মঙ্গলবার, ২ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সম্ভাবনার নাম হাওর পর্যটন

ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

সম্ভাবনার নাম হাওর পর্যটন

প্রকৃতির অকৃত্রিম, অনাবিল, অফুরন্ত বহুমাত্রিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এর প্রতি পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পাহাড়, নদী ও হাওরের নির্মল উজ্জ্বলতা। নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, প্রবাল দ্বীপ, সমুদ্রসৈকত, হাওর-বাঁওড়, ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, পুরাকীর্তিসহ আরও অনেক দর্শনীয় স্থান নিয়ে আমাদের এই দেশ। হাওরাঞ্চলের সাগরসদৃশ বিস্তীর্ণ জলরাশি এক অপরূপ মহিমায় অবস্থান করছে। দ্বীপের মতো গড়ে ওঠা ঘরবাড়িগুলো বর্ষাকালে যেমন চোখজুড়ানো দৃশ্যপট তৈরি করে, তেমনি শীতের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হাওরাঞ্চলে পাখপাখালির কলতান কিংবা শুষ্ক মৌসুমের পড়ন্ত বিকালের মিষ্টি রোদের ছড়াছড়ি হাওরকে এক শিল্পীর হাতের সুনিপুণ চিত্রপটের রূপ দেয়। বর্ষায় হাওরের দখিনা বাতাস যখন পালতোলা নৌকাগুলোকে শন শন শব্দে উড়িয়ে নিয়ে চলে এবং সেই সঙ্গে বিস্তীর্ণ জলরাশির ছন্দের তালে তালে ভেসে যাওয়া প্রকৃতিতে যোগ করে সরলতার নতুন মাত্রা। রাতের হাওর এলাকায় ডিঙি নৌকাগুলোর ভরপানিতে কুপিবাতি জ্বালিয়ে মাছ ধরার দৃশ্য কিংবা চাঁদের আলোয় আলোকিত চঞ্চল ঢেউগুলোর চিকমিক করা হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য যে কারও স্মৃতিপটে দাগ কাটবে। আর এই মোহনীয় প্রকৃতির রূপ বৃদ্ধি পায় শ্রাবণের দমকা বাতাসের সঙ্গে গর্জে ওঠা জলরাশির মেলবন্ধনে। হাওরের সুপ্রাচীন জাগরণ আমাদের সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ, সৃষ্টি করেছে হাছন রাজা, উকিল মুন্সী, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের মতো সংগীতজ্ঞ; যা একাংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে হাওরাঞ্চলের মহিমা বৃদ্ধিতে। সবুজের সমারোহে ভরপুর ও হলুদ শর্ষে ফুলের দৃশ্যে পরিপূর্ণ হাওরের ধু-ধু মাঠ শুষ্ক মৌসুমে পরিণত হয় এক নয়নাভিরাম ও  নৈসর্গিক লীলাভূমিতে।

বাংলাদেশের জেলাসমূহের মধ্যে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ সাতটি জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এর মধ্যে সুনামগঞ্জে সর্বোচ্চ ১৩৩টি, কিশোরগঞ্জে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১২২টি, নেত্রকোনায় ৮০টি, সিলেটে ৪৩টি, হবিগঞ্জে ৩৮টি, মৌলভীবাজারে ৪টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩টি হাওর রয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮টি উপজেলা নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ এই হাওরাঞ্চলের আয়তন প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল অঞ্চলে পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে; যার সুবিধা আমরা এখনো উপভোগ করতে পারিনি। মূলত আমাদের দেশে হাওর পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এর শুরু কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। দেশীয় কিছু তরুণ পর্যটক নিজ উদ্যোগে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নৌকা নিয়ে হাওরের বুকে ভেসে বেড়াত। আস্তে আস্তে এর ব্যাপকতা লাভ করতে শুরু করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে পর্যটকদের জন্য তেমন কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা গড়ে ওঠেনি। এর ফলে পর্যটকদের থাকা-খাওয়া, নিরাপত্তাসহ অন্য আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বর্তমানে দু-একটি বেসরকারি ট্যুর অপারেটরের সিলেট অঞ্চলে হাওরভিত্তিক ট্যুর প্যাকেজ চালু রয়েছে।

আমাদের পাশের দেশ ভারত তাদের এই উন্মুক্ত জলাশয়ে পর্যটনের ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছে। মূলত ভারতের কেরালায় এর প্রচলন খুব বেশি দেখা যায়। সেখানে জলাশয়ের বুকে ভেসে ভেসে একজন পর্যটক প্রকৃতি ও চারপাশের মানুষের জীবন অবলোকন করতে পারে। আর তার জন্য বিশেষ ধরনের জলযান ব্যবহার করা হয় যাতে পাঁচ তারকা মানের হোটেলের সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা থাকে। পাশাপাশি পর্যটকের জন্য স্থানীয় শিল্প-সংস্কৃতি উপভোগ করার ব্যবস্থা থাকে। এতে প্রচুর বিদেশি পর্যটক প্রতি বছর কেরালা ভ্রমণ করে। আমাদের দেশেও এ রকম সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা গেলে হাওরকেন্দ্রিক পর্যটনে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পর্যটকরা নৌকায় বসে বিস্তীর্ণ নীল জলরাশির মায়ায় যেমনি ডুব দিতে পারে, তেমনি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা পেতে সাঁতার কাটতে পারে নির্দিষ্ট স্থানগুলোয়। সংস্কৃতিপ্রেমীদের কাছে রাতের চাঁদের আলোর নিচে নৌকায় বসে স্বাদ নিতে পারেন বাউল ও মরমি কবি-সাধকদের গানগুলোর সুর তুলে কিংবা হাওরের শীতল হাওয়া ও পূর্ণিমার আলোয় রাতযাপন করে। বর্ষাকালে হাওরের কোলঘেঁষে থাকা সীমান্ত নদী, পাহাড়, পাহাড়ি ঝরনা, হাওর-বাঁওড়ের হিজল, করচ, নলখাগড়া বনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানান প্রজাতির বনজ, জলজ প্রাণী আর হাওরপাড়ে বসবাসকারী মানুষের জীবন-জীবিকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার মতো খোরাক মিলবে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের। আর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পাখির মিলনমেলা ও সবুজের সমারোহ শীতের মৌসুমে গড়ে ওঠা চোখজুড়ানো সৌন্দর্যে মনপ্রাণ ছুঁয়ে যাবে পর্যটকদের। বাংলাদেশের বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি হিসেবে পরিচিত সিলেট ও মৌলভীবাজারের পাঁচটি উপজেলা নিয়ে বিস্তীর্ণ হাকালুকি হাওর প্রায় ২৩৮টি বিল ও ১০টি নদীর সমন্বয়ে গঠিত। হাকালুকি হাওরে শীতকালে অতিথি পাখিদের আগমন ও স্থানীয় প্রায় ১০০ প্রজাতির পাখির কলতান মুখরিত পরিবেশ ভ্রমণপিয়াসুদের আহ্বানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ সালে রামসার সাইটের তালিকায় স্থান করে নেওয়া সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় প্রায় ৩০টি ঝরনা ভারতের মেঘালয় থেকে এসে মিশেছে। সেই সঙ্গে হাওরজুড়ে ৪৬টির মতো দ্বীপসদৃশ ছোট ছোট গ্রাম এক অপরূপ লীলাক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। ১২০টি বিল ও ১৮০টি নিম্নাঞ্চল মিলে  তৈরি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘নয় কুড়ি কাদার ছয় কুড়ি বিল’ বলে খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানির সঙ্গে ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ, ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপ ও শীতকালে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির বিচরণ এক অকল্পনীয় জীববৈচিত্র্য গড়ে তুলেছে। বাংলার কাশ্মীর হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের নীলাদ্রি লেক বা টেকেরঘাট পাথর কোয়ারি নামে পরিচিত এ স্থানটি ছোট-বড় টিলা, নীল পানি ও পাহাড়কে সমন্বয় করে এক আকর্ষণীয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ৯০ কিলোমিটার। এ জেলা হাওর-বাঁওড়ের জেলা নামে অধিক পরিচিত। এখানে হাওর ঘিরে তৈরি হয়েছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। পানিতে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, স্বচ্ছ জলের খেলা, মাছ ধরতে জেলেদের ব্যস্ততা, ছোট ছোট জলাবন এমনসব অভিজ্ঞতার খোরাক পেতে চাইলে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার নিকলী হাওরে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর বিকল্প নেই।

কিশোরগঞ্জের আরেকটি বিখ্যাত হাওরাঞ্চল হলো অষ্টগ্রাম হাওর। হাওরে নৌকা ভ্রমণের পাশাপাশি মালিকের দরগা ও দিল্লির আখরার মতো জায়গায় ঘুরতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের সমাগম ঘটছে। কিশোরগঞ্জের পানিবেষ্টিত অষ্টগ্রাম উপজেলাটি হাওরের মাঝে অবস্থিত। বর্ষাকালে দ্বীপের মতো মাথা উঁচু করে থাকা গ্রামগুলো শীতকালে নতুন রূপ ধারণ করে। জেলেজীবন ও গ্রামীণ জীবনের স্বাদ পেতে প্রতিদিন পর্যটক ভিড় জমাচ্ছে অষ্টগ্রাম হাওর ভ্রমণ করতে। বর্ষাকালে পানিতে আবদ্ধ হাওরবাসীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে হাওর এলাকায় পর্যটনসুবিধা বৃদ্ধি করে নতুন নতুন পর্যটকের ভ্রমণে উৎসাহিত করে। শুধু সুনামগঞ্জের ৩ হাজার ৬৭০ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে বর্ষায় প্রায় সবটুকুই ডুবে যায়, এখানে  প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মধ্যে বর্ষায় ৭-৮ লাখ মানুষ অলস সময় কাটায়। জেলায় সে অর্থে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পর্যটনে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

 

লেখক : চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর