নাম মি. লেংলি। তিনি পরে আমাদের বলেছেন, সে এলাকায় পাকিস্তানিদের আক্রমণ থেকে আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক সাদা পোশাকে পুলিশ রাখা হতো।

২৮ তারিখে আমাদের রক্তচাপ কমে যাওয়ায় ডাক্তার এসে বলে গেলেন সেদিন সন্ধ্যায় আমরা অনশন না ভাঙলে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। এ কথা শুনে সুলতান শরিফ সাহেব ছুটে গেলেন সংসদ সদস্য রাইট অনারেবল পিটার শোরের (পরে মন্ত্রী) কাছে। পিটার শোর সাহেব দুই বোতল দুধ নিয়ে এসে আমাদের অনশন ভঙ্গ করতে অনুরোধ করলে আমরা তার থেকে এই মর্মে প্রতিজ্ঞা দাবি করলাম যে, তিনি পার্লামেন্টে বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং গণহত্যা বন্ধের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন, যা তখন অবধি করা হয়নি। তার সেই অঙ্গীকারের পর আমরা অনশন ভঙ্গ করি। পিটার শোরও তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন, পরদিনই তিনি ওই প্রস্তাব উত্থাপন করেন সাফল্যের সঙ্গে। আমাদের অনশন ধর্মঘটের গুরুত্ব সম্পর্কে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার লেখা ‘প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো’ বইতে লিখেছেন, ‘আন্দোলনের একেবারে শুরুর দিকেই ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটে ছাত্রনেতা মানিক চৌধুরী ও আফরোজ আফগান অনশন ধর্মঘট করেন। তারা যে কদিন অনশন ধর্মঘট করেছিলেন, সে কদিন সাংবাদিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। এর ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের নির্মমতার কথা আরও ব্যাপকভাবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশে সহায়তা করে।’ (৫৪ পৃষ্ঠায়)।

ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধে বিলাত প্রবাসীদের অবদান’ বইতে লিখেছেন, ‘এ সপ্তাহের (২৮ মার্চের) প্রধান কর্মসূচি ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সমর্থনদানের দাবিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখে বাঙালি ছাত্রদের অনশন ধর্মঘট। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মানিক (ব্যারিস্টার) এবং আফরোজ আফগান চৌধুরী (বর্তমানে হবিগঞ্জে আইনজীবী এবং বিএনপি নেতা) ২৯ মার্চ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। এ সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছিল। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট পার্লামেন্ট ভবনের কাছে অবস্থিত থাকায় পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে অনশন ধর্মঘটের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিল। “পাকিস্তান ধ্বংস হউক”, “ইয়াহিয়া খানের পতন হউক”, “বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হউক”, “এগিয়ে যাও মুক্তিসেনা” ইত্যাদি ইংরেজিতে লিখিত স্লোগানসংবলিত ব্যানার-পোস্টারসহ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের শত শত কর্মী অনশনকারীদের সঙ্গে অবস্থান গ্রহণ করে।’ (৩২ পৃষ্ঠা)।

বঙ্গবন্ধু গবেষক ও স্বনামধন্য গ্রন্থকার প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আবদুল মতিন তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি’ বইতে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে বাঙালি ছাত্র শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও তার সহকর্মী আফরোজ আফগান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটবর্তী রাস্তার ফুটপাথে বৃহস্পতিবার (২৫ মার্চ) অনশন শুরু করেন। অনশনকারীদের ছবি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কয়েকদিন পর শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোনের অনুরোধে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও তার সহকর্মী অনশন ত্যাগ করেন।’ (৩৩ পৃষ্ঠা)।

আমাদের অনশনের একটি বিশিষ্ট ফল ছিল এই যে, বিবিসিসহ বেশ কটি প্রচারমাধ্যমে আমাদের সাক্ষাৎকার প্রচার করায় ব্রিটিশ জনগণ ও রাজনীতিকরা বাংলাদেশে গণহত্যার চুলচেরা তথ্য আরও অধিকভাবে জানতে পারেন।

১৯৭২ সালে আমাদের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আমন্ত্রণক্রমে পিটার শোর (মহামান্য রাষ্ট্রপতি আমাকে এবং প্রবাসী মুক্তিসংগ্রামে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন, এমন কয়েকজনকেও নিমন্ত্রণ করেন) বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মানিক চৌধুরী এবং তার সহকর্মীর অনশন ভাঙাতে গিয়ে তাদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম শিগগিরই পার্লামেন্টে গণহত্যাবিরোধী প্রস্তাব উত্থাপন করাব এবং সেই মতে তার পরদিনই আমি হাউস অব কমন্সে গণহত্যার নিন্দায় প্রস্তাব দাখিল করি যেটি ছিল গণহত্যার বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে প্রথম প্রস্তাব।’

অনশন কার্যক্রমের সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদে ‘পিস নিউজ’ পত্রিকার সম্পাদক রজার মুডি ফোন করে বললেন, কয়েকজন বিবেকবান অবাঙালি বাংলাদেশে গণহত্যায় বিচলিত, তারা কিছু করতে চান এবং সেই উদ্দেশ্যে পিস নিউজ অফিসে এক সভায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের কয়েকজনের উপস্থিতি কামনা করছেন। তার অনুরোধে আমি, খন্দকার মোশাররফ, যিনি ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ২ নম্বর আহ্বায়ক ছিলেন এবং মাহমুদ এ রৌফ লন্ডনের কিংসক্রমে পিস নিউজ অফিসে গেলে পল কনেট, মেরিয়েটা প্রকোপে এবং সংসদ সদস্য মাইকেল বার্নসকে দেখি। কথা প্রসঙ্গে তারা তিনজনই বলেন, অনশন ধর্মঘটকালে আমাদের গণমাধ্যমের সাক্ষাৎকার থেকে তারা অনেক অজানা তথ্য জেনেছেন। মেরিয়েটা অবশ্য বলেছিলেন তিনি তার পরিচিত জন ফজলে হাসান আবেদের (বর্তমানে ব্র্যাকপ্রধান স্যার ফজলে হাসান আবেদ) কাছ থেকেও অনেক তথ্য পেয়েছেন। উল্লেখ্য যে, আবেদ সাহেবও প্রবাসী মুক্তিসংগ্রামে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। সেই বৈঠকেই মূলত অবাঙালিদের সংস্থা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সভাপতি হন পল কনেট ও সাধারণ সম্পাদক হন মেরিয়েটা প্রকোপে।

রাষ্ট্রদূততনয়া মেরিয়েটা প্রকোপে উত্তর লন্ডনের কেমডেন টাউনের ৩৪ নম্বর স্ট্যাটফোর্ড ভিলায় তার বহুতল বাড়ির একটি তলা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’কে প্রদান করেন সংস্থার অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। তার গৃহপরিচারিকা মিসেস ডিও অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মীদের সহায়তা করতেন। মেরিয়েটা তার গাড়িও দিয়েছিলেন অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকাণ্ডের জন্য। অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকাণ্ডের জন্য আর্থিক সহায়তার পুরোটাই মেরিয়েটা দিতেন।

যদিও আমরা দুজন অনশন করেছিলাম, আমাদের সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকতেন যুক্তরাজ্যের বহু বাঙালি। তাদের কথা আজও মনে পড়ে, মনে পড়ে মার্চের সেই শীতের রাতে তারা কখনো অধৈর্য হতেন না। দেশের মুক্তির জন্য তাদের অবদান নিশ্চয় ভুলে যাওয়ার নয়।

            লেখক : সাবেক বিচারপতি।

সর্বশেষ খবর