মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রিয়াঙ্কায় ঘুম হারাম বিজেপির

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

প্রিয়াঙ্কায় ঘুম হারাম বিজেপির

গোটা বিশ্ব এখন তাকিয়ে আছে ভারতের গণতন্ত্রের উৎসব দেখার জন্য। এই গণতন্ত্র উৎসবে শামিল হয়েছে ভারতের ১৩০ কোটি মানুষ; যার মধ্যে ৯০ কোটি পুরুষ ও মহিলা ভোটদাতা। তাঁরাই স্থির করবেন ২০১৯-এর মে মাসে দিল্লির সাউথ ব্লকের তিন তলার দক্ষিণের ঘরটিতে কে বসবেন- মোদি না রাহুল গান্ধী? পাঁচ বছরের শাসনে মোদি গোটা দেশবাসীকে একটার পর একটা ধাক্কা দিয়ে গেছেন। এ অভিযোগ শুধু বিরোধীদেরই নয়, ভুক্তভোগী ভারতের আপামর জনসাধারণের। তাই তিনি এবার পাকিস্তান ও আগেকার বাংলাদেশের ধাঁচে সামরিক বাহিনীকে সামনে রেখে তাদের ব্যবহার করার জন্য যারপরনাই কসুর করছেন না। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে টেনে আনা মানেই গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তোলা। এ বিপন্ন গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য ১৩০ বছরের পুরনো দল যার নেতৃত্বে আছেন সোনিয়া গান্ধী, কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী এবং কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।

পাঁচ বছর আগে মোদি ক্ষমতায় এসে বলেছিলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি দেশের ‘চৌকিদার’। সম্প্রতি রাহুল গান্ধীর স্লোগান- ‘ম্যায় ভি বে-রোজগার’। রাহুল গান্ধী এ প্রকল্পের নাম দিয়েছেন ‘ন্যায়’। এই ‘ন্যায়’ প্রকল্পে কী আছে? তা এবার দেখা যাক। - সারা দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে ৫০ কোটি মানুষকে বছরে ৭২ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। আর এ টাকা যাবে পরিবারের যিনি জ্যেষ্ঠ মহিলা তার নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। রাহুলের এ ঘোষণার পরই তেড়েফুঁড়ে উঠেছে গেরুয়াবাহিনী, গত সপ্তাহে এক দিনে এ ঘোষণার পরই মোদির ছয়জন গোয়েবলস (মন্ত্রী) বিজেপির মালিকানায় ৬টি চ্যানেলে বিবৃতি দিয়ে অভিযোগ করলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, রাহুল গান্ধী, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট হামিদ আনসারি, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য আহমেদ প্যাটেল- এরা সবাই পাকিস্তানের ‘চর’। বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন এটা মোদির হেরে যাওয়ার আশঙ্কার বহিঃপ্রকাশ। মাস দুয়েক আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় পাকিস্তানি জঙ্গিদের হাতে ৪৪ জন সিআরপিএফ মারা যাওয়ার পর আজাদ কাশ্মীরের বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে ৩০০ পাকিস্তানি জঙ্গিকে হত্যা করেছে বলে মোদি সরকারের দাবি। বালাকোটে কতজন মারা গেছে- সে ব্যাপারে কোনো স্বচ্ছ তথ্য নেই। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এবং রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বালাকোটে সঠিক কতজন মারা গেছে তার কোনো প্রমাণ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দিতে পারেনি। পুলওয়ামাকাে র পর সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোরভাবে নিন্দা করেছিলেন রাহুল গান্ধী, মনমোহন সিংরা এবং সমস্ত বিজেপিবিরোধী দল এ ব্যাপারে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল।

বিরোধীদের বক্তব্য- দেশরক্ষার ব্যাপারে দেশের ১৩০ কোটি লোক সরকারের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। মোদি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা ওই দুটি ঘটনাকে হাতিয়ার করে নির্বাচনের আসরে নেমেছেন। তারা জাতপাত বিভাজনের সৃষ্টি করার জন্য গোটা গেরুয়াবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে আসরে নামিয়ে দিয়েছেন। ২০০৪ সালে নির্বাচনের আগে অটল বিহারি বাজপেয়ি সরকার কাশ্মীরের কার্গিল নিয়ে যুদ্ধ করেছিল, ২০০৪-এর নির্বাচনে বিজেপি কার্গিলে যুদ্ধ এবং বাজপেয়ির আমলে পোখরানে পরমাণু বোমা ফাটিয়ে ইন্ডিয়া সাইনিং স্লোনান দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছিল ২০০৪ ও ২০০৯-এর নির্বাচনে। ভারতের সঙ্গে গণতান্ত্রিক দেশে দেশরক্ষা ছাড়া সামরিক বাহিনী নির্বাচনের হাতিয়ার হতে পারে না। এ মন্তব্য করেছেন সামরিক বাহিনীর সাবেক প্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী।

উল্লেখ্যযোগ্য, বিগত শতকে দেশে জরুরি অবস্থার সময় আরএসএস রটিয়ে দেয় ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করবে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় ইন্দিরা গান্ধী স্বয়ং সাবেক সামরিক বাহিনীর প্রধান এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের নায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল শ্যাম মানেকশকে সাউথ ব্লকে তাঁর অফিসে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞাসা করেনÑ ‘তুমি কি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছ?’ শ্যাম হো হো করে হেসে উঠলেন এবং বললেন, ‘ম্যাডাম এটা পাকিস্তান বা বাংলাদেশ নয়। এটা বিশাল দেশ। সামরিক বাহিনী কোনো দিনই এ দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবে না।’ এ তথ্য পাওয়া যায় স্বয়ং মানেকশর আত্মজীবনীতে। ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরে এসে ইন্দিরা গান্ধী তাকে ফিল্ড মার্শাল উপাধি দিয়েছিলেন। দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মোদির যে কোনো জ্ঞান নেই তা একটার পর একটা কাে  প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।

দেশের মানুষ কি চায়? ‘বে-রোজগারির’ অবসান, কৃষিঋণ মওকুফ, বিজলি, সড়ক, পানি, রুটি-কাপড় মকান এবং রাফাল কেলেঙ্কারিসহ মোদির সব দুর্নীতির অবসান। এই আর্থিক সমস্যাগুলোকে রাহুল গান্ধী তাঁর নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার করেছেন। মোদি এবং তাঁর এনডিএ যখন প্রচার করছে পুলওয়ামা, বালাকোট ও পাকিস্তান; তখন রাহুল পাল্টা প্রচার করছেন যে সরকারি তথ্যানুযায়ী গত ৪৫ বছরের মধ্যে মোদির রাজত্বের মতো এত বেশি ‘বে-রোজগারি’ দেখা যায়নি। তাই রাহুল গান্ধী ‘বে-রোজগারি’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচনে নেমেছেন, ২০১৯ সালে দেশে বাড়তে থাকা বে-রোজগারি। কংগ্রেসের এ দাবির সত্যতা প্রমাণ করেছে সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অফিসের (এনএসএসও) একটি রিপোর্ট যেখানে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ সালে দেশে বেকারের সংখ্যা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যা গত ৪৫ বছরে দেখা যায়নি। এই সরকারি রিপোর্টকে অস্বীকার না করে নীতি-আয়োগের ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমার সাফাই দিয়েছিলেন এটা এনএসএসও খসড়া রিপোর্ট, ফাইনাল রিপোর্ট নয়। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী মোদিকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘যুহরার’ (হিটলারের অপর নাম)। রাহুল অভিযোগ করেছিলেন, মোদি ২০১৪ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনÑ প্রতি বছরে ২ কোটি চাকরি দেবেন। কিন্তু মোদি যা দিয়েছেন তা হলো জাতীয় বিপর্যয়। ৩১ মার্চ অর্থাৎ রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘ম্যায় ভি চৌকিদার’ প্রচারের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে দিল্লির তালকোটরা স্টেডিয়ামে মিলিত হন। মোদির সঙ্গে সেখানে উপস্থিত থেকেছেন বিজেপির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ, বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও সাতজন সাংসদসহ বিজেপির ঘনিষ্ঠ নেতারা। কিন্তু এই মিলনের আগে কংগ্রেসের ‘ম্যায় ভি বে-রোজগার’ প্রচার মোদির দলকে বেশ কিছুটা চাপে ফেলে দিয়েছে।

এবারে তাকানো যাক কোন জোট কোন দিকে ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমেই ধরা যাক পশ্চিমবঙ্গে মোট আসন ৪২টি। এতে এক বছর ধরে রাহুল গান্ধী ও সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির মধ্যে আলাপ-আলোচনায় স্থির হয়েছিল কংগ্রেস ও সিপিএম একসঙ্গে লড়বে। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। প্রদেশ কংগ্রেসের অভিযোগ, সিপিএমের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটের প্রকাশপন্থি নেতা বিমান বসুকে নানাভাবে চাপ দেয় ফ্রন্টের তিন শরিক আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক ও সিপিআই। এ তিন শরিকের নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন বঙ্গেশ্বরী মমতা ব্যানার্জি। ওই তিন দলের সঙ্গে মমতার দীর্ঘদিনের গোপন আঁতাত ছিল। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির এক প্রবীণ সদস্য ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বীকার করেন মমতার কৌশলটা বিমানদা বুঝতে পারেননি। তাই নির্বাচনে এবারও আমরা পশ্চিমবঙ্গে প্রচ  মার খাব। পশ্চিমবঙ্গের পরই বড় রাজ্য মহারাষ্ট্র, মারাঠি স্ট্রংম্যান এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার কংগ্রেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছেন সমান সমান আসনে। দেশের ৮০টি আসনবিশিষ্ট উত্তরপ্রদেশের আসন সমঝোতা নিয়ে সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত ওই রাজ্যের দলিত নেত্রী কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে জোট করেন। কংগ্রেস একাই ৮০টি আসনে লড়ছে। এ লড়াইকে জোরদার করার জন্য উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কংগ্রেসের অন্যতম জেনারেল সেক্রেটারি প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। গত আড়াই মাসের প্রচারে বিজেপির দিনে-রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। ইতিমধ্যে যে খবর সারা দেশে রটে গেছে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস এবার খুব সাফল্য পাবে। ২০১৪ সালে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ২টি আসন- রায়বেরিলি ও আমেথি। যত দূর খবর পাওয়া যাচ্ছে বারানসিতে দাঁড়িয়ে প্রিয়াঙ্কা মোদিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন। শুধু তাই নয়, রাহুল গান্ধী আমেথি ছাড়াও কেরলের ওয়ানার থেকে দাঁড়াচ্ছেন। গত নির্বাচনে মোদিও তার নিজের রাজ্য গুজরাট ও বারানসি থেকে দাঁড়িয়েছিলেন। রাহুলের কেরল থেকে দাঁড়ানোর খবর ঘোষণার পরই গোটা দক্ষিণ ভারত কংগ্রেসের দিকে এগিয়ে এসেছে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যানটনি বলেছেন, দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক, অন্ধ্র ও তালিনাড়ুর সংযোগস্থলের এ কেন্দ্রটি রাহুলের ঠাকুমা ইন্ধিরা গান্ধী দুবার কর্ণাটকের চিকমাগালুর ও উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলি থেকে দাঁড়িয়ে দুই আসনেই জিতেছিলেন।

নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা মনে করেন গণতন্ত্র বাঁচাতে ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থায়ী, কঠোরভাবে রাখতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা বিজেপি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে। দেশের বহু সংখ্যালঘু নেতা মনে করেন মোদি আবার ক্ষমতায় ফিরলে সংখ্যালঘুদের ভয়ঙ্কর বিপদ হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে ধর্মনিরপেক্ষতা। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘুরা বলছে, ‘দিদি’ আর নয়, কারণ তিনি আমাদের বহুবার ঠকিয়েছেন ও মোদির কায়দায় ভূরি ভূরি মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সংবিধানের মৌলিক অধিকার মোদির মতো দিদিও ভঙ্গ করেছেন। রাহুলের প্রচারে আরএসএস ভয় পেয়ে তাদের ক্যাডারদের কাছে গোপন সার্কুলার দিয়ে বলেছে, প্রয়োজনে মোদিকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেব। বিকল্প হিসেবে তারা রাগামাসিং ও নীতিন গড়করির নাম উল্লেখ করেছেন। আরএসএসের এই গোপন সার্কুলার ফাঁস করে দিয়ে গত সপ্তাহে বিজেপির ইংরেজি চ্যানেল রিপাবলিকে (পাঁচ বছরের প্রথম) সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদি ও উত্তরপ্রদেশের মায়াবতীর সমর্থন নিয়ে আমি সরকার গঠন করব কারণ আগে এরা নানা সময় বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন।’ জাতীয়বাদ ভালো কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদ ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে যে কতটা ক্ষতি করতে পারে তা মোদির পাঁচ বছরের রাজত্বে সব ভেঙেচুরে প্রমাণ রেখে গেল। সুতরাং সব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে ২০১৯-এর ২৩ মে।

লেখক : ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর