বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক বিচারপতি

আতিক হেলাল

সর্বজনশ্রদ্ধেয় এক বিচারপতি

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ

বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ উপমহাদেশের একজন স্বনামধন্য আইনবিদই নন, ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিমান ব্যক্তিত্ব, যিনি বিচারপতির আসনে অধিষ্ঠিত থেকে সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন। মানবতাবাদী, সমাজহিতৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেন।

সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্যে শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অবিভক্ত বঙ্গে স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল, ১৮৪৯-৩ আগস্ট, ১৯২৮) কলকাতা হাই কোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৮৯০ সালে। এরপর তার পুত্র সৈয়দ তারক আমীর আলীসহ আরও অনেক বাঙালি মুসলমান হাই কোর্টের বিচারপতি হন। সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। তৎকালীন হাই কোর্টে বিচারপতি হিসেবে তার এ সম্মানজনক আসন গ্রহণের মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধদ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন তার কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। তাই তো, এক পর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধাবোধ করেননি। বিচারপতি-জীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক, সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন।

বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরও কয়েকটি ভাষায় তার দখল ও পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন। অখণ্ড পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি অসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। নির্ভেজাল গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকে অতিক্রম করেছে।

প্রবেশিকা পাসের পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন যথাক্রমে ’৩২ ও ’৩৩ সালে। কলেজ জীবনে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায়ও সম্পৃক্ত হন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদকও ছিলেন একবার। একই সময়ে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। কলেজ জীবনে তিনি ক্রীড়া ক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। মাহবুব মোরশেদ ঢাকা হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন ১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে। ’৫৮-এর অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল তৎকালীন প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেক রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, দেশের সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টাস্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাই কোর্ট থেকে সুয়োমোটো জারি করলেন, যার ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আসতে পারেনি। বিচারপতি মোরশেদ কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডহক বিচারক ছিলেন। সেখানেও তিনি তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।

বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায়ই প্রচণ্ড সাহসিকতা ও গভীর দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ৬৬ সালে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই বিচারপতি মোরশেদ ছয় দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ‘’৬৫-এর যুদ্ধের পর তিনি উপলব্ধি করেন, পূর্ব বাংলার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট মজবুত ছিল না। ’৬৯-এ আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট দাবি করেছিলেন।

তাঁর যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট পাকিস্তান ভেঙে দেওয়ার পর জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এ অঞ্চলের ভোটেই পাকিস্তান গঠিত হয়। যে কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য। সে হিসাবে, এ অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সে দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।

জানা যায়, ’৭১-এর ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণের বিষয়ে বিচারপতি মোরশেদের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে দেশে একটা সাংবিধানিক ভ্যাকুয়াম চলছে, এ পরিস্থিতিতে টিক্কা খানের শপথ গ্রহণ সমীচীন নয়।’

বিচারপতি মোরশেদ কখনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে হাত মেলাননি। তিনি ’৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সঙ্গে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সর্বোপরি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন অন্যতম প্রধান রূপকার।

 

লেখক : কবি ও শিশু সাহিত্যিক

সর্বশেষ খবর